অপূর্ব কুমার ॥ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করা করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম রোগীর স্বজনরা। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের অবস্থান এবং হাসপাতাল থেকে বাসভবনে যাতায়াত করা স্বজনদের জন্য ক্লাস্টার সংক্রমণ ঘটছে। ভাইরাসের নতুন ধরনটির অতি সংক্রমণ প্রবণতায় রোগীদের স্বজনদের উদাসীনতাই অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
হাসপাতালগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা অতিমারীর প্রকোপে রাজধানীর হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোভিড হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটেই (আইসিইউ) চলছে করোনা আক্রান্ত মুমুর্ষু রোগীদের চিকিৎসা। এছাড়া সেখানে সাধারণ শয্যাও খালি নেই। এর মধ্যেই রোগীদের স্বজনরাও ভিড় করছেন হাসপাতালগুলোতে। হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারা রোগীদের নিয়ে স্বজনরা ঘুরছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল। সম্প্রতি করোনার প্রকোপ রুখতে সাতদিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। লকডাউনের প্রথম দুদিন গণপরিবহন বন্ধ থাকার পর নগরীতে বুধবার থেকে চলছে সিটিবাস, আজ শুক্রবার থেকে নির্ধারিত সময়ে দোকানপাটও চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই করোনা রোগী ও মৃত্যুর হার বাড়লেও জনসচেতনতা খুব বেশি নেই। বিশেষ করে হাসপাতালে মুমুর্ষু ও সাধারণ রোগীদের আত্মীয় স্বজনের গণপরিবহন ব্যবহার করা এবং যত্রযত্র চলাফেরার কারণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। নিজের পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস্টার সংক্রমণের ঝুঁকিও তারা তৈরি করছেন।
এদিকে জনগণের হাসপাতালগুলোতে ভিড় কমাতে অধিদফতরের পরিচালক ( হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডাঃ ফরিদ হোসেন মিয়া সামান্য সর্দি-জ্বর আর অন্য সাধারণ রোগ নিয়ে রোগীদের হাসপাতালে এসে ভিড় না করার আহবান জানিয়েছেন। তার মতে, এই সময়ে মৃদ্যু উপসর্গের সবাই যেন ফোনেই চিকিৎসা সেবা নেন। তিনি আরও বলেন, তবে যারা একেবারেই ইমার্জেন্সি রোগী, তারা আসবেই। তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। বিশেষ করে করোনা রোগীরা যাদের ভর্তি লাগবে তাদের আসতেই হবে। তাদের ঘরে বসে থাকা যাবে না। সর্বক্ষণিক টেলিমেডিসিন সেবা চালু থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য বাতায়ন চালু আছে। সব হাসপাতালেই টেলিমেডিসিন সেবা চালু আছে। এই সময়ে ইমার্জেন্সি না হলে হাসপাতালে না আসাই ভাল। ফরিদ মিয়া বলেন, লকডাউন দেয়াতে বরং ইমার্জেন্সি রোগীদের জন্য সুবিধা হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্যও সুবিধা হবে। কারণ রোগীদের সঙ্গে যে সংখ্যক উপস্থিতি থাকে, তা কমে আসবে। এতে আমাদের চিকিৎসক-নার্সদের সেবা কার্যক্রমে সুবিধা হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘটছে উল্টো। কোনভাবেই সামান্য উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা বন্ধ তো হচ্ছেই না উল্টো রোগীর সঙ্গে স্বজনরাও ভিড় করছেন হাসপাতাল ও হাসপাতালের বাইরে। এর আগে সরকার করোনা রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকল্পে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় রাজধানীর ১০টি সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেভ হাসপাতাল ঘোষণা করে। হাসপাতালগুলো হলো - রাজধানীর উত্তরার কুয়েত মৈত্রী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ২৫০ শয্যার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার, সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল ফুলবাড়িয়া, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ এবং মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে এ হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য দুই হাজার ৩৮১টি সাধারণ শয্যা ও ১০টি হাসপাতালের আটটিতে সর্বসাকুল্যে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১০৩টি। এছাড়া বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও সাধারণ শয্যায় চিকিৎসা চলছে করোনা রোগীদের। এছাড়া করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য প্রতিদিনই হাজার হাজার রোগী সামাজিক দূরত্ব না মেনেই লাইনে থাকছেন। এর মধ্যে মাত্র ৩০০ জনের মতো করোনা পরীক্ষার টিকেট পাচ্ছেন। বাকিরা ফিরে যাচ্ছেন। যারা ফিরে যাচ্ছেন পরীক্ষা না করে তারা কোন না কোন যানবাহন ব্যবহার করছেন। পরীক্ষা করানোর আগেই তারা আশপাশের মানুষকে সংক্রমণ ঘটাচ্ছেন।
রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর অন্যতম হচ্ছে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা জেনারেল হাসপাতাল। সেখানে করোনার পরীক্ষার টিকাকরণ, নতুন রোগী শনাক্তে করোনা পরীক্ষা এবং করোনা রোগীর চিকিৎসা চলছে সমানতালে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল সাতটা থেকে সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে করোনা শনাক্তের টিকেট সংগ্রহের জন্য। সেখানে কোন রকম সামাজিক দূরত্ব না মেনেই তারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। একইভাবে করোনা চিকিৎসা সাধারণ শয্যা এবং আইসিইউতে রোগী কানায় কানায় ভর্তি। করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের জন্য আইসিইউ ও সাধারণ শয্যায় প্রতিটি রোগীর সঙ্গে আত্মীয় স্বজন রয়েছেন। সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলেও স্বজনরা রোগীদের দেখভালের জন্য এবার বেশি ভিড় করছেন। রোগীদের পরিদর্শন শেষে তারা ফের সিএনজি, রিক্সা ও বাসযোগে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছেন। নিজের রোগীদের কথা চিন্তা করে তারা হাসপাতালগুলোতে রোগীদের সঙ্গে থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্য মানুষ থেকে নিজেদের দূরে রাখছেন না। এতে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলেও স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপউপাচার্য প্রফেসর ডাঃ রশীদ ই মাহবুব বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের যে ধরনটি বেশি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে সেটি আগের চেয়ে বেশি সংক্রামক। এই কারণে রোগীর পাশাপাশি রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে নিজেকে অন্যদের থেকে দূরে রেখে চিকিৎসা করা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ আবদুল হামিদ জানান, করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত নির্দেশনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে কিছু কাজ করতে হবে। সরকার ঘোষিত এক সপ্তাহের লকডাউন ঠিক হয়েছে কী হয়নি সেদিকে না গিয়ে তিনি বলেন, সরকার ঘোষিত কর্মসূচী বাস্তবায়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: