ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ গণপরিষদ

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ১০ এপ্রিল ২০২১

বাংলাদেশ গণপরিষদ

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজির তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার ‘Witness to surrender’ গ্রন্থে যা লিখেছেন: ‘এইভাবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এখন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্তে (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল। যখন প্রথম গুলি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারী তরঙ্গের কাছাকাছি একটি থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।’ ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’ এ এই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়। ঘোষণায় বলা হয় : ‘এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি যে যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং হাতে যার যা আছে তা-ই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান যতদিন না দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।’ পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সারাদেশে সাধারণ জনগণ, পুলিশ, ইপিআরের বাঙালী সৈনিক, সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সারাদেশে বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হয় জনযুদ্ধ। জনগণের এই মুক্তিসংগ্রামকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সহযোগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভারতে একত্রিত হতে থাকেন। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করা ‘রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাইকমান্ড’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামকে চূড়ান্ত রূপ দিতে ঐক্যবদ্ধ হন। ৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত আলোচনা করেন। সঙ্গে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ছিলেন। দু’দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীমতী গান্ধী ও জনাব তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে এই বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় ও অবাধ রাজনৈতিক কার্যপরিচালনার সুযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ (M.N.A) এবং এমপিএ (M.P.A)-দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে ভারতের আগরতলায় অধিবেশনে একত্র হয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম রচিত, অধ্যাপক ইউসুফ আলী পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের মূল সাংবিধানিক ভিত্তি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আইনগত বৈধতা প্রদান করে স্বাধীনতা সংগ্রামের। বাংলাদেশের সংবিধানেও সংযোজিত রয়েছে এই ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হলো : ‘যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল, যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ উক্ত অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭টি নির্বাচিত করেছিলেন, যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন, যেহেতু আহূত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন, যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতিবহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান, যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে, যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করে তুলেছে, যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, সেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ গঠনের কথা ঘোষণা করছি এবং এই ঘোষণা দ্বারা আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বে যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন সেই পবিত্র ঘোষণাকে অনুমোদন করছি এবং এতদ্বারা আমরা আরও অনুমোদন করছি ও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনী সমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন। তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজনবোধে মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের নিয়োগ করতে পারবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের ওপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে পালন করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে ও নিয়মানুগ উপায়ে রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে এই কাজের জন্য নিযুক্ত করলাম। স্বাক্ষর (এম ইউসুফ আলী)’ উক্ত অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিপরিষদ এবং এমএনএ ও এমপিএগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ করে স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হয়। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে প্রবল গতি সঞ্চারিত হয়। জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা এভাবে প্রবাসী সরকার গঠন করে একটি সফল মুক্তিযুুদ্ধ পরিচালনার ইতিহাস বিশ্বে বিরল। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×