মাঝে মাঝে মনে হয়
এ জীবন আমার নয়
অন্য কাহারও জীবন
আমি করিতেছি বহন।
চন্দন মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে। শহর ছেড়ে গ্রামের পথে সে কোথাও যাচ্ছে। সবকিছু চেনা মনে হয়, অথচ চেনা নয়। যে পথ দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে, বহু বছর ধরে এ পথে তাঁর যাতায়াত ছিল। কত শত বছর আগে একদিন এ পথে সে হেঁটেছে। আজ মনে করতে পারে না। শেওলা ধরে গেছে। ছায়া নেমেছে। কিছু দূর গেলে স্কুল পড়বে। স্কুলের পর প্রাচীন বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের ছায়ায় এসে চন্দন দুদণ্ড দাঁড়াল। বিষ্ময়ে বট গাছটিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। এমন সময় স্নিগ্ধ হাওয়া বইল। তাঁর মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। আনন্দের দোলা লাগল। তাঁর মনে হল বট গাছটি তাঁকে চিনতে পেরেছে। ছায়ার মতো মনে পড়ে, এই বটবৃক্ষের স্নিগ্ধ ছায়ায় অনেক কাল আগে সে নিদ্রা দিয়েছে। আজও তাঁর ঘুমাতে ইচ্ছে করল। বট গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে চন্দন আরাম করে পা মেলে বসলো। ছাতা মাথায় একজন প্রৌঢ় পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, চন্দনকে দেখে কৌতূহলে এগিয়ে এলেন।
আপনাকে এ অঞ্চলে নতুন মনে হচ্ছে। আমি এই হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক। হরিপদ পাল।
চন্দন উঠে দাঁড়াল, এখন নতুন। এক সময় এই স্কুলে অনেক অনেক বছর আগে আমি পড়েছি। সে কত বছর আগে আমার মনে নেই।
দেড়শ বছরের পুরনো স্কুল, সে তো হতেই পারে। তা আপনি যাবেন কোথায়, কোন গ্রাম?
মনে হয় আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। এই বট গাছ পর্যন্ত আমি আসতে পারি। তারপর মনে পড়ে না। কোনদিকে যাবো, কোথায় পৌঁছাবো।
গ্রামের নাম বলেন। আমি আপনাকে পথ বলে দিচ্ছি।
গ্রামের নাম মনে নেই। গ্রামের পাশে নদী। নদীর নাম মনে আছে। সেই নদীতে সাঁতার কেটেছি। মাছ ধরেছি।
নদীর নাম কি?
জলসিঁড়ি।
এ নামে অত্র অঞ্চলে কোন নদী নেই। বাংলার শিক্ষক হরিপদ পালকে চিন্তিত দেখায়। নামটি পরিচিত লাগছে কেন? আগেও কোথায় শুনেছি যেন...। ও হো, ধানসিঁড়ি নদী। এ তো কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতার নদী।
চন্দন উৎফুল্লহয়ে বলল, মনে পড়েছে। ধানসিঁড়ি নদী ঘেসে জলসিঁড়ি গ্রাম। আমি ওই গ্রামে যাব।
আরে দাদা, ওই নদী গ্রাম কবিতার বইয়ে আছে। ওখানে যাবার কোন রাস্তা আমার জানা নেই।
চন্দন ব্যাকুল হয়ে বলল, একটা জীবন আমি জলসিঁড়ি গ্রামে কাটিয়েছি। সেখানে আমাকে যেতে হবে।
হরিপদ তীক্ষè দৃষ্টিতে চন্দনকে দেখতে লাগলো। কৌতুকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি কবি জীবনানন্দ দাস? আবার আসিবো ফিরে এই বাংলায়...। আপনি কি ফিরে এসেছেন? হরিপদ সশব্দে হেসে উঠলো। সে হাসি ক্রমশ অট্টহাসিতে পরিণত হলো। চন্দন দু’হাতে কান চেপে ধরে সভয়ে চিৎকার করতে লাগলো।
মাধবী ঘুম থেকে জেগে উঠে চন্দনকে ধাক্কাতে লাগলো, এই... এই... কী হয়েছে?
চন্দন উঠে বসলো। অচেনা চোখে মাধবীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
দুঃস্বপ্ন দেখেছো?
চন্দন মাথা ঝাঁকাল। বলল, পানি। এক চুমুকে চন্দন গ্লাসের সবটুকু পানি খেয়ে ফেললো। মাধবী চন্দনের কপালে হাত রাখলো। ঠাণ্ডায় এত ঘামছো কেন? জামাটা খুলে ফেল। তোয়ালে এনে মাধবী ঘাম মুছে দিচ্ছে, চন্দন বাধা দিয়ে বলল, দাও, আমাকে দাও।
মাধবী তোয়ালে সরিয়ে নিয়ে বলল, আমি তোমার কে?
চন্দন মৃদু হেসে বলল, কেন, আমার বিয়ে করা বৌ।
ঘুম ভেঙে আমার দিকে এমন ভাবে তাকালে যেন আমাকে চেনো না। ঘাম মুছে দেবো তাতেও বাঁধা।
আচ্ছা দাও।
ফ্যানটা ছেড়ে দেই?
তোমার ঠাণ্ডা লাগবে।
তুমি যে ঘামছো। আমি কাঁথা গায়ে শোব।
চোখ প্রায় লেগে এসেছে, চাপা ফোঁস ফোঁস শব্দে চন্দন সজাগ হলো। মাধবীর শরীর কাঁপছে। চন্দনের বিপরীতমুখী শুয়ে আছে। চন্দন কাছে এসে শরীরে হাত রেখে বলল, কী হয়েছে?
কিছু হয়নি।
কাঁদছো কেন?
মাধবীর শরীরের কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। বালিশে মুখ গুঁজে রেখেছে। অদ্ভুত এক শব্দ হচ্ছে। চন্দন জোর করে মাধবীকে তার দিকে ফেরালো। মাধবী চন্দনের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
আহ্ মাধবী, এমন করো কেন? মাঝে মাঝে তোমার কী হয়?
ভয় হয়।
কিসের ভয়?
আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাবে।
আবার সেই পাগলামি। আমার মুখের দিকে তাকাও। বলো, আমি কোথায় যাবো? কেন যাবো? তুমি জানো সাতকুলে আমার কেউ নেই। তুমি আমার শেষ আশ্রয়।
চন্দন মাধবীর চোখের জল মুছে দিলো। মাধবী বলল, দশ বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি তোমাকে সুখী করতে পারিনি। আমি কোনদিন তোমাকে সন্তান দিতে পারবো না।
চন্দন মাধবীকে বুকে আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলল, আমাদের সন্তান নেই তো কী হয়েছে। তুমি আছো আমি আছি। আমি তোমার বাবু। তুমি আমার বাবুনি। মৃত্যু ছাড়া আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। বুঝেছো বাবুনি। চন্দনের চোখ ভিজে উঠলো।
সাইক্রিয়াস্টিক ডাক্তার লুবনা জাহান মাধবীর খালাতো বোন। সকাল সকাল তাকে ফোন করলো মাধবী। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, চন্দন গত রাতে স্বপ্নটা আবার দেখেছে। ওষুধে কি কাজ করছে না? সন্ধ্যায় চন্দনকে নিয়ে তোমার চেম্বারে আসি।
লুবনা বলল, হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ। ওই ওষুধ খেলে কখন সকাল হয় তাই টের পাওয়া যায় না। স্বপ্ন দেখবে কোন ফাঁকে? খোঁজ নিয়ে দেখো, চন্দন ভাই ওষুধ ঠিক মতো খাচ্ছে কিনা।
বেড সাইড ড্রয়ার টেনে ওষুধ গুণে দেখা গেল চন্দন সাতটা ট্যাবলেট কম খেয়েছে। মাধবীর মনে আতংক দেখা দিলো। এক সঙ্গে এতগুলো ওষুধ রাখা কি ঠিক?
লুবনাকে আবার ফোন করলো, তোমার অনুমান সঠিক। চন্দন সাত দিন ওষুধ খায়নি। আচ্ছা, কয়টা ট্যাবলেট এক সঙ্গে খেলে মানুষ মারা যায়?
কেন, মরবার সখ হয়েছে? ফাইলের সব কটা এক সঙ্গে খেলেও মরবে না। পাগল হয়ে যাবে। পাগলা গারদে থাকতে হবে।
মাধবী ওষুধের কৌটাটি তাঁর আলমারি ড্রয়ারে রেখে লক করে রাখলো। এখন থেকে সে নিজে চন্দনকে ঘুমের ওষুধ খাওয়াবে।
রাতের খাওয়া শেষে ঘুমানোর আধ- ঘণ্টা আগে মাধবী ওষুধ ও পানির গ্লাস হাতে চন্দনের কাছে এসে দাঁড়াল। চন্দন মাধবীর সামনে ওষুধ খেয়ে মৃদু হেসে গ্লাসটা ফেরত দিলো। পাঁচ মাস নির্বিঘ্নে কাটলো। ষষ্ঠ মাসের সপ্তম দিনে চন্দন ঘুমের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেল সেই বট গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। বড় রাস্তাটি বটগাছ ছাড়িয়ে সোজা দূরে বহুদূরে চলে গেছে। বটