ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

লকডাউনে বিবর্ণ বৈশাখ

প্রকাশিত: ২১:০২, ১৪ এপ্রিল ২০২১

লকডাউনে বিবর্ণ বৈশাখ

বাংলাদেশ সরকার ১৪ এপ্রিল, ২০২১. (১ বৈশাখ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ) থেকে সারাদেশে আপাতত এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। করোনা মহামারীর সংক্রমণ বর্তমানে ২৫% এর ওপরে রয়েছে যা জাতির জন্য এক মহাবিপদ সঙ্কেত। এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫ শত ৯৩ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৯ হাজার ৫ শত এর অধিক মানুষ যা জনমনে এক আতঙ্কের প্রতীক হিসাবে আবির্ভূত। বর্তমানে চলছে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান এবং আশা করা হয়েছিল এবারকার ১ বৈশাখ পাবে এক নতুন মর্যাদা। কিন্তু কোভিড-১৯ তা আর হতে দিচ্ছে না, একুশের বইমেলা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে আর রেখে যাচ্ছে এক ইতিহাস যার সাক্ষী এবারকার বাংলা নববর্ষ যা আমাদের জীবন থেকে কখনও মুছে যাবে না। পহেলা বৈশাখ আমাদের একমাত্র উৎসব, যা বাঙালী পরিচয়কে গুরুত্ববহ করে তোলে সবচেয়ে বেশি। তাই দিনটি একই সঙ্গে পালিত হয় শহর ও গ্রামে, সমান মর্যাদায়, আয়োজন করা হয় বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান আর মেলা। কবে থেকে পহেলা বৈশাখ উৎসব প্রথম শুরু হয় এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভারতবর্ষে মুঘল আমলে বাদশারা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত কিন্তু হিজরী সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফসলের সঙ্গে মিলত না। যার ফলে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশমতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং আরবী হিজরী সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই পদ্ধতি কার্যকর হয় ৫ নবেম্বর, ১৫৫৬ সন থেকে যখন আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আধুনিক নববর্ষ উদ্যাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে এবং সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকা-ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোতে যে বাংলা দিনপঞ্জি ব্যবহার করা হয়েছে তা সংস্কৃত গ্রন্থ সূর্য সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে লেখা। এখানে মাসগুলোর ঐতিহাসিক সংস্কৃত নামগুলো রাখা হয়েছে যার প্রথম মাসের নাম হলো বৈশাখ। তাদের দিনপঞ্জিটি হিন্দু দিনপঞ্জি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং বিভিন্ন বাঙালী হিন্দু উৎসবের দিন নির্ধারণে সেটি ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের বাঙালীদের জন্য প্রতিবছর ১৪ ও ১৫ এপ্রিলে এই উৎসব হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হওয়া ১৯৬৬ সালের একটি কমিটিতে পুরনো বাংলা দিনপঞ্জিকে সংশোধিত করা হয়। এখানে প্রথম পাঁচ মাসকে ৩১ দিন, আর বাকি মাসগুলোকে ৩০ দিন বানানো হয়। প্রতি অধিবর্ষে ফাল্গুন মাসে ৩১ দিন ধার্য করা হয়। ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে এই দিনপঞ্জি গ্রহণ করা হয়। এরপর, জাতীয় দিনপঞ্জির সূচনা ও প্রতিবছর নববর্ষ ১৪ এপ্রিলেই হয়ে থাকে, ১৪২৬ বঙ্গাব্দে দ্বিতীযবারের মতো সংশোধনী আনা হয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির বিশেষ দিনগুলোর সমন্বয় আনতে বাংলা একাডেমি এই পরিবর্তন আনে নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিনÑএই ছয় মাস ৩১ দিনে হবে, ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল অধিবর্ষের বছর ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের হবে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে মুসলিম বাঙালী মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটে এবং প্রকৃত অর্থে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু হয় সমাজের এ অংশের মধ্যে আত্মপরিচয় সম্পর্কে নতুন জিজ্ঞাসা, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের সন্ধান। ঠিক সে সময়ই, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে পহেলা বৈশাখ সরকারী ছুটি ঘোষণার ঘটনা বাঙালী জাতীয়বাদকে সামনে নিয়ে আসে। ধর্মীয় পরিচয়ের পাশাপাশি তখন এ সমতল ভূমির অগ্রসর মানুষের কাছে ভাষাগত প্রশ্নে ‘বাঙালী’ পরিচয়টিও হয়ে ওঠে অত্যন্ত পরিষ্কার। সরকারী ছুটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ দিনটি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তৈরি করে দেয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ। পহেলা বৈশাখের উৎসবকে অর্থময় করার ক্ষেত্রে ছায়ানটের ভূমিকা এবং তাদের উদ্যোগেই ১৯৬৭ সালে রমনা বটমূলে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় সঙ্গীতায়োজন এবং পরবর্তী সময়ে এ সঙ্গীতায়োজনকে ঘিরে রমনা পার্কে বৈশাখী মেলার আয়োজন সর্বস্তরের বাঙালীর শিকড় সন্ধানের চেষ্টা সফল হয়। এরপর প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র-শিক্ষকদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা স্থান পায় যার প্রচলন ১৯৮৯ সাল থেকে প্রথম শুরু। আর সর্বশেষ অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পহেলা বৈশাখকে জাতীয় উৎসবের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা। বর্ষপঞ্জির প্রথম সংস্কার হয় ১৯৫২ সালে ভারতের বিশিষ্ট জ্যোতির্পদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহার হাত দিয়ে এবং ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার তার এ সংস্কারের সুপারিশ গ্রহণ করে। সেই সুপারিশকেই সামনে রেখে ১৯৬২-৬৩ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদই প্রথম সরকারী নথিতে স্বাক্ষরসহ বাংলা সন চালুর নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই একই কার্যধারা চালু থাকে। এরপর অনেক পথঘাট পার হয়ে ১৯৮৭ সালে এসে জেনারেল এরশাদ সরকারী সব কাজকর্মে ইংরেজী সাল-তারিখের পাশাপাশি বাংলা তারিখ লেখার নির্দেশ দেন। বাঙালীর জীবনে বাংলা নববর্ষের একটি সোনালি পঠভূমি রয়েছে যা ইতিহাস স্বীকৃত। কিন্তু সময় সময় কিছু কিছু গঠন আমাদের সার্বিক আয়োজনকে ম্লান করে দেয় যা গত বছরও ঘটেছে, এ বছরও একই কায়দায় ঘটতে যাচ্ছে। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন-জীবিকা/আয় রোজগারের প্রশ্ন যেমন কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য, বৈশাখী পোশাকের বাণিজ্য, গ্রামীণ/শহুরে মেলার বাণিজ্য, মৃতশিল্প কামার-কুমারদের বাণিজ্য, নাট্যকর্মী, যাত্রাশিল্প, পালাকারদের আয়-রোজগারের পথসহ আরও কতকিছু। রয়েছে নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগও। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িত বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়, বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠাপুলির আয়োজন, অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে এবং এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। যেমনÑনৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি ইত্যাদি। কিন্তু লকডাউনে বিবর্ণ নববর্ষ ও ক্ষতিগ্রস্ত জীবন জীবিকা। এখন সরকারের সামনে কি উপায় আছে যা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যেমনÑ এক. প্রথমে বেঁচে থাকা এই সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে বিধিবিধান মেনে যার আর কোন প্রকার বিকল্প নেই। জনগণ যদি যতœশীল না হয় তাহলে সরকার আইন প্রয়োগে বাধ্য হবে যা এখন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে দেখা হচ্ছে; দ্বিতীয় সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ এখন পর্যন্ত রোগাক্রান্তদের সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছে সীমাবদ্ধতার মাঝেও। কিন্তু সংক্রামক যে হারে বাড়ছে তা এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনতে পাড়লে মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে বলে প্রতিয়মান হয়। যার ফলে লকডাউনই একমাত্র পথ সামনে রয়েছে সরকারের কাছে, তবে তা যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে জীবিকায়ন হুমকির মধ্যে পড়বে নিশ্চয়। তৃতীয় : এখন সংস্কৃতি বড় না জীবন বড় তা অবশ্যি মূল্যায়নের সময় এসেছে এবং বেঁচে থাকতে হলে দুটিরই প্রয়োজন। তবে স্থান, কাল ভেদে তা জনগণ ও সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই জাতীয় দুর্যোগের মোকাবেলা করি এবং জীবন বাঁচাই। পহেলা বৈশাখ প্রতিবছরই আসবে হয়ত অন্য এক আমেজ নিয়ে। হয়ত এর মধ্যে সব স্বাভাবিক হয়ে উঠবে জীবন ও জীবিকার বাহনগুলো। সৃষ্টিকর্তা সকলের সহায়ক হোন এই কামনা রইল। লেখক : গবেষক ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
×