ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাজ্জাদ কাদির

হেফাজতী তান্ডবে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২২:০৬, ১২ এপ্রিল ২০২১

হেফাজতী তান্ডবে বাংলাদেশ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে আপন বন্ধুপ্রতিম, প্রধান উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সরাসরি অংশগ্রহণ করার কারণে ভারতের সরকার প্রধান বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আসবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি আসার কথা জানার পর থেকে বাংলাদেশের জনগণের বিপথগামী একটি অংশ মাঠ গরম করার পাঁয়তারা শুরু করে এবং তাঁর সফরকালে এই বিপথগামী গোষ্ঠী যা করল তা রীতিমতো অস্বাভাবিক বললে ভুল হবে না। এদের কর্মকান্ড আজ থেকে ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে যুদ্ধকালেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে এবং পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে এ জাতীয় গোষ্ঠী। যুদ্ধকালের বাংলাদেশে জালাও,পোড়াও, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেই সময়েও। কিন্তু আজ ৫০ বছর পরেও এদের তান্ডব দেখতে হবে, এটা কাম্য নয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয়, এরা ফুলে ফেঁপে উঠতে উঠতে ’৭১-এর চেয়েও অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এ কথা সত্য যে, নরেন্দ্র মোদি ভারতের একটি রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বিজেপির প্রধান নেতা। তার রাজনৈতিক আদর্শ ও রক্ষণশীলতা নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে। তার আদর্শ নিয়ে খোদ ভারতেই ভূরি ভূরি আন্দোলন সব সময় চলে থাকে। নিজেও বিজেপির সাম্প্রদায়িক উগ্র হিন্দুত্ববাদকে কোনভাবেই সমর্থন করি না। সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ সেটি হিন্দু, মুসলিম, খ্রীস্টান যাই হোক না কেন, তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে বিষয় হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি তার দলের নেতা হিসেবে বাংলাদেশে আসেননি। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে তার আগমনকে দেশের জনগণের পক্ষ থেকে সাধুবাদ জানানোটাই শিষ্টাচার। কিন্তু আমাদের একটি অসব্য বর্বর অংশ শিষ্টাচার কী জিনিস সেটি বোঝে না। যার কারণে মোদির সফরকে সাধুবাদ না জানিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়েছিল। ভারতে বিজেপি যেমন একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল, ঠিক তেমনি বাংলাদেশেও ইসলামের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার উত্থান বহু আগে থেকেই ঘটে গেছে। এক সময় জামায়াতে ইসলামী তা নানাভাবে দেখিয়ে দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামের ঘৃণ্য জঙ্গী কর্মকা- নিয়ে অতীতে অনেকবার আলোচনা করেছি। এখানে আর করতে চাই না। মোদির সফরকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে তা-বলীলা ঘটে গেল, এর প্রধান কারিগর হিসেবে সামনে এসেছে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি। ২০১৩ সালের আগে এমন কোন সংগঠনের নামগন্ধও কোনদিন শুনিনি। তাদের নাম প্রথম সামনে আসে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ এবং সেই দিনের ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে। এরা প্রথমবারই তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল ধর্মের নামে নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে। সেই সন্ত্রাসী কর্মযজ্ঞ দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল। এতে প্রমাণ হয় এটি একটি সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠন। সেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কিছু দিন পর থেকেই দেখা গেল দলটি সরকারের সঙ্গে একটি আপোষের সম্পর্কের মাধ্যমে চলছে। আর এই চলার কারণে সংগঠনটি আরও বেপরোয়া অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আজও আমার মাথায় ঢোকে না যে ধর্মের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী একটি সংগঠনকে কোন স্বার্থে আওয়ামী লীগ সরকার আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় কিংবা দেবে? সরকার কী তাহলে ভয় পেয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মের তা-বকে মনে করে? নাকি তাদের ভোট ব্যাংককে সরকার আমলে নিয়েছিল? নাকি জামায়াতে ইসলামকে দমিয়ে রাখার জন্য বিকল্প একটি ধর্মভিত্তিক সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে? হবে একটা কিছু। যেভাবেই বলি না কেন সরকার দুধ কলা দিয়ে যে কাল সাপ পুষেছে এবারের তা-বে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। কারণ তা-ব ও হামলা থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, আওয়ামী লীগ অফিস, সরকারী অফিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বঙ্গবন্ধুর ছবি, ম্যুরাল কোন কিছুই বাদ যায়নি। বিশেষ করে দুটি জনপদ-চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। যে কারণেই হোক সরকারী আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ফলে হেফাজত নিয়ে বাংলাদেশে যে এক আপদ ও বিপদ তৈরি হয়েছে, এর দায় সরকারকে নিতে হবে। কারণ আজকে প্রায় এক যুগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় বর্তমান সরকার। এদের সুপথে আনার দায়িত্বও ছিল সরকারের। সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যার কারণেই ২০১৩ সালের পর আবারও ভয়াবহ তা-বলীলা চালাতে পেরেছে হেফাজত। ভাবলেও অবাক লাগে একটি বিদেশী রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে নিজেরা নিজেরা মারামারি করে মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটে গেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতী শাসন চলে। তারা চাইলেই সেখানে ইচ্ছেমতো তা-ব চালাতে পারে। সেখানকার তান্ডব দেখলে মনে হয় না যে, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলে কিছু আছে। মোদির সফরের আগে পড়ে কয়েকদিন সম্পূর্ণ হেফাজতী নিয়ন্ত্রণে ছিল এই দুই জনপদ। সারাদেশে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করার জন্য