ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বৈশাখের অনুষঙ্গ লোক ঐতিহ্যের শখের হাঁড়ি

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ১২ এপ্রিল ২০২১

বৈশাখের অনুষঙ্গ লোক ঐতিহ্যের শখের হাঁড়ি

মোরসালিন মিজান ॥ আগামী বুধবার পহেলা বৈশাখ। নতুন বছর ১৪২৮ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেয়ার পালা। তবে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এবারও বাদ দেয়া হয়েছে উৎসব আনুষ্ঠানিকতা। বড় কোন উৎসব অনুষ্ঠান হবে না। তাই বলে বৈশাখ ঘিরে মনে যে রং, সেটি তো আর লুকোনো থাকে না। বলা চলে, নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার প্রাক্কালে বাঙালীর মনের রংটুকুই ধারণ করেছে শখের হাঁড়ি। উজ্জ্বল রঙে আঁকা হাঁড়ি আর সব হাঁড়ি থেকে আলাদা। বাংলার লোক ও কারুশিল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে আছে। কালের ব্যবধানে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। শখের হাঁড়িও এখন খুব একটা দেখা যায় না। তাই বলে হারিয়ে গেছে বলা যাবে না। গ্রামে অল্প স্বল্প ব্যবহার। শহরে গৃহসজ্জা সামগ্রী হিসেবে আলাদা কদর পাচ্ছে। শিকড় সন্ধানী মানুষেরা নিজেদের গৃহকোণে শিকে বেঁধে তাতে ঝুলিয়ে রাখছেন শখের হাঁড়ি। দেখতে কী যে ভাল লাগে! মৃৎশিল্পের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন শখের হাঁড়ি। মাটি দিয়ে তৈরি হাঁড়ি সাধারণত প্রাকৃতিক এবং খুব উজ্জ্বল রং দিয়ে চিত্রিত করা হয়। লাল হলুদ সাদাসহ বিভিন্ন রং ব্যবহার করেন শিল্পীরা। হাঁড়ির গায়ে সরু তুলি দিয়ে ফুল লতা পাতা পাখি জল মাছ ইত্যাদি আঁকেন। অনন্য সাধারণ কারুকৃতি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এসব মাটিরপাত্রে গ্রামীণ জীবনাচার, উৎসব, সংস্কার, ধর্মসহ নানা কিছু ফুটিয়ে তোলা হয়। লোকচিত্রের বর্ণাঢ্য নমুনা বহন করে শখের হাঁড়ি। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকশিল্পের সার্থক প্রকাশ ঘটে এই ধারার কাজে। মৃৎশিল্প এবং শখের হাঁড়ির নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক শাহেদা খাতুন। তিনি জানান, শখের হাঁড়ি বিশেষ ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হতো। বিয়েতে, এর আগে পরের আনুষ্ঠানিকতায় মিষ্টি না হলেই নয়। মিষ্টি পিঠা ইত্যাদি বহন করা হতো শখের হাঁড়িতে করে। মিষ্টি ছাড়াও, তিলা কদমা নাড়ু মুড়কি মোয়া ও অন্যান্য খাবার হাঁড়িতে পুরে উপহার হিসেবে কুটুম বাড়িতে পাঠানো হতো। গ্রামের বিয়ে বাড়িতে শখের হাঁড়ির ব্যবহার অতি পুরনো। চাঁপাইনবাবাগঞ্জে মেয়ে বিদায়ের সময় তার সঙ্গে শখের হাঁড়ি পাঠানোর রেওয়াজ ছিল বলে জানা যায়। প্রথম সন্তান প্রসবের পর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে এই হাঁড়ি নিয়ে যেত। হাঁড়িটি শখের চুকাই ও ঝাঁপি নামেও পরিচিত। এর সঙ্গে সিকরা হাঁড়ি ও বাটা নামে আরও দুটি হাঁড়ি পাঠানো হতো বলেও জানা যায়। লোক গবেষকদের মতে, শখের হাঁড়ির দুটি ধারা রয়েছে। বিশেষ এক ধরনের কাজ হয় রাজশাহীর বাঁয়া, বসন্তপুর ও নবাবগঞ্জের বারোঘরিয়ায়। এসব হাঁড়ির হলদে জমিন। জমিনের ওপর লাল নীল সবুজ কালো রঙে হাতি ঘোড়া মাছ শাপলা পদ্ম দলদাম রাজহাঁস পাতিহাঁস পেঁচা