ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ৫৩২ শতাংশ

প্রকাশিত: ২২:১৪, ১০ এপ্রিল ২০২১

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ৫৩২ শতাংশ

রহিম শেখ ॥ স্বাধীনতার পর প্রায় এক দশক বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়নের (রিজার্ভ) কোন তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নেই। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের তথ্য সংরক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই অর্থবছরে দেশের মোট রিজার্ভ ছিল মাত্র ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার। এখন সেই রিজার্ভ ৪ হাজার ৪০০ কোটি (৪৪ বিলিয়ন) ডলারের সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করছে। এই সময়ে বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেড়েছে ৫৩২ শতাংশ। রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে এই মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এই রিজার্ভ দিয়ে প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার হিসেবে সাড়ে ১০ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী একটি দেশের কাছে অন্তত ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাকি অর্থের সমপরিমাণ রিজার্ভ দেশের উন্নয়মূলক কর্মকা-ে বিনিয়োগের প্রস্তাব আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এই অবস্থায় রিজার্ভ থেকে সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারাও ঋণ নিতে চান। সরকার ইতোমধ্যে রিজার্ভ থেকে ঋণ দিতে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিআইডিএফ) গঠন করেছে। এ তহবিল থেকে ইতোমধ্যে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে। এছাড়া বেসরকারী উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপ গত সপ্তাহে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে একটি বৈঠকও করেছে। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল। স্বাধীনতার ৫০ বছরে যে কোন দেশের উন্নতি-অবনতি, ভাল-মন্দ বিচারের জন্য অনেক সময়। রিজার্ভের নিরিখেই যদি বিচার করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য। গত মার্চ মাস শেষে পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ২ হাজার কোটি ডলার। একই সময়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তবে স্বাধীনতার পর প্রায় এক দশক বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়নের (রিজার্ভ) কোন তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নেই। হয়তো ওই সময়ে পণ্য রফতানি থেকে তেমন কোন আয় দেশে আসেনি। রেমিটেন্সও আসা শুরু হয়নি; বিদেশী ঋণ-সহায়তাও মেলেনি। তাই রিজার্ভে কোন বিদেশী মুদ্রার মজুদও ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে বিদেশী মুদ্রার মজুদ জমতে শুরু করে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার। পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে ১.৬০ বিলিয়ন ডলারে উঠে। পরের ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষেই রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২.২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২.০৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১.৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করে। ২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১.৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ১.১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। তখনই আকুর বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল। এরপর অবশ্য কখনই রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আসেনি। ২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১.৫৮ বিলিয়ন ডলার। ২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বেড়েই চলেছে অর্থনীতির এই সূচক। ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০২০ সালের গত ৩ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ওই বছরের ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এরপর গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। গত বছরের শেষ দিকে ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রেকর্ড রেমিটেন্সে নতুন উচ্চতায় রিজার্ভ ॥ বিশ্বজুড়ে করোনা সঙ্কটের মধ্যেও বৈধ পথে প্রচুর রেমিটেন্স দেশে আসছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে ১৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। এভাবে রেমিটেন্স বাড়লেও আমদানি দায় পরিশোধের তেমন চাপ নেই। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রচুর ডলার কিনতে হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি থেকে প্রচুর ঋণ আসছে। যে কারণে রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। প্রবাসীদের পাঠানো এই অর্থের উপর ভর করে বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন আবার ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে চলেছে। জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা সঙ্কটের মধ্যেও প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। একই সঙ্গে বিদেশী ঋণ ও অনুদান আসছে। আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় দেশের রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে। তবে রফতানি আয় বাড়ানো সম্ভব না হলে রিজার্ভর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হবে। এর আগে গত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নবেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪২ বিলিরয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। রেমিটেন্স বাড়ায় তিন সপ্তাহের ব্যবধানে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সেই রিজার্ভ বেড়ে আবার ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এই রিজার্ভ দিয়ে প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার হিসেবে সাড়ে ১০ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই ৯ দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। রেমিটেন্স বাড়ার কারণে রিজার্ভ বেড়েছে ঠিক। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রিজার্ভ বাংলাদেশের ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। যা পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর পরিশোধ করতে হয় আকুর বিল। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের খরচ হিসাবে হাতে থাকা রিজার্ভ দিয়ে বর্তমানে সাড়ে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশীর পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স। রিজার্ভ থেকে ঋণ চায় বেসরকারী খাত ॥ সরকার ইতোমধ্যে রিজার্ভ থেকে ঋণ দিতে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিআইডিএফ) গঠন করেছে। এ তহবিল থেকে ইতোমধ্যে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক এখন কাজ করছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে ঋণ দিলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকির আশঙ্কা আছে। সে বিষয়টি এখনও ভেবে দেখা দরকার। চলমান প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যেভাবে ঋণ দেয় সে প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দেয়া উচিত।’ সূত্র জানায়, বিআইডিএফের আওতায় বছরে ২০০ কোটি ডলার বা ১৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা উন্নয়ন প্রকল্প ঋণ দেয়া হবে। এর মধ্যে একটি সরকারী প্রকল্পে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা দেয়ার চুক্তি হয়েছে। বছর হিসাবে ওই তহবিলে আরও ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা থাকবে। ওই অর্থের মধ্যে কিছু অর্থ বেসরকারী খাতের বিশেষ করে সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া বিদ্যুত খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে দেয়ার প্রস্তাব করেছে সংশ্লিষ্ট এ্যাসোসিয়েশন। এ বিষয়ে তারা একটি আবেদন বিদ্যুত ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে করেছে। এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার এ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বলেন, রিজার্ভ থেকে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের ভাল প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন হোক আমরা এটা চাই। তবে এ টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে সেটা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রিজার্ভের অর্থ উদ্যোক্তারা পাবেন সেটি যাতে খুব বেশি শক্তিশালী হয়। এমন প্রক্রিয়া করতে হবে যাতে রাষ্ট্রের টাকা নিয়ে ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ভাল উদ্যোক্তাদের বেছে বেছে ঋণ দিতে হবে। তাহলে খেলাপী হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। কারণ রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার বিষয়টি সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নজরে রাখবে। সূত্র জানায়, এর আগে বেসরকারী খাতের ওরিয়ন গ্রুপের কোম্পানি ওরিয়ন পাওয়ার ইউনিট-২ এর জন্য রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ৯০ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ডলার বা ৭ হাজার ৬১২ কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হয়েছে। ৭ বছর মেয়াদী এ ঋণের সুদের হার প্রস্তাব করা হয়েছে ৪ শতাংশ। সূত্র জানায়, উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপ গত সপ্তাহে সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে তারা রিজার্ভ থেকে ঋণ নিলে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা সুবিধার কথা তুলে ধরেছে। এদিকে আন্তর্জাতিক নিরাপদ মান অনুযায়ী কমপক্ষে ৩ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ রাখতে হয়।
×