ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বইমেলা প্রতিদিন

সুদিনের প্রত্যাশায় বই উৎসবের সমাপ্তি

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ১৩ এপ্রিল ২০২১

সুদিনের প্রত্যাশায় বই উৎসবের সমাপ্তি

মনোয়ার হোসেন ॥ বই উৎসবের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ১৮ মার্চ। গল্প-উপন্যাস, কবিতাসহ বিচিত্র বিষয়ক গ্রন্থের সফরটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল। কিন্তু প্রাণঘাতী মহামারীর আগ্রাসনে ২৮ দিনের বইমেলার ইতি টানা হলো ২৬ দিনে। সেই সুবাদে সোমবার শেষ হলো অমর একুশে বইমেলা। উর্ধগতিতে সংক্রমণ ছড়ানো এবং প্রাণহানি ঘটানো করোনাকালের বাস্তবতায় মেলার শেষদিনে চোখে পড়েনি চিরচেনা সেই রূপটি। বইপ্রেমীদের তুমুল ভিড় জমেনি প্যাভিলিয়ন থেকে স্টলে। প্রাণের উচ্ছ্বাসে মুখরিত ছিল না মেলার আবহ। তবে এমন বাস্তবতার মাঝেও বইমেলাকে চালিয়ে নেয়ার মাঝেই স্বার্থকতা খুঁজে নিয়েছেন লেখক, প্রকাশক থেকে পাঠক। আগামীতে করোনামুক্ত বিশ্বে সুন্দরতম বইমেলার প্রত্যাশা করেছেন তারা। আশার আলোয় ভর করে তারা বলেছেন, কেটে যাবে প্রতিকূল পরিবেশ, আসবে সুদিন। এর বাইরে বইমেলায় অংশ নেয়া ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশকরা চেয়েছেন সরকারের সহযোগিতা। আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি দাবি জানিয়েছেন প্রণোদনা প্রদানের। এছাড়াও প্রতিবছর ঘটা করে আয়োজক বাংলা একাডেমির পক্ষে মেলায় বইয়ের বিকিকিনির হিসাব দেয়া হলেও এবার তা দেয়া হয়নি। করোনাকালীন বাস্তবতায় অনুষ্ঠিত হয়নি সমাপনী আয়োজন। শুধুমাত্র নান্দনিক অঙ্গসজ্জার কারণে তিনটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পদক প্রদান করা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো উড়কি, সংবেদ ও কথাপ্রকাশ। এর বাইরে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুায়ী, মেলার ২৬তম দিন পর্যন্ত নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ২ হাজার ৬৪০টি। বেলা বারোটায় শুরু হয়ে সোমবার বিকেল পাঁচটায় শেষ হয় অমর একুশে বইমেলা। তবে মেলা শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময়ের আগেই অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে স্টলের কাঠামো গুছিয়ে ফেলতে দেখা গেছে। এসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলেছেন, আজ মঙ্গলবার বেলা তিনটার মধ্যে বইসহ স্টলের কাঠামো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ রয়েছে। তাই আগেই কাজ গুছিয়ে রেখেছেন। আলাপচারিতায় কথাপ্রকাশের ব্যবস্থাপক জাপিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর শেষদিনের মেলায় যে আমেজটি থাকে এবার সেটি নেই। নেই পাঠকের মুখরতা, নেই বইয়ের পাতায় পাঠককে অটোগ্রাফ দেয়া লেখকের ব্যস্ততা। একইভাবেই শেষদিনে বইয়ের বিক্রি নিয়ে হিমশিম খাওয়ার পরিবর্তে আমরা কাটিয়েছি অলস সময়। দুপুর তিনটার পর অল্পকিছু পাঠক এসেছে এবং বই সংগ্রহ করেছে। আর এমন দুঃসময়ে বই কিনতে আসা এসব পাঠককে দেখে আমরা খুঁজে পেয়েছি অনুপ্রেরণা। আগামী বছর নিশ্চয়ই করোনা বিদায় নিয়ে খুলে যাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পুনরায় জমাট বাঁধবে বইমেলাÑএমনটাই প্রত্যাশা করছি। শেষদিনে দুপুরের পর বেশ কিছু পাঠক ঢুঁ মেরেছেন বইমেলায়। প্যাভিলিয়ন থেকে স্টলে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন প্রিয় লেখকের গদ্য-পদ্য কিংবা প্রবন্ধের বইটি। তেমনই এক পাঠকের সঙ্গে দেখা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। হামিদ রহমান নামের এই সরকারী কর্মকর্তা বলেন, শেষদিনে মেলায় এসে ভালই লাগছে। অনেক প্রকাশনীই নির্ধারিত কমিশনের চেয়ে বেশি ছাড়ে বই বিক্রি করছে। বইকেনায় এই সুবিধা পাওয়ায় বিশেষ ভাল লেগেছে। ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা’সহ কিছু প্রবন্ধ এবং গল্প-উপন্যাসের বই সংগ্রহ করেছি। মেলার মাঠে আড্ডা দিচ্ছিলেন সময়ের আলোচিত তরুণ লেখক স্বকৃত নোমান। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, এবার এক ধরনের বিষণœতা কাজ করছে। বই উৎসবের সমাপনী উদ্্যাপনটা হলো না। আরসব আক্ষেপের মাঝেই রয়েছে করোনাকালীন বাস্তবতা। সে কারণেই পাঠকের সঙ্গে লেখকের পারস্পরিক ভাব বিনিময়টি এবার জমে ওঠেনি। অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ লেখকরা মেলায় না আসায় বিরাজ করেছে শূন্যতা। সেই সূত্রে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তাই বলে হতাশ হইনি। আশা করি, আগামী বছর এই দুর্যোগ থাকবে না। আবার ফিরে পাব প্রাণের উচ্ছ্বাসের মুখরিত একটি সুন্দরতম মেলা। একই রকম আশাবাদী উচ্চারণ শোনা যায় চারুলিপি প্রকাশনীর প্রকাশক হুমায়ুন কবিরের কণ্ঠে। বলেন, পরিস্থিতির কারণেই এবার প্রকাশকদের লোকসান দিতে হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিকূল সময়েও যেসব পাঠক মেলায় এসেছেন তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আশা করি এমন এদিন আগামীতে থাকবে না। করোনামুক্ত দুনিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে সুন্দরতম বইমেলা। হিসাবের খতিয়ান ॥ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এবারের বইমেলায় কোন প্রকাশনা সংস্থাই মুনাফার মুখ দেখেনি। সকলকেই ক্ষতির হিসাব গুনে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, আমরা জানি করোনার কারণে এবার সব প্রকাশনা সংস্থাই বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আর এমন ক্ষতির কারণে আমরা তাদের কাছ থেকে হিসাব চাওয়ার সাহস পাইনি। এমনকি এবার একাডেমির বইয়ের বিকিকিনিরও কোন হিসাব করা হয়নি। আসলে হিসাব করার মতো মানসিক অবস্থা আমাদের নেই। প্রকাশকদের ক্ষতিপূরণের দাবি ॥ একুশের বইমেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রকাশকরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা প্রণোদনাও চেয়েছেন সরকারের কাছে। সোমবার লেখক বলছি মঞ্চে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানায় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল ক্ষতিপূরণের প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন, প্রকাশকদের অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ন্যূনতম ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হোক। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি এবং পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির অন্তর্ভুক্ত ৪১৩টি প্রতিষ্ঠানকে এই ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানান তিনি। ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বাজেটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সরকারী বিভিন্ন গ্রন্থাগারের জন্য এই টাকার বই কেনা হোক। এছাড়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজশর্ত ও স্বল্পসুদে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। আমরা আশা করি, ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশকদের কথা চিন্তা করে বইবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
×