ইচ্ছামতো তারা তা-ব চালিয়েছে এই দুই জনপদে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলা করেছে ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে জেলা পরিষদ ভবন, পৌরসভা ভবন, পৌর মিলনায়তন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, পুলিশ লাইন, সদর থানা, খাঁটি হাতা বিশ্বরোড হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, শহরের কেন্দ্রীয় মন্দির শ্রীশ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ি, দক্ষিণ কালীবাড়ি, রেলওয়ে স্টেশন, জেলা আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্যের কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আল-মামিন সরকারের কার্যালয়, তার নিজের ও শ্বশুরবাড়ি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাগার চত্ব¡র, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, শিল্পকলা একাডেমি, যানবাহন, সরকারী গণগ্রন্থাগার, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বাদ যায়নি বঙ্গবন্ধুর ছবি ও ম্যুরাল পোড়ানো। কয়েকদিন পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ছিল থমথমে পরিবেশ। শহরবাসী ভয় ও আতঙ্কে ওই ক’দিন ঘর থেকে বের হতে পারেনি। সারাদেশের সঙ্গেও জেলাটিকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। হাটহাজারীর অবস্থাও একই ছিল। ২৯ তারিখ থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। সাম্প্রতিক এই ক’দিনের তান্ডবে সারাদেশে ঝরে পড়েছে অনেক তাজা প্রাণ। এই দুই জনপদ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, সিলেট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে জানমালের ক্ষতি সাধন করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ওই সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। ধর্মের নামে শুধু এবারই নয়, মাঝে মাঝেই হাটহাজারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে উত্তপ্ত করে এরা। এই দুই জনপদে কওমি আর হেফজতিদের দাপট হওয়ার কারণ হলো এখানে শত শত কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। সারাদেশেও প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মে যত ওয়াজ ব্যবসায়ীকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যায় এর বেশিরভাগই ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে উৎপাদিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন দুটি জনপদ তারা ইতোমধ্যে দখল করে ফেলেছে। বাকি আছে অবশিষ্ট জনপদগুলো দখল করার। এভাবে চলতে থাকলে তারা বাকি জনপদগুলোও দখল করে ছাড়বে। সাম্প্রতিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলা, ভাংচুরে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে হেফাজত বেছে বেছে মুক্তচিন্তা বিকাশের প্রতিষ্ঠান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র এবং সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। এতে পরিষ্কার যে, মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক জাগ্রত হওয়ার প্রতিষ্ঠান হেফাজতীদের গাত্রদাহের বড় কারণ। তারা চায় না মানুষ বুদ্ধি বিচার বিবেচনাসম্পন্ন হয়ে উঠুক। তাহলে তারা ছড়ি ঘোরাবে কোথায়? স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ যে তাদের চিরশত্রু এ কথাটিও পরিষ্কার হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল আওয়ামী লীগকে এই বিষয়গুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে। কওমি মাদ্রাসার কোমলমতি শিশু-কিশোরের এই বিপুল জনগোষ্ঠীটিকে নিয়ে হেফাজতি খেলা বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে হেফাজতের মতো জঙ্গী সংগঠন সম্পর্কেও সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। এই হেফাজতও মুখে বলে ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু তারা যে কর্ম করছে তাতে শান্তির লেশমাত্র নেই। যে সংগঠন প্রথম থেকেই সন্ত্রাসের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়, তাহলে সেই সংগঠনের কাছে ভাল কিছু আশা করা যায় না। কওমি মাদ্রাসার ব্যাপারে সরকার যদি এখনও না ভাবে বলব অন্য কারও প্রয়োজন হবে না, এই কওমি জনতাই সরকারকে খেয়ে ফেলবে এবং সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে। সেনা ছাউনিতে জন্ম নেয়া বিএনপি জামায়াতে ইসলামকে আস্কারা দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার বানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ হেফাজতকে আস্কারা দিয়ে কী রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিয়ে আসার পথে হাঁটছে কিনা সে ব্যাপারে ভাবতে হবে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক দল নেই। অচিরেই যে হেফাজত রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আওয়ামী লীগের জন্য কাউকে থ্রেট বা হুমকি হিসেবে দেখছি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি তাদের মাথা থেকে হেফাজতকে না নামায়, তাহলে আশঙ্কা করছি ধর্মের নামে এরা দশ হোক আর বিশ বছর পর হোক আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। আওয়ামী লীগকে ভাবতে হবে আওয়ামী লীগ শুধু সরাসরি বিভিন্নভাবে যারা দলের সঙ্গে জড়িত শুধু তাদের নিজেদের একার দল নয়; আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে এ দেশের হাজারও মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের শেষ ভরসাস্থল। আওয়ামী লীগ শুধু মুসলমানের দল নয়; আওয়ামী লীগ সকল ধর্ম এবং যারা ধর্মহীন তাদেরও দল। কাজেই যারা ধর্মের নামে উন্মাদনা ছড়ায় ও জঙ্গীবাদ ছড়ায় তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ থাকুক এটি কারও কাম্য নয়। আবার এ কথাও ভাবতে হবে যে, কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে জড়িতরাও এদেশেরই নাগরিক এবং একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। তাদের বাদ দিয়েও কোন উন্নয়ন অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে এনে শান্তির জীবন দিতে হবে। কোনভাবেই বাংলাদেশকে বার বার হেফাজতি তান্ডবে লন্ডভন্ড হতে দেয়া যাবে না। লেখক : সাংবাদিক, টিভি অনুষ্ঠান ও তথ্যচিত্র নির্মাতা [email protected]
×