ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. জাহাঙ্গীর আলম

বাংলাদেশে কৃষি বিপ্লব ও খাদ্য নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ২২:০৪, ১২ এপ্রিল ২০২১

বাংলাদেশে কৃষি বিপ্লব ও খাদ্য নিরাপত্তা

বাংলাদেশ এখন মহান স্বাধীনতার ৫০তম বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে চলমান মুজিববর্ষ উদযাপনের পাশাপাশি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের জাতির জনক গ্রাম থেকে এসেছেন, গ্রামের কৃষকদের সংস্পর্শে থেকে তাদের উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। বলেছেন, ‘আমিতো গ্রামেরই ছেলে। গ্রামকে আমি ভালবাসি।’ স্বাধীনতার পর ওই গ্রামীণ জীবনের উন্নয়ন এবং কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য তিনি উদার রাষ্ট্রীয় সহায়তা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন এদেশের কৃষি ও কৃষকের এক মহান প্রাণ-পুরুষ, পরম বন্ধু। উনিশ শ’ একাত্তর সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয় পূর্ণ স্বাধীনতা। এরপর শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘উনিশ শ’ একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি। এই একই দিনে আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু।’ অতঃপর বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এগিয়ে চলে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। দ্রুত অবকাঠামো গড়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় নতুন কর্মসংস্থান। ফলে কাক্সিক্ষত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে দেশজ উৎপাদন। হ্রাস পেতে থাকে দারিদ্র্য। এর মাত্র সাড়ে ৩ বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল দেশদ্রোহী সেনাসদস্য তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়। তারপর দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গত ১২ বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে ৬ থেকে ৮ শতাংশ হারে। স্বাধীনতার পর আমাদের দারিদ্র্যের হার তখন ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশের নিচে। আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল গড়ে মাত্র প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার। এখন তা উন্নীত হয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে এসে দেশকে স্বল্পোন্নয়ন দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। এর মধ্যে দিয়ে চলমান মুজিববর্ষে বাংলাদেশের মর্যাদা পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন খাতে দেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হলো কৃষি খাত। অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। ব্রিটিশ আমলে গঠিত বিভিন্ন কৃষি কমিশনের প্রদত্ত প্রতিবেদনের তথ্য থেকে এখানকার চরম খাদ্য ঘাটতির চিত্রটি ফুটে ওঠে। পাকিস্তান আমলেও পূর্ববঙ্গের খাদ্য উৎপাদনের চিত্র তেমন সুখকর ছিল না। এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে দেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ত্রিশ শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে হয়েছে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির মাধ্যমে। সেটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট অত্যন্ত পীড়াদায়ক। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘খাদ্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজের সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব।’ সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপ্লবের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে তিনি কৃষি বিপ্লবের বিকাশের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের কৃষিবিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না।’ এ বিপ্লবে দেশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি কৃষি উপকরণের ওপর উদার সহায়তা প্রদান করেন। রাসায়নিক সার বিতরণের ব্যবস্থা করেন প্রায় অর্ধেক মূল্যে। ১৯৭২ সালে প্রতি সের (প্রতি কেজি) ইউরিয়া সারের মূল্য ছিল আট আনা (২০ টাকা মণ), টিএসপি সারের মূল্য ছিল ৬ আনা (১৫ টাকা মণ) এবং এমওপি সারের মূল্য ছিল চার আনা (১০ টাকা মণ)। একটি গভীর নলকূপের দাম ছিল প্রায় দেড় লাখ টাকা। সেটি কৃষক সমবায়কে দিয়েছেন মাত্র ১০ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্ট প্রদানের মাধ্যমে। প্রতি ইউনিট পাওয়ার পাম্পের দাম ছিল প্রায় ২২ হাজার টাকা। সেটি ভাড়ায় প্রদান করা হয়েছে মাত্র ৬০০ টাকায়। আধুনিক উচ্চফলনশীল বীজ সরবরাহ করা হয়েছে নামমাত্র মূল্যে। তাছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে উৎসাহিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু ভর্তুকি মূল্যে ট্রাক্টর ও টিলার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তাতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ পড়ে কম। অপরদিকে তিনি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেন। ধান, পাট, তামাক ও আখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যূনতম ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেন। এভাবে তিনি কৃষির উৎপাদনকে লাভজনক করে তোলেন দেশের কৃষকদের জন্য। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের সমাজে চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে’। তাঁর এ অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়েছে দেশের তৎকালীন বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনায়। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে বৃহত্তর কৃষিখাতের শরিকানা ছিল ২০ শতাংশ। তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৩১ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। দেশের আর্থিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল কৃষি উন্নয়নের ওপর। গড়ে তোলা হয়েছিল বিভিন্ন গবেষণা, সম্প্রসারণ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির সকল খাজনা রহিত করেন। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা পরিবার প্রতি ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেন। ওই জমি বিতরণ করা হয় ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে। তাছাড়াও আশ্রয়হীনদের জন্য গড়ে তোলেন গুচ্ছগ্রাম। পাকিস্তান আমলের সকল কৃষি ঋণ সুদসহ মাফ করে দেন। কৃষকদের বিরুদ্ধে করা সকল সার্টিফিকেট কেস তিনি প্রত্যাহার করে নেন। বঙ্গবন্ধু দেশের খাদ্য সঙ্কট নিরসনের জন্য খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে চেয়েছেন। শস্যের বহুধাকরণ চেয়েছেন। ফসলের মৌসুম পরিবর্তন করতে বলেছেন। শীত মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে কম। তখন ফসল ফলানোর সুযোগ থাকে বেশি। সেজন্য শীতকালীন ফসলের ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পানি সেচের সুবিধা সম্প্রসারণ করতে চেয়েছেন। জমির ফসল উৎপাদনের নিবিড়তা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন। আধুনিক কৃষি উপকরণ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি একর জমির উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না? তিনগুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণও করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না। আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্টপরা কাপড়পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই জমিতে যেতে হবে, ডাবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ওই শহীদদের কথা স্মরণ করে ডাবল ফসল করতে হবে। যদি ডাবল ফসল করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাল্লাহ হবে না।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের কৃষি উন্নয়নের গতি থমকে যায়। কৃষিখাতের প্রবৃদ্ধি নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোঠায়। কৃষি ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়। দারিদ্র্য ও মহাজনী ঋণের চাপে নিষ্পেষিত হয় দেশের কৃষক। তবে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর অবস্থার দ্রুত উন্নতি সম্ভব হয়। কৃষিখাতে সরকারী সমর্থন ও সহায়তা বৃদ্ধি পায়। পুনর্প্রবর্তন করা হয় কৃষি ভর্তুকি। তাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। গত ১২ বছর বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকার পরিচালনার মধ্য দিয়ে কৃষিখাতে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়। ১৯৭০-৭১ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ টন। যে কৃষক আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল, সে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল তিন কেজি চালের সমান মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক, কী শ্রমিক- কারোরই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কোন মানুষেরই। কৃষিখাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য, মৎস্য, ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ম্ভর। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলেই এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কৃষির উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জমির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন সারের জন্য কৃষককে ধরনা দিতে হয় না। কৃষকদের কাছেই পৌঁছে যায় সার। আওয়ামী লীগ সরকার সেই ব্যবস্থা করেছে। তিনি বলেন, খাদ্যের জন্য যেন আর কোন দিন বাংলাদেশকে কারও কাছে হাত পাততে না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য। প্রতিবছর দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষি জমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তার পরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের, বরং বাড়ছে নিরন্তর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জনপ্রতি আমাদের খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল ৪৫৬ গ্রাম, ২০০০ সালে তা ৫২২ গ্রাম এবং ২০২০ সালে তা ৬৮৭ গ্রামে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ দ্রুত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি। সাম্প্রতিককালে নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কৃষিখাতে। আগের খোরপোশ পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপ-খাতে। এর পেছনে প্রধান সহায়ক শক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিবান্ধব নীতি, সরকারী প্রণোদনা ও সহায়তা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার কৃষি উন্নয়নের যে উদার নীতিমালা গ্রহণ করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় সম্ভব হয়েছে আজকের এই বিশাল অর্জন। বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কৃষি খাতকে। রাসায়নিক সারের দাম দফায় দফায় কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে পাঁচ দফায় কমিয়ে ইউরিয়া সারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ১৬ টাকা। টিএসপি সারের দাম ৮০ টাকা থেকে কমিয়ে ২২ টাকা, এমওপি সারের দাম ৭০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকা, ডিএপি সারের দাম ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। গত একযুগে শুধু সারেই ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর চালু করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভর্তুকি। ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি। মোট বাজেটের প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে কৃষি ভর্তুকি খাতে। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। ত্বরান্বিত হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান শর্ত খাদ্যশস্যের গড় প্রাপ্যতা। সেদিক থেকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত সন্তোষজনক। দ্বিতীয় শর্ত প্রাপ্ত খাদ্যশস্যে সবার অভিগম্যতা। বর্তমান সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীর আওতায় তা অনেকটাই নিশ্চিত করতে পেরেছে। ১০ টাকা কেজি দরে গরিব মানুষের কাছে সময়মতো চাল পৌঁছে দিচ্ছে। তাতে দেশে প্রাপনীয় খাদ্যশস্যে তাদের অভিগম্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তার তৃতীয় শর্ত খাদ্যের পর্যাপ্ততা ও স্থায়িত্বশীলতার দিকে এখন আমাদের দৃষ্টি। নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের কথাও ভাবছেন সবাই। বর্তমান করোনা মহামারীর প্রভাবে বিশ্ব এখন টালমাটাল। তাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে বিশ্বব্যাপী। ফলে আন্তর্জাতিক খাদ্যমূল্য ক্রমেই বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মাটি উর্বর। তাতে ফলমূল, শাক-শবজি, শস্য লাগান। কোথাও এতটুকু মাটি যেন অনাবাদি না থাকে’। গত ৭ এপ্রিল ২০২০ এক ভিডিও কনফারেন্সে এই নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও তিনি দেশের খাদ্য উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রেখে এক ইঞ্চি জায়গাও অনাবাদি না রাখার আহ্বান জানান। করোনাকালে দেশের কৃষকদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে জন্য তিনি পর্যাপ্ত প্রণোদনা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বুঝায় না, বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাক-সবজি এসবকে বুঝায়। সুতরাং কৃষির উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্যের সমন্বিত উৎপাদনের উন্নতি করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত সেই সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে কৃষির সকল উপ-খাতেই বিপুল পরিমাণে উৎপাদন বেড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ টন। ২০১৯-২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ টনে। মৎস্য খাতে বর্তমান গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ। তাছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উপাদান ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদনে বিপুল পরিমাণে প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশ এখন ডিম ও মাংস উৎপাদনে প্রায় স্বয়ম্ভর। দুগ্ধ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে যে হারে উৎপাদন বাড়ছে, তাতে এর ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে অচিরেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামীণ উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গ্রাম হবে শহর। আমার গ্রাম আমার শহর : প্রতি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধার সম্প্রসারণ- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে তিনি গ্রাম উন্নয়নের পথ নকশাও উপস্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু গ্রামীণ বহুমুখী সমবায়ের যে রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন, তার কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে তিনি গ্রহণ করেছেন ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ প্রকল্প। বর্তমানে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রকল্পটির নামকরণ করা হয়েছে ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’। যে ব্যাংকের মালিক হচ্ছে যৌথভাবে গ্রামের সমিতিভুক্ত প্রান্তিক আয়ের নারী-পুরুষ ও সরকার। ব্যাংকটি ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য বিশেষায়িত। ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’ এবং ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রামীণ সমবায় ভাবনারই বাস্তব রূপায়ন। তাতে উপকৃত হচ্ছে গ্রামের গরিব মানুষ, ছোট কৃষক ও ক্ষেত মজুর। সম্ভব হচ্ছে গ্রামীণ আয়ের বহুধাকরণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এক কালজয়ী ভাষণে দেশের কৃষকদের সম্মান দিয়ে কথা বলতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক। ওদের সম্মান দিয়ে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন, ওরাই মালিক।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতার ওই নিদের্শনাকে অন্তরে ধারণ করেছেন এবং লালন করেছেন। তিনিও পিতার ওই নির্দেশনার অনুসরণে প্রাণের সব মমতা ঢেলে দিয়ে বলেছেন, ‘গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে আমাদের কৃষক। তারা মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করছেন। তাই দেশের কৃষকদের আমাদের মাথায় তুলে রাখা উচিত। তাদের সম্মান দেয়া উচিত।’ এ বিষয়টি আমাদের জাতীয় কৃষিনীতিতে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকা দরকার। লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা। উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। গবেষণা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘একুশে পদক’প্রাপ্ত
×