ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাফিসা বানু

বসন্ত উৎসব এবং নববর্ষ

প্রকাশিত: ২১:০০, ১৪ এপ্রিল ২০২১

বসন্ত উৎসব এবং নববর্ষ

বাংলা বছরের ১১তম ও ১২তম মাস যথাক্রমে ফাল্গুন ও চৈত্র। এই দুই মাস মিলে ষড়ঋতুর শেষ ঋতু বসন্ত। শীতের পর বসন্তের আগমন অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের শুরু। ফাল্গুন মাসকে প্রতি বছর বরণ করে নেয়ার জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে থাকি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে বসন্তকে বরণ করে থাকি, ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে...’। বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য আমাদের দেশে বিশেষ উৎসব ও আয়োজনের সঙ্গে পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়। বাংলাদেশে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ দিনটিকে বরণ করতে চারুকলার বকুল তলায় এবং ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতি বছর জাতীয় বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে থাকে। বাংলার এ অঞ্চলে প্রাচীন আমল থেকেই বসন্ত উৎসব পালিত হয়ে আসছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোতে এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈষ্ণবরা এই উৎসব বেশ উৎসাহ ও আয়োজনের সঙ্গে পালন করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশেষ নাচ গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি প্রচলিত আছে। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সন থেকে বাংলাদেশে প্রথম বসন্ত উৎসব উদযাপন করার রীতি প্রচলিত হয়। তখন থেকেই জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব পালনের নিয়মিত আয়োজন করে আসছে। কোকিলের সুমধুর কুহু কুহু ডাকে জানিয়ে দেয় বসন্ত এসে গেছে। সাধারণত যে এলাকায় গাছগাছালি বেশি সেখানে কোকিলের কুহুতানেই সকালের ঘুম ভাঙ্গে। বসন্ত ঋতুকে বলা হয় ‘ঋতুরাজ’। বসন্ত ঋতুই সব ঋতুর সেরা। এই সময় আবহাওয়া নির্মল থাকে। শীতের শেষে বসন্ত কালের শেষ দিকে গরম পড়লেও হালকা মিষ্টি মধুর বাতাস বয়ে যায়। সেই ঝিরি ঝিরি বাতাসে ফাগুন হাওয়ায় বেশ সুন্দর একটি মিষ্টি মধুর আমেজের ছোঁয়া অনুভব করে সবাই। এ সময় ফুলে ফুলে রঙ্গিন হয়ে ওঠে প্রকৃতির সবুজ অঙ্গন। শীতের শেষে অর্থাৎ মাঘের শেষ থেকে গাছে গাছে আম্র মুকুলের সমাহার দেখা যায়। মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে চারদিকে এক মধুময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, পলাশ, শিমুল ইত্যাদি ফুলে ছেয়ে যায় প্রকৃতি। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুলের আগুন রাঙ্গা লাল রঙ্গে আর রাধাচূড়ার হলুদ রঙ্গে প্রকৃতি অপরূপ রূপে সেজে ওঠে। মৃদু মন্দ বাতাসে নানান ফুলের গন্ধ জানান দিয়ে যায় বসন্তের আগমন। শুকনো পাতা ঝরে গিয়ে জন্ম নেয় কচি কচি নতুন পাতা। গাইতে ইচ্ছে করে আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/ এত পাখি গায়...। বসন্ত উৎসবে অর্থাৎ পহেলা ফাল্গুনে ছোট বড় সব বয়সের মেয়েরা হলুদ বা বাসন্তি রঙের জামা কাপড় বা শাড়ি পরিধান করে, দেখতে কি ভালই না লাগে। ফুলের দোকানগুলোতে কেনাবেচার ধুম লেগে যায়। নানা বয়সী মেয়েদের মাথায়, হাতে, গলায় থাকে নানান বর্ণের ফুলের তৈরি অলঙ্কার। ছেলেরাও অনেকে হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে নিজেদের সাজায়। দেশে বসন্ত উৎসব খুব আনন্দের সঙ্গে পালন করা হয়। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে আমাদের দেশে। ঋতুরাজ বসন্ত শেষে শুরু হয় গ্রীষ¥কাল। বাংলা বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মিলে গ্রীষ্মকাল। বাংলা বছর অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয় বৈশাখের ১ তারিখে। এ উৎসবের একটি ইতিহাস আছে। মুঘল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালের নতুন বছরকে কেন্দ্র করে। এছাড়া তিনি ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে অন্যতম উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। একটি সময় ছিল যখন বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ বলতে কিছুই ছিল না। প্রথমে ফসলি সন পরে বাংলা বর্ষ নামে বঙ্গাব্দ শুরু হয়। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা করা হয় ১৫৮৫ সালে। সম্রাট আকবরের নির্দেশে তৎকালীন নামকরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী বাংলাভাষী ফতেহউল্লাহ সিরাজী প্রথম বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন। তিনি এটি তৈরি করেছিলেন সৌর সন আর তখনকার সময়ের প্রচলিত হিজরী সনের ভিত্তিতে। হিজরী সনের ওপর ভিত্তি করে খাজনা আদায়ের প্রচলন ছিল তখন। তিনি যখন দেখলেন চাঁদের হিসাব করা হিজরী সনের কারণে ফসলের মৌসুমভিত্তিক খাজনা আদায়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়, তখনই তিনি নতুন কিছু করার চিন্তা করেন। এই চিন্তার ফসলই বাংলা বর্ষ গণনা। উল্লেখ্য, চাঁদের হিসেবে বছর গণনা করা হলে বছরের হিসাব ১১ দিনের একটি গড়মিলের ঝামেলায় পড়ে যায়। ফলে বছর বছর ফসলের মৌসুমের সঙ্গে মাসের হিসাব মেলে না। এ অবস্থায় কৃষক এক মৌসুমের খাজনা অন্য মৌসুমে দিতে পারে না। এ সমস্যার সমাধান হয় বাংলা বর্ষ প্রবর্তনের মাধ্যমে। সম্রাট আকবরের আমলে প্রবর্তিত হওয়ায় তখন থেকেই বাংলা ভূখণ্ডে নববর্ষ উদ্যাপন শুরু হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে ডক্টর মুহাম¥দ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হওয়া একটি কমিটির মাধ্যমে পুরনো বাংলা দিনপঞ্জি সংশোধন করা হয়। এখানে প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিন করে আর বাকি মাসগুলোকে ৩০ দিন করে গণনা করা হয়। প্রতি অধিবর্ষে ফাল্গুন মাসকে ৩১ দিন ধার্য করা হয়। ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে এই দিনপঞ্জি গ্রহণ করা হয়। এরপর থেকে জাতীয় দিনপঞ্জির সূচনা এবং প্রতি নববর্ষ ১৪ এপ্রিলেই পালিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে চন্দ্র সৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। এই দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সরকারী ছুটির দিন। বর্তমান সরকার কর্তৃক ঘোষিত বৈশাখী ভাতা প্রদানের ফলে সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য বৈশাখ উদ্যাপন আনন্দময় ও উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে। বাঙালী জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পহেলা বৈশাখ। পৃথিবীর যত দেশে বাঙালীর বসবাস রয়েছে সেখানেই পালিত হয়ে থাকে পহেলা বৈশাখ। আমাদের দেশে ঈদ বা পূজা অনুষ্ঠানের চাইতেও বেশি উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পহেলা বৈশাখ। কারণ ঈদ উৎসব পালন করেন মুসলমান জনগোষ্ঠী আর পূজা হলো হিন্দুদের উৎসব, বড় দিন খ্রিস্ট ধর্মের উৎসব, কিন্তু পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে। তাই নববর্ষের প্রথম প্রহরে সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো ...’ রাজধানী ঢাকায় পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানটি ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়। পহেলা বৈশাখের সূর্যোদয়ের পর পরই ছায়ানটের শিল্পীরা সমি¥লিত কণ্ঠে বর্ষবরণের গান গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানান। বর্ষবরণের এই সঙ্গীত অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর ঢাকার রমনা পার্কে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। স্থানটিকে বটমূল বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের নিচে মঞ্চ তৈরি হয়, সেটি আসলে অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানীদের নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এছাড়াও ঢাকায় বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক রীতি হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি শুরু হয় ১৯৮৭ সালে শিল্পী মাহবুব জামাল শামিম আর হিরন্ময় চন্দ্রের উদ্যোগ। ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে আসছে। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলার রূপকে ফুটিয়ে তোলা হয়। হাতি, ঘোড়া আর পশু-পাখি ইত্যাদির প্রতিকৃতি দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা সাজানো হয়। শোভাযাত্রা চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী পেশার এবং বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। নববর্ষ মেলা, পান্তা ভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় নববর্ষ পয়লা বৈশাখ। মেলায় থাকে রকমারি আয়োজনের সমাহার, যেমন-পুতুল নাচ, হাতি ঘোড়া চরকি, বায়স্কোপ, লাঠি খেলা, নাগরদোলা, সার্কাস, কীর্তনের আসর। নদীতে নৌকাবাইচ আর মাঠে কুস্তি খেলা। দোকান সাজিয়ে বসে মৌসুমী দোকানিরা। এসব দোকানে থাকে নানা রকমের গ্রামীণ জনপদের তৈরি পিঠা, গুড়ের বাতাসা, কদমা, জিলাপি, রঙিন লেবনচুস, মুড়কি, মোয়া, হাওয়াই মিঠাই আরও থাকে মাটির বাসন কোসন, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, বেলোয়ারি ও রেশমি চুড়িসহ হরেক রকম পণ্য। অনেক স্থানে মাটির বাসন-কোসনে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার আয়োজন থাকে। এই দিনটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হালখাতা তৈরি করা বা খোলা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাবের বই বোঝানো হয়। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম শহর বা বাণিজ্যিক এলাকার সকল স্থানে পুরনো বছরের হিসাবের বই বন্ধ করে নতুন হিসাবের বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই রীতিটি স্বর্ণের দোকানগুলোতে এখনো প্রচলিত। গ্রীষ্মকালের ২য় মাস জ্যৈষ্ঠ মাসকে আমরা মধু মাস বলে থাকি। এই মাসে বিভিন্ন ধরনের রসালো ফল পাওয়া যায় যেমনÑ আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, আনারস ইত্যাদি। গ্রীষ্মকালে খরা ও রোদের তাপ থাকে প্রচণ্ড। তবে এ সময়ে রসালো ফল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। মানুষ রসালো ফল গ্রহণের মাধ্যমে দাবদাহ থেকে কিছুটা হলেও নিষ্কৃতি পায়। গ্রীষ্মের শুরুতে বৈশাখ মাসে হঠাৎ করে আকাশ কালো করে বৈশাখী ঋড়ের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে যায়। তার আগে ধূলিঝড় ওঠে। এ সময় আম গাছ থেকে কাঁচা আম ঝরে পড়ে ঝড়ের তাণ্ডবে। ছেলেমেয়েরা সেই কাঁচা আম কুড়াতে থাকে আনন্দের সঙ্গে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। গাইতে ইচ্ছে হয়-আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তল“তল। তবে গতবারের মতো এবারও নববর্ষ ঘরে বসেই উদযাপন করতে হবে। করোনা মহামারীর সময় সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুন বছর আমাদের জন্য বয়ে আনুক সুস্থ-সুন্দর স্বাভাবিক জীবন, এই প্রত্যাশা রইল। ‘বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক/ এসো হে বৈশাখ এসো এসো...’ লেখক : সদস্য (অর্থ) নির্বাহী বোর্ড, বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)
×