ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রণেশ মৈত্র

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা ও বর্তমান বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২০:৫০, ১১ এপ্রিল ২০২১

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা ও বর্তমান বাংলাদেশ

১৯৭১ থেকে ২০২১। একেবারে যেন কাঁটায় মাপা ৫০ বছর। আমি যখন ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত হই এবং পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার করিমপুরে রিক্রুটিং ক্যাম্প বা ইয়ুথ ক্যাম্প (যুব শিবির) স্থাপন করে পাবনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ন্যাপ, সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়নের তরুণদের রিক্রুট করার কাজে নিয়োজিত হই তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৩৯ বছর। চাইলাম প্রশিক্ষণ নিতে, সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে, কিন্তু পার্টি নেতৃত্ব তাতে বাদ সাধলেন। তারা বললেন, যুদ্ধে যাবার চাইতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য যুবকদের রিক্রুট করা, অনুপ্রাণিত করা, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেয়া এবং অস্ত্র প্রশিক্ষণে পাঠানোর ব্যবস্থাদি করার দায়িত্ব নিতে হবে। তারা আরও বললেন, এই দায়িত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধকালীন শৃঙ্খলাবোধ থেকে নেতাদের উপদেশকে আদেশ হিসেবে শিরোধার্য বলে বিবেচনায় নিয়ে করিমপুরে ন্যাপ-সি.পি.বি- ছাত্র ইউনিয়নের ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানেই ক্যাম্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলাম ১৯৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের দু’তিন সপ্তাহ পর্যন্ত। ২৫ ডিসেম্বর ক্যাম্প ভেঙ্গেচুরে যারা সেখানে ছিলাম সবাই একটি ট্রাকে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে গান গাইতে গাইতে মহা আনন্দে দেশে ফিরলাম বিজয়ীর বেশে। ঢাকায় পাকবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করলেও আমরা তৎক্ষণাৎ দেশে ফিরতে পারিনি মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী পাবনার এম মনসুর আলীর পরামর্শে। তিনি বলেছিলেন, পাবনাতে তো শুধু পাক আর্মিই নয়, নকশালরাও ছিল অবরুদ্ধ পাবনাবাসীর জন্য মারাত্মক হুমকি। ওদের দমন করতে আরও ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যেতে পারে। হিসেব করে তাকে বললাম, আমরা তবে ২৫ ডিসেম্বর ভোরে রওনা হব। বিগত এই পঞ্চাশ বছরে কি স্বপ্ন দেখেছিলাম? কিইবা ছিল দেশটাকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা? আমাদের প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তানী আমলের তাবৎ বিভেদ বৈষম্যমূলক ভাবনাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়ে একটি নতুন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিমুখী, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবে বিদেশী আধিপত্যমুক্ত আয়-উপার্জনে বিরাজমান পর্বত প্রমাণ বৈষম্য কমিয়ে এনে সামঞ্জস্য বিধান, দলীয়করণমুক্ত এবং মেধার স্বীকৃতিসম্পন্ন প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন, ত্যাগী ও সংগ্রামী রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিত্বের পদ নিশ্চিত করা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী সুন্দর বাংলাদেশ। এমন একটি দেশ বাস্তবে গড়ে তোলার জন্য সে কী উন্মাদনা! আপন স্বার্থকে গৌণ করে দেশ ও জাতির স্বার্থকে মুখ্য বিবেচনা করার যে প্রত্যয় সেদিন ঐ তরুণেরা দেখিয়েছিল তার তুলনা মেলা ভার। বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত এই দেশে আমাকে তিন বছর সময় দিতে হবে। তিন বছরের মধ্যে কিছু দিতে পারব না। কিন্তু শত্রুরা এই তিন বছর চুপ করে বসে থাকেনি। তারা মসজিদে মসজিদে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অজ¯্র মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। ধীরে ধীরে তারা সাম্প্রদায়িক একটা আবহ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এটাকে প্রকারান্তরে হিন্দু রাষ্ট্র বলেও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে মুসলিম জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছে। তদুপরি বিধ্বস্ত দেশে আমদানি-রাফতানি ঠিকমতো না হওয়া, ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, সকল দেশের স্বীকৃতি অর্জনে কিছুটা সময় লেগে যাওয়া ইত্যাদি কারণে জনমনে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ক্ষোভ জমে উঠেছিল। বাজারে বহু পণ্যের প্রচ- অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। যার ফলে বিক্ষুব্ধ হচ্ছিল মধ্যবিত্তসহ সকল স্তরের মানুষ। আমেরিকা এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট আরও ঘনীভূত করে তুলতে তৎপর হয়। কারণ তারা চেয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয় না ঘটুক। পাকিস্তানের অখ-তা অটুট থাকুক। এ সকল পরিস্থিতির সুযোগে দেশে-বিদেশে নানা স্থানে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভারই সিনিয়র একজন সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তার অনুসারীরা। এইসব ষড়যন্ত্রের পরিণতিতেই স্বয়ং মোশতাকের নির্দেশে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের ১৯৭৫ রাত গভীরে সপবিারের বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-। কিছুদিন পরেই ঘটানো হয় একই নেতার নিদেশে ১৯৭৫-এর ৩ নবেম্বর মর্মান্তিক জেলহত্যা। সেখানে গভীর রাতে অস্ত্র হাতে কারাগারে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধের চার নেতা, যারা বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানী কারাগারে আটক থাকায় মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে নেতৃত্বদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে এই গুরুদায়িত্ব মাথায় তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন- সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশকে করে ফেলা হয় নেতৃত্বহীন। বস্তুত আমাদের স্বাধীনতার শত্রুরা এ সকল কাজ করেছিল একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। তারা তো পাকিস্তানের মদদপুষ্ট ছিল। গোপনে এই পরিকল্পনা রচনায় জামায়াতে ইসলামীরও বিস্তর অবদান ছিল। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো, পরবর্তীতে প্রায় কোন আওয়ামী লীগ নেতা এ জাতীয় হত্যাকা- এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় রূপান্তরিত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেন না। নিজেরাও নিজেদের বিশাল সংগঠনকে সেই মুহূর্তের সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করলেন না- সম্ভবত অধিকতর মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে এই আশঙ্কায়। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি জানি পুলিশ বাহিনী অপেক্ষা করছিল একটি নির্দেশের, যুব-ছাত্র সমাজও অপেক্ষা করছিল অনুরূপ একটি ইঙ্গিতের। অপেক্ষা করার পর তারা ধরেই নিল হয়তোবা এটা তাদেরই সরকার। খন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগ নেতাই তো ক্ষমতা নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ প্রকৃত তথ্য জানবার জন্য ঢাকায় নেতাদের খোঁজে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন। টেলিফোনে যোগাযোগও সম্ভব হলো না। এই সুযোগে ওরা সংহত হলো। কিন্তু ১৫ আগস্টের হত্যালীলা সাধনের পর তারা গণপ্রতিরোধের ভয়ে আতঙ্কিত ছিল। অকস্মাৎ তারা ঐ ক্ষমতা গণপ্রতিরোধের ফলে হারাতে বাধ্যও হতে পারে এমন আশঙ্কাও করছিল। তদুপরি সেনাবাহিনী ঐ হত্যালীলার ব্যাপারে নানামতে বিভক্ত ছিল। কাজেই কোন মহল থেকে ইঙ্গিত পেলেই ওদের গণেশ উল্টে দেয়া যেত। কিন্তু নেতারা সে সাহস দেখাতে ব্যর্থ হলেন। আজও সেদিনের সেই ব্যর্থতার মাশুল দিয়ে যেতে হচ্ছে জাতিকে। ব্যাকওয়ার্ড মার্চের শুরু সেখান থেকেই। পরিণতিতে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ নেতারা গোপন বৈঠক করে ৬ নবেম্বর দেশব্যাপী প্রতিবাদ মিছিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত নেতাদের জানিয়ে দেন। তারা সম্মতও হন। তাই গোপনে হলেও ব্যাপক প্রস্তুতিই চলতে থাকে ৬ নবেম্বর প্রতিবাদ মিছিলে সবদিক দিয়ে সফল করে তোলার জন্য। প্রস্তুতি