ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ১৩ এপ্রিল ২০২১

ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

২০২০ সালের পুরো বছরই বিশ্বসহ বাংলাদেশ বহুল সংক্রমণ করোনাকে মোকাবেলা করতে করতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। চীন, ইউরোপ, আমেরিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে করোনার মারাত্মক ছোবল গত বছরের শুরুতে চরমভাবে বিস্তার লাভ করে। সবার আগে বৃহত্তর এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র চীনে এই করোনার ছোবল সারা বিশ্বকে চমকেও দেয়। লাগাতারভাবে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা লাফ দিয়ে বাড়ার যে দুর্দশা সংশ্লিষ্ট দেশটিকে নাজেহাল করে তা আজও এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকা। তবে চীনের উবেই প্রদেশের উহান শহরেই করোনার প্রথম শনাক্ত এবং পরবর্তীতে তা বহুল বিস্তারে যে মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় চীন অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে তা অন্য কোন প্রদেশ কিংবা শহরে সম্প্রসারিত হতে দেয়নি। উপস্থিত ও যৌক্তিক সিদ্ধান্তে আক্রান্ত উহান শহরকে চীনের অন্যান্য স্থান থেকে জগদ্দল পাথরের মতো অবরুদ্ধতার প্রাচীর তৈরি করা হয়। ফলে উহান শহরকে বিচ্ছিন্ন রেখে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বাকি সিংহভাগ জায়গাকে মুড়িয়ে দেয়া হয়। প্রথমত ধারণা করা হচ্ছিল উহান শহরে বৈজ্ঞানিকদের এক গবেষণাগারে এই ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে। সঙ্গত কারণে বিভিন্নভাবে বিশ্বের বহু বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী এই ছোঁয়াচে রোগটির উৎপত্তির উৎস খুঁজতে হরেক রকম গবেষণাকার্যও পরিচালিত করতে থাকেন। তখন অবধি ভাইরাসটির নিরাময় এবং প্রতিষেধকের ওষুধ সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কোন ধারণাই ছিল না। ফলে করোনার শুধু উৎস খোঁজাই নয় আরও বেশি করে চিকিৎসার ব্যাপারটিও সংশ্লিষ্টদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল চীনে প্রথম এই ভাইরাস দেখা দিলেও পরবর্তীতে এশিয়া কিংবা দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা সংক্রমণ শুরু না হয়ে লাফ দিয়ে চলে যায় ইউরোপসহ আমেরিকায়। সংক্রমণের বহুল বিস্তারের ভয়ঙ্কর পরিণতি সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স এবং আমেরিকায়। সেখানে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়ে যায়। পৃথিবী দেখল নতুন আর এক সংক্রমিত বিশ্বকে, যেখানে অসুস্থ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার চেয়েও সুস্থ মানুষকে নিরাপত্তার বলয়ে আটকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। ভাবাই যায় মহামারী দেশে-বিদেশে এই প্রথম নয়, বরং যুগে ও কালে দুরারোগ্য অতিমারীর ছোবলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বহু জীবন বেঁচে থেকেও মৃতপ্রায় অবস্থায় সময় কাটানোর হৃদয়বিদারক দৃশ্যও অবলোকন করা গেছে। সে মাত্রায় আলাদা করার ব্যাপারটা ছিল শুধু রোগাক্রান্তদের বেলায়। সুস্থ মানুষ নিরাপদে, নির্বিঘেœ ব্যস্ত সময় কাটাতে তেমন কোন সমস্যাই অনুভব করেনি। এই করোনা বিভিন্ন দেশে সুস্থ-অসুস্থ মানুষের মাঝে সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে দেয়। স্থবিরতার অভেদ্য বেষ্টনীতে মানুষ কতখানি নিরাপদ ছিল তা অনুমান করাও কঠিন। তবে এক ধরনের অস্থির ও ক্রান্তিকাল পার করা জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে থাকল। যেখান থেকে আজও মানুষের মুক্তি কিংবা মিলনের কোন সম্ভাবনাই সূচিত হলো না। তার ওপর বহুল সংক্রমণ ভাইরাস হরেক রকম বৈশিষ্ট্যের আলোকে ভিন্ন মাত্রায় নতুনভাবে আক্রান্ত করে বিশ্ববাসীকে আরও শঙ্কিত অবস্থায় দাঁড় করাল। প্রথম ঢেউ কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের চরম দাপট বর্তমান সময়ের আর এক ভয়ানক ক্রান্তিকাল। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণা এবং কর্মসাধনায় নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কার থেকে ভ্যাকসিনের অভ্যুদয় সারা বিশ্বের এক অভাবনীয় ও যুগান্তকারী নতুন সম্ভাবনা। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তা এখন জনগণের মধ্যে প্রয়োগও শুরু হয় ২০২১ সালের প্রথম দিকেই। স্বস্তি আর আশ্বস্তের পরিধি এখন অবধি অবরুদ্ধই বলা চলে। কারণ নতুন চিকিৎসা সামগ্রীর স্থায়িত্ব নিয়েও কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সময়ের নিরিখে আরও ভাবতে হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশে সুনির্দিষ্টভাবে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চে। সেই থেকে পুরো মাস আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। তারপরও সরকার বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করে ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। ২০২০-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকণ্ড যাকে সাড়ম্বরে উদ্যাপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রাসঙ্গিক উৎসব আয়োজনের ব্যবস্থাও সরকারের বিবেচনায় ছিল। তবে জন্মশতবার্ষিকীর মহাপরিকল্পনায় উন্নয়নযজ্ঞের হরেক রকম কর্মপ্রকল্প সাজানো-গোছানোর বিষয়টিই সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সারা বাংলাদেশকে স্থবিরতার দুঃসময় মোকাবেলা করাও ছিল করোনার দুর্ভোগের কঠিন নিয়তি। তেমন ক্রান্তিকাল পার করতে গিয়ে অতি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন রুজি-রোজগারেও আসে এক অনাবশ্যক সঙ্কট। প্রতিদিনের আয় কমে যাওয়া থেকে চাকরি হারানোর বেসামাল অবস্থায় নিপতিত হয় হতদরিদ্র দৈনিক খেটে খাওয়া মানুষ। গৃহকর্মী থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত গাড়ি চালকের চাকরি খোয়ানো প্রতিদিনের এক হৃদয়বিদারক অশুভ সঙ্কেত। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে নগরপিতাদের দাফতরিক কর্মযোগে অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্যপণ্য বিতরণ করা অবরুদ্ধতার সময়কালের এক প্রাসঙ্গিক এবং মানবিক কর্মদ্যোতনা। অনেক বিত্তশালীকেও সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা গেছে। তারপর মে মাসের ধান কাটার মৌসুমে লকডাউনের মধ্যেও সংশ্লিষ্ট কৃষকরা উৎপাদিত ফসল তার গোলায় তুলতে সমর্থও হয়েছে। সরকার ও নানামাত্রিকে কৃষকদের যান্ত্রিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে প্রণোদনার অর্থ সাহায্যে ফসলের মূল কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে ধান কাটার সময়কে বিভিন্নভাবে এগিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালের শুরুটা যতখানি আশ্বস্তের ছিল পরবর্তীতে তা মারাত্মক হতেও সময় লাগেনি। সেই মহিমান্বিত মার্চ মাস। জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ অতিক্রম করা আর বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব-আয়োজনের পরম সন্ধিক্ষণে নতুন করে করোনা সংক্রমণ সবাইকে হতবাক করে দিল। গত বছর যে মার্চেই প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ২০২১ সালের সে মার্চই আবার নতুন করে করোনা বাড়ার দৃশ্যে মানুষকে দিশেহারা করে দিল। মার্চের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার উর্ধগতি এখনও সামলানো যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন শনাক্তের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। সরকার পুনরায় অল্প কয়েকদিনের জন্য দেশকে অবরুদ্ধ করে দেয়। কিন্তু প্রথমবার স্থবিরতাকে মানুষ কিছুটা আমলে নিলেও এবারের লকডাউন কেউ তোয়াক্কাও করছে না। রাস্তাঘাটে পরিবহনের সংখ্যা নামেমাত্র কমলেও যানজট সেভাবে ছাড়াতেও পারছে না। গত এক বছর করোনার সঙ্গে লড়াই করে মানুষ কেমন যেন বেপরোয়া ও দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাট, শপিংমল, মুদি দোকান, বাজার যত্রতত্র মানুষের ঘুরে বেড়ানোর যে ঢল প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে তাতে লকডাউন শব্দটিই তার যথার্থতা হারানোর অপেক্ষায়। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা যেমন অত্যধিক, গণপরিবহনও সে মাত্রায় তার সংখ্যাকে কমায়নি। এবারের করোনা সংক্রমণ আলাদাভাবে বদলানো বৈশিষ্ট্যে মানুষকে আক্রান্ত করছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় অবশ্যই। মানুষও তার স্বভাবগত বেশিষ্ট্যে নিজেকে বদলানোর কোন প্রচেষ্টাই করছে না। বরং অবহেলায়, উপেক্ষায় স্বাস্থ্যবিধিকে আমলে না নেয়ার বিসদৃশ চিত্রও কোনভাবে মানা যাচ্ছে না। কারণ গতবারের তুলনায় এবারের ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বিস্তারের যে মারাত্মক পরিস্থিতির অবতারণা তাকে জোরালো কোন বিধিতে থামাতে না পারলে সামনে কি মাত্রায় তার মাশুল দিতে হবে তা ধারণা করাও মুশকিল। ভয়ঙ্কর সম্প্রসারণের এমন দুঃসময়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা যেমন জরুরী, একইভাবে সামাজিক দূরত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে আরও সচেতন হওয়া একান্ত আবশ্যক। প্রথমবারের তুলনায় অতি অল্প সময়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিস্তারের উর্ধগতি কেন মানুষের মধ্যে ভয় কিংবা আশঙ্কার চাইতে সতর্ক-সাবধানতা তৈরি হয় না তা ভেবে কোন কূলকিনারাও পাওয়া যাচ্ছে না। নিজের সুরক্ষা নিজে দিতে না পারলে সরকার কিংবা রাষ্ট্র কোন শক্তিই নিরাপত্তার বলয় তৈরি করতে পারবে না। যে কোন সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় বিচার-বিশ্লেষণের সক্ষমতা যদি লোপ পায় তার চেয়ে বিপদশঙ্কুল অন্য কিছু হতে পারে না। এখনও সময় আছে। সরকার নিজের দায়িত্ব পালন করছে। সচেতন নাগরিকদেরও ভাল-মন্দের বিপন্ন পরিবেশটা বুঝতে হবে। তা না হলে কোন অশুভ সঙ্কেতকে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। লেখক : সাংবাদিক
×