কবুতর ইত্যাদি আঁকা হয়। ভিন্ন রীতি অনুসরণ করেন নওগাঁর বাঙ্গাল পাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তাদের হাঁড়িগুলোর মূল রং লাল। তার ওপর সাদা কালো ও সরষে ফুলের রঙে মাছ পাখি পদ্ম ফুলের মোটিভ তুলে ধরা হয়। ৮ থেকে ৯টি পরিবার এসব হাঁড়ি তৈরির কাজ করে। ঢাকার আশপাশের কিছু এলাকায়ও শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ হয়। নয়ার হাট, ধামরাই, রায়ের বাজারে কুমোররা যত্নের সঙ্গে এ কাজ করে থাকেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ হয়। অঞ্চল বেঁধে শখের হাঁড়ির আকার ও স্টাইলে পার্থক্য লক্ষণীয়। কিছু শখের হাঁড়ি হাতল বিশিষ্ট। কোন কোন অঞ্চলের হাঁড়িতে ঢাকনা যুক্ত করা হয়। কোন কোনটির মুখ আবার হা করা থাকে। তবে সব হাঁড়ি-ই বাংলার লোক ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে যত্নের সঙ্গে তুলে ধরে। ফলে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সময়টাতে রাজধানী শহরেও শখের হাঁড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। বৈশাখী মেলা বা লোক ঐতিহ্যের উৎসব অনুষ্ঠানে শখের হাঁড়ির শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়। শিল্পীরা সবার সামনে বসে হাঁড়ি চিত্রিত করেন। পুরো কাজ আনন্দ নিয়ে উপভোগ করেন কারুশিল্পপ্রেমীরা। বিক্রিও হয় ঢের। শৌখিন ক্রেতারা শখের হাঁড়ি দিয়ে ঘর সাজান। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজানোর কাজেও ব্যবহৃত হয় শখের হাঁড়ি। তবে এবার করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বর্ষবরণের প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা বাতিল করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে শখের হাঁড়ি খুব একটা আসেনি। রাজধানীর দোয়েল চত্বর, মিরপুর রোড, মিরপুর গোল চত্বরসহ কিছু এলাকার ফুটপাথে শখের হাঁড়ি বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। ফুটপাথে বসে কেউ কেউ অনভ্যস্ত হাতেই আঁকার চেষ্টা করছেন শখের হাঁড়ি। অতোটা শৈল্পিক না হলেও অনেকে কিনছেন। অবশ্য মৃৎশিল্পীদেরও মন খারাপ। সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার সময়ে কর্মহীন তারা। কিছু শখের হাঁড়ি তৈরি হয়েছিল। সেগুলো বিক্রি হয়নি। নতুন করেও তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। তার চেয়ে বড় কথা চাহিদা থাকলেও, সরবরাহ করা কঠিন হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে জানতে কথা হয় শখের হাঁড়ির বিখ্যাত শিল্পী সুশান্ত কুমার পালের সঙ্গে। রাজশাহী থেকে ফোনে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমি এবং আমার দুই ছেলে সারাবছরই শখের হাঁড়ি তৈরি করি। তবে বৈশাখের আগের সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে। গতবার আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এবারও প্রচুর শখের হাঁড়ি তৈরি করেছিলাম। এখন ঘর ভর্তি। কিন্তু বিক্রির সুযোগ পাচ্ছি না। অবশ্য তার ছেলে শিল্পী মৃত্যুঞ্জয় কুমার পাল জানান, অনলাইনে শখের হাঁড়ি বিক্রি করছেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষকদের মাধ্যমে এই বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
×