প্রায় শেষ। ইতোমধ্যে এলো মারাত্মক ধরনের দ্বিতীয় আঘাত। ৩ নবেম্বর ভোররাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট মোশতাকের নির্দেশে কতিপয় সশস্ত্র সেনা দস্যু গিয়ে পূর্ব থেকে কারাগারে আটক তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরদিন কারা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট পরিবার-পরিজনের হাতে লাশ ফেরত দেয়ার ঘটনা থেকেই খবরটি মুখে মুখে সারাদেশে প্রচার হয়ে যায়। কোন মিডিয়াতে এই মর্মান্তিক খবর প্রকাশ করতে দেয়নি তৎকালীন অবৈধ সামরিক সরকার। তবু বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনের নির্ধাতির কর্মসূচী অক্ষুণœ রাখা হয় এবং তা যথারীতি ঢাকা, পাবনা, কিশোরগঞ্জসহ ব্যাপক সফলতার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। তবে এসব প্রতিরোধ আন্দোলনের কোন ধারাবাহিকতা না থাকায় প্রথম দিকে ক্ষমতা দখলকারীরা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও পরে প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পেরে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং তাদের মূল পরিকল্পনা কার্যকর করতে নেমে পড়ে। ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটে গেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের দায়িত্বভার নিজ উদ্যোগেই কাঁধে নিলে। ইতোমধ্যে গণতন্ত্রের পূজারী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে তিনি দুটি কাজ করলেন। একটি হলো-বাকশাল ভেঙ্গে দিয়ে স্বকীয়তাহীন বহুদলীয় রাজনীতি পুনরায় চালু করলেন। তবে দল পুনরুজ্জীবনে বিধিনিষেধ আরোপ করায় এবং আবেদন জানিয়েও তাতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে বাকশাল নামে কোন দল পুনরুজ্জীবন করা আর গেল না। বাধ্যতামূলক করা হলো ছাত্র, যুব প্রভৃতি অঙ্গ সংগঠন থাকতে হবে। নিজেও প্রথমে জাগদল নামে, পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামে নতুন দল গঠন করলেন। ঘোষণা দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলে প্রাধান্য দেয়া হবে। কিন্তু তারা তেমন একটা সাড়া না দেয়ায় নিজ পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম লীগ, জামায়াত প্রভৃতি ইসলামপন্থী দলের কিছু নেতাকে, পরে বিভিন্ন দলের বহু সুবিধাবাদী নেতাকে নিয়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দলে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে তবে সকল ক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষিগত রেখে খিচুড়িমার্কা একটি তথাকথিত জাতীয়তাবাদী দল গঠন করলেন, যার জাতীয়তাবাদ হবে ইসলামভিত্তিক। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে বিসমিল্লাহ ছিল না, তা যোগ করলেন। জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ ছিল। সেগুলোকে সামরিক আইনে সংবিধান সংশোধন করে বৈধতা দিলেন। পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরেই শুরু হলো। শুরু হলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগমনের পরিবর্তে পশ্চাদগমন তথা ব্যাকওয়ার্ড মার্চ। ১৯৭৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদের এক নির্বাচন দেন। এই নির্বাচনে বিরোধী দল মাত্র ৪০টির কাছাকাছি আসন পায়। অথচ নবনির্বাচিত এবং জনগণের কাছে আদৌ পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও তার দল দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে সুস্পষ্ট কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভ করে। বহু রাজাকারকেও এই নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে আনা হয় এবং বিরোধী দলের কাদেরকে বিজয়ী করে আনা হবে সে তালিকাও আগেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হলেন। সংসদের আদৌ কোন সার্বভৌমত্ব ছিল না। সংসদটি ছিল রাবার স্ট্যাম্প সংসদ। বাংলাদেশের উভয় স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ রাবার স্ট্যাম্প সংসদই পরিচালনা করেছিলেন। তাদের ইচ্ছা বা নির্দেশই ছিল সার্বভৌম। মর্মান্তিকভাবে নিজ বাহিনীর একদল কর্মকর্তা দ্বারা ১৯৮১তে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তিনি নিহত হন। বিস্ময়কর হলেও সত্য তার মৃত্যুর পর প্রায় দুই দশক ধরে বিচারপতি সাত্তার ও বেগম খালেদা জিয়া মিলে দেশ পরিচালনা করলেও জিয়া হত্যাকা-ের কোন বিচার তারা করলেন না, কোন মোকদ্দমাও দায়ের করলেন না। জিয়া গ্রেফতার করেছিলেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে। এ ব্যাপারে তিনি দিব্যি আইয়ুবের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। বিনা বিচারে আমাকেও গ্রেফতার করে এক সপ্তাহ পরে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আমাকেও পাঠানো হয় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেলের গেট খুলে আমাদের অফিস রুমের পাশে অপেক্ষা করতে বলে মূল ভেতরের ফটকটা খুলে দেয়া হলো। অনেক বন্দী যারা মুক্তি পেলে তাদের বের করা হলো। পরে ডেপুটি জেলারকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘বুঝতে পারলেন না, আপনারা মুক্তিযোদ্ধারা এবার জেল খাটবেন, রাজাকাররা মুক্তি পেতে শুরু করেছে।’ ছবিটা বেশ উপভোগ করছিলাম সবাই। দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারা এতে দিব্যি পরিস্ফুট হয়ে উঠল। দেড় বছর পর হাইকোর্টে রিট করে তবে মুক্তি পেলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেব। বাহাত্তরের মূল সংবিধান আমরা সবাই জানি ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। অপরদিকে ধর্মের নামে রাজনীতি করা বা রাজনৈতিক দল গঠন করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ঐ সংবিধানের মুখবন্ধেও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানুর রহিম’ লেখা ছিল না। সামরিক আইনের শক্তি খাটিয়ে জনগণের কোন অংশই এগুলো দাবি না করা সত্ত্বেও সংবিধান সংশোধন করে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করা হলো। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে সংবিধান কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলো। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দল পাকিস্তান আমলের মতো বৈধ দলে পরিণত হলো। জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, যিনি পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে পালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে বিজয়ের কয়েকদিন আগে আশ্রয় নিয়েছিলেন জিয়া সরকার তাকে ভিসা দিয়ে ঢাকায় বসবাসের সুযোগ দিল। কিন্তু ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তাকে দিব্যি স্বাধীন এই দেশটিতে বাংলাদেশের নাগরিকের মতোই থাকতে দিল। এভাবে দিন গড়াতে গড়াতে আলহাজ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে জিয়ার সাংবিধানিক সংশোধনী প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করলেন ‘বাংলাদেশেরর রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম’ এই কথা ক’টি একইভাবে ঐ সংবিধানে সংযোজন করে। এভাবে সংবিধানের পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ সকল অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের দল বছরের পর বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। বিগত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৯৭২-এর মূল সংবিধানে ফেরত যাওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে তার সপক্ষে বিপুলতম সংখ্যক ভোটারের রায়ে তিন-চতুর্থাংশের অনেক বেশি আসন পেয়ে বিজয়ী হলো। ব্যাপক আশাবাদের সৃষ্টি হলো এবার। নতুন সংসদ ঐ পাকিস্তানী প্রবর্তনামূলক ধারাগুলো সংশোধন করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফেরত যাবার ব্যবস্থা করবে। সুপ্রীম কোর্টও পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়ে এ কাজটি আরও সহজ করে দিল। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, কিছুই হলো না। রাজনীতিতে নীতিহীনতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক ধারা বর্জন এসবই হয়েছে এই গত চল্লিশটি বছর ধরে। তাই দেশটি যেন ব্যাকওয়ার্ড মার্চ করেই চলেছে। তবে যে বাঙালী জাতি স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে সে জাতি একদিন ফরোয়ার্ড মার্চ করবেই। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক [email protected]
×