ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৬ সালে সেই অনুযায়ী বিকেএসপির বর্তমান বয়স ৩৪ বছর প্রতিষ্ঠান যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তা কি অর্জিত হয়েছে? চলুন জানার চেষ্টা করি

বিকেএসপি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা...

প্রকাশিত: ০১:০১, ১৪ এপ্রিল ২০২১

বিকেএসপি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা...

মূল্যায়ন ॥ বিকেএসপি প্রতিষ্ঠান হিসাবে সফল। কারণ, তাদের প্রশিক্ষণার্থীরা বিভিন্ন খেলায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করছে নব্বইয়ের দশক থেকে। শুধু প্রতিনিধিত্ব নয়- বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারও এই প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র। আর তাই বলতে দ্বিধা নেই বিকেএসপি তার কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। কেউ কেউ দ্বিমত করতে পারেন। অনেকেই বলতে পারেন বিকেএসপি যথেষ্ট পরিমাণে জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরি করতে পারেননি। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে। এটা করেছে জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো। খেয়াল রাখা দরকার বিকেএসপিতে অধিকাংশ প্রশিক্ষণার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে, অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। আর এই বয়সে জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা একটা ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপার। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খেলার জাতীয় দলগুলো পর্যালোচনা করলে এই কথার যথার্থতা মিলবে। এর মূল কারণ জাতীয় দলে খেলার জন্য শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি মানসিক পরিপক্বতা প্রয়োজন। যা নাকি একজন ১৮/১৯ বছর বয়সের খেলোয়াড়ের মধ্যে তৈরি হয় না। আর তাই মনে রাখা দনকার বিকেএসপির মূল কাজ জাতীয় বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলোয়াড় যোগান দেয়া। আর এটা ভালভাবেই করে চলেছে বিকেএসপি। আধুনিকায়ন ॥ এখন কথা হচ্ছে বিকেএসপি একটা সফল প্রতিষ্ঠান। তাহলে কি এর আধুনিকায়নের প্রয়োজন আছে? সত্যিকার অর্থে, বর্তমান এবং আগামীর চাহিদা মেটানোর জন্য এর আধুনিকায়নের কোন বিকল্প নেই। একটা সফল প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়ন! সেটা আবার কেমন? খেলাধুলা শুধুমাত্র একটা আর্ট - এই ধারণা থেকে সারা বিশ্ব বের হয়ে এসেছে বহু আগেই। খেলাধুলার সঙ্গে সায়েন্স ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খেলাধুলায় সফল দেশগুলো এই ক্রীড়া বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উৎকর্ষতা অর্জন করে চলেছে। আর এই দিকটাতেই পুরো দেশ এবং বিকেএসপি খুব একটা এগিয়ে নেই। আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরির জন্য খেলোয়াড়ের ভিতটা মজবুত হওয়া অত্যাবশ্যক। আর এইখানেই স্পোর্টস সায়েন্স বা ক্রীড়া বিজ্ঞানের ভূমিকা। স্পোর্টস নিউট্রিশান ॥ বিকেএসপিতে ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগতো আছেই। এই বিভাগের অধীনে স্পোর্টস সাইকোলজি, ফিজিওলজি, বাইওমেকানিক্স এবং স্পোর্টস ট্রেনিং রয়েছে। কিন্ত ক্রীড়া বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো স্পোর্টস নিউট্রিশান। আসলে আমরা যদি আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে চাই তাহলে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে। স্পোর্টস নিউট্রিশান তারই একটি অংশ। স্পোর্টস নিউট্রিশানিস্ট এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিটি পেশাদার দলের তারা অংশ। কোন কোন দল তো সঙ্গে একজন শেফ রাখে ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্য। তাই বিকেএসপির ডাইনিংয়ে যে খাদ্য পরিবেশন করা হয় তা হওয়া দরকার সঠিক পুষ্টিমানের। সঠিক খাদ্যগুলোই বিকেএসপির প্রশিক্ষণার্থীদের পরিবেশন করা জরুরী। এই পরিবেশনের পূর্বে কোন ধরনের খাদ্য কেন এবং কোন সময়ে কতটুকু পরিমাণে গ্রহণ করা দরকার এই ব্যাপারগুলোতে প্রশিক্ষণার্থীদের সচেতন ও প্রশিক্ষণ দেয়াটা অত্যন্ত জরুরী। স্পোর্টস নিউট্রিশানের মূলনীতিগুলো মেনে যখন একজন খাওয়া দাওয়া করবেন তাই শরীর ও মন দুটোই তার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে এবং মাঠে পারফর্ম করতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। ফিটনেস ট্রেইনার ॥ এবার আসা যাক স্পোর্টস ট্রেনিং বা ফিটনেসের ব্যাপারে। ফিটনেস যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। বিকেএসপিতে এই ফিটনেস ট্রেনারের ভূমিকা পালন করতে হয় কোচদের। অথচ ফিটনেস ট্রেনিং একটা স্পেশালাইজড বা বিশেষায়িত কাজ। বিশেষ কোন খেলা কোচিং করানোর মতো। যার জন্য পৃথক পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আর তাই বিকেএসপিতে প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন করে প্রশিক্ষিত ফিটনেস ট্রেইনার নিয়োগ দেয়াটা অতি জরুরী এবং সময়ের সাঙ্গে তাল মিলিয়ের চলার জন্য এটা এখন সময়ের দাবি। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন একটি বিভাগ, যেমন ক্রিকেট এখানে বয়স অনুসারে ৪/৫টি দল থাকতে পারে। প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন করে ফিটনেস ট্রেইনার নিয়োগ যেমন খেলোয়াড়দের ফিটনেস অর্জনে বিশেষ সহায়ক হবে। ঠিক তেমনি একজন ফিটনেস ট্রেইনার নিয়োগ দলের কোচকে তার দলের টেকনিক্যাল, ট্যাকটিক্যাল খুঁটিনাটি বিষয়ে আরো মনোনিবেশের সুযোগ করে দেবে। কোচ, ক্রীড়া বিজ্ঞানী ও উর্ধতন কর্মকর্তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ॥ একজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি করতে চাইলে তাকে বিশ্বমানের সবরকম সুবিধা দিতে হবে, যেমন সাইকোলজি, নিউট্রিশান, ফিটনেস, কোচিং সবই। আর তাই কোচ, ক্রীড়া বিজ্ঞানি এদের নিয়মিত বিরতিতে প্রশিক্ষিণের প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ব আজ বসে নেই। প্রতিনিয়তই গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য। এমন কিছু উদ্ভাবনে তারা নিয়োজিত যা দ্বারা তাদের দলগুলো মাঠে খেলার সময় যেন তারা বাড়তি সুবিধা পায়। আর তাই বিকেএসপির কোচদের এবং ক্রীড়া বিজ্ঞানীদের নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয়া অত্যন্ত জরুরী। এরজন্য ফেডারেশনের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে আরেকটা জরুরী ব্যাপার হচ্ছে আমরা সবসময় কোচদের প্রশিক্ষণের কথা বলে থাকি। অথচ কোচরা প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণ করেন না। নীতি নির্ধারণ করে থাকেন প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ। আর তাই এই উর্ধতন কর্তাব্যক্তিদের প্রশিক্ষণটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা প্রয়োজন বিকেএসপির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরির ভিত গড়ে দেয়া। আর সেটা করার জন্য তাকে সব কিছুই আন্তর্জাতিক মানের সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। বিকেএসপিতে ডিগ্রীতে পড়াশোনা ॥ বিকেএসপির মূল উদেশ্য বয়সভিত্তিক দলগুলোর জন্য খেলোয়াড় তৈরি করা বা জাতীয় দলের পাইপলাইন তৈরি করা। আর সেটার জন্য প্রতিষ্ঠানের সব পরিকল্পনাই হওয়া উচিত বয়সভিত্তিক দলগুলোকে ঘিরে। অর্থাৎ অনুর্ধ ১৩, ১৫, ১৭, ১৯ এগুলো ঘিরে। বিকেএসপিতে ডিগ্রীতে পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে এবং প্রশিক্ষণার্থীও রয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার ১৯/২০ বছর বয়সে যে প্রশিক্ষণার্থী একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি, তাকে এই বয়সে প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় দলের জন্য উপযোগী করে তোলা বেশ কঠিন কাজ। যাতে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলা যায়। তবে পরিকল্পনা এমন হতে পারে এদের দিয়ে ভবিষ্যতে কোচ, ট্রেইনার, ক্রীড়া বিজ্ঞানী এই সব পেশার পাইপলাইন তৈরি করা । মহাপরিচালক ॥ বিকেএসপির জন্য আরেকটি বিশেষ সমস্যা হচ্ছে ৩/৪ বছর পরপর মহাপরিচালক বদল। বিপত্তিটা হচ্ছে বিকেএসপি একটা ক্যাডেট কলেজ বা কোন জাতীয় কারিকুলামের স্কুল নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন, ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যের একটি বিদ্যালয়, যেখানে খেলাধুলার প্রশিক্ষণটাই প্রাধান্য পায়। এই কনসেপ্টটাই অনেকের বুঝে উঠতে ৬ মাস এক বছর লেগে যায়। এই বুঝে উঠার সময়টা ওই মহাপরিচালক নিজের অজান্তেই হয়তো বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত নেন। আর যখন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয় তখন নিজের স্বকীয়তায় নতুন চিন্তা ভাবনাগুলোকে বাস্তবায়ন করেন। ফলে বিকেএসপিকে প্রতি ৩/৪ বছর পরপর নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা বা এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর চাইতে একজন মহাপরিচালককে যদি ৮/১০ বছর স্বপদে রাখা যায় তাহলে তিনি একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে পারেন। এক্ষেত্রে ৮/১০ বছর ধরে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিটির সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর ৩/৪ বছর মেয়াদে কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সম্ভব নয়। পরিশেষে বলব বিকেএসপি সফল একটি প্রতিষ্ঠান। এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান দেশের জন্য বহু সুনাম বয়ে আনার কারিগর তৈরি করে চলেছে সফল্ভাবে। আর এই প্রতিষ্ঠানটির নিয়মিতভাবে আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া চলমান থাকতে হবে। এই আধুনিকায়নের প্রক্রিয়াটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্যকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করবে। ইমতিয়াজ আহমাদ (প্রাক্তন ছাত্র ও ক্রিকেট কোচ বিকেএসপি)
×