ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভেঙ্গে যাচ্ছে বাবুনগরী মামুনুলদের হেফাজত

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ১৪ এপ্রিল ২০২১

ভেঙ্গে যাচ্ছে বাবুনগরী মামুনুলদের হেফাজত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ হেফাজতের ভাঙ্গন প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হকের বিদায় আসন্ন। মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা কারণ দেখিয়ে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমিরের পদ ছাড়লেন মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। আরও অনেকেই পদ ছাড়ার জন্য পাইপ লাইনে। হেফাজতে ইসলামের নতুন নেতৃত্বে আসছেন আল্লামা শফীপুত্র আনাস মাদানী। হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বের অনেকেই আনাস মাদানীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সরকারের একটি বিশেষ অংশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে আনাস মাদানীর। পবিত্র রমজান মাসের মধ্যেই হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি ঘোষণা হতে পারে। হেফাজতের বাবুনগরী ও মামুনুল হক যে কোন সময়ে গ্রেফতার হতে পারেন। আল্লামা শফী হত্যাকা-ে তারা চার্জশীটভুক্ত আসামি। এই হত্যাকা-ের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- হতে পারে। এ জন্য বাবুনগরী ও মামুনুল হকের নেতৃত্বের সঙ্গীরা সটকে পড়ছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন দেখা দেয় বাবুনগরী ও মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলাম সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর হেফাজতের হরতাল আহ্বান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালিয়ে পুলিশের থানা, ক্যাম্প, আক্রমণ, আগুন দিয়ে জ¦ালাও পোড়াও, ভাংচুর করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে হেফাজতে ইসলাম। এসব ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনার মধ্যেই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও রয়েল রিসোর্টে কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণাকে ধরা পড়েন মামুনুল হক। শুধু তাই নয়, জান্নাত আরা ঝর্ণাকে নিয়ে ধরা পড়ার পর জান্নাত ফেরদৌস লিপি নামে আরেক নারীর সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁস হলে এই নারীও না কি মামুনুল হকের তৃতীয় স্ত্রী দাবি করা হয়। এসব ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের ভাবমূর্তি তো বিনষ্ট হয়েছেই, এমনকি ধর্মপ্রাণ ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম, ওলেমা মাশায়েখদেরও আর মুখ দেখানোর উপায় নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে হেফাজতের ইসলাম নামক সংগঠনটির ভাঙ্গনের সানাই বেজে উঠেছে। পদত্যাগ করলেন হেফাজতের মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান ॥ এনামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারিসহ হেফাজতের নেতৃত্বের বিতর্ক নিয়ে হেফাজত ইসলামের নায়েবে আমিরের পদ ছাড়লেন মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, আমি নিজের অনুভূতি ও উপলব্ধি থেকে বলছি, হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ.-এর ইন্তেকালের পর হেফাজতে ইসলামে যোগ্য নেতৃত্বের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহসভাপতি আব্দুল বাতেন, মবিন উদ্দিন আহম্মদ, নওশী মিয়া, আব্দুল বাতেন নোমান, আবুল কাশেম চাকলাদার, মহাসচিব আঃ রহমান খান ফরায়েজী, যুগ্ম-সম্পাদক নুরুল ইসলামসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। হেফাজতে ইসলামের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি হয়েছে, নিজেদের মধ্যে। বিভিন্ন দল ও ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ অনুপ্রবেশ করেছে এবং তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে হেফাজতে ইসলামকে অত্যন্ত সুকৌশলে মাঠে নামানোর চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামকে তারা অনেকটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছে। নানা ঘটনায় বিতর্কের মধ্যে থাকা ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নায়েবে আমিরের পদ ছাড়ার ঘোষণ দিলেন বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। তিনি বলেছেন, মোদিবিরোধী বিক্ষোভের নামে দেশে যা হয়েছে, তাতে তিনি উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে, এই স্বাধীনতা একটি সমষ্টিগত অর্জন। স্বাধীনতার সুবিধা এবং স্বাধীনতার আবেগ, অনুভূতি, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমি বাংলাদেশের সকল জনগণকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে আগে ও পরের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। এহেন পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মতো মহান নেতৃত্বের শূন্যতা অনুভব করছি। ভাঙ্গন প্রক্রিয়া ॥ গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক আহমদ শফী, যার নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মৃত্যুর আগের দিন মাদ্রাসায় তুমুল হট্টগোলের মধ্যে শফী মহাপরিচালকের পদ ছাড়তে বাধ্য হন। তার ছেলে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানিকেও বহিষ্কার করা হয়। পরে ১৫ নবেম্বর শফীর অনুসারীদের বিরোধিতার মধ্যেই হেফাজতে ইসলামের সম্মেলন হয়, তাতে আমির পদে আসেন জুনাইদ বাবুনগরী। হেফাজতের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছেন যে, আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের কর্তৃত্ব নেন। তিনি হেফাজতের আমির নির্বাচিত হওয়ার পর সম্প্রতি কর্মকা-ের জন্য হেফাজতকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। সারাদেশে নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিসহ একের পর এক হুংকার, সরকারী অফিস ভাংচুর, জ্বালাও একই সঙ্গে হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারির কারণে হেফাজতের ভাঙ্গন প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাবুনগরী আমির হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি হেফাজতকে বিতর্কিত করেছেন, একটি রাজনৈতিক আবরণ দিয়েছেন। বাবুনগরী ও মামুনুল হক বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এখান থেকেই এখন হেফাজতের ভাঙ্গনের সূচনা হয়েছে। আনাসের নেতৃত্বে বৈঠক ॥ গত কয়েকদিনে আল্লামা শফীর পুত্র আনাস মাদানী নেতৃত্বে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বের অনেকেই বৈঠক করেছেন, তারা আলাপ-আলোচনা করছেন। ঈদের আগেই হেফাজতের একটি নতুন অংশ আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো যে, জুনায়েদ বাবুনগরী যখনই হেফাজতের আমির নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই সময়ে হেফাজতের প্রধান অংশ পুরোটাই ছিল জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারী এবং জুনায়েদ বাবুনগরীর পক্ষে। সেই সময়ে আল্লামা শফীর পুত্র এত সংখ্যালঘু ছিলেন যে, তিনি আলাদা অবস্থান শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেননি। এমনকি যখন তাকে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, তখনও তিনি তার প্রতিবাদ করতে পারেননি। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। হেফাজতের অন্তত ৬০ শতাংশ আনাসের পক্ষে চলে গেছেন ॥ হেফাজতের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, বাবুনগরী ও মামুনুল হকের নেতৃত্বে যদি ভাস্কর্যবিরোধী এবং নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলন না করা হতো তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না। এখন হেফাজতের অনেক শিক্ষক এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মনে করছেন যে বর্তমান নেতৃত্ব যদি অব্যাহত থাকে তাহলে হেফাজতকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে এবং মাদ্রাসার যে সুযোগ-সুবিধা সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। আর এই প্রেক্ষাপটেই হেফাজতের নতুন নেতৃত্বের মেরুকরণ হচ্ছে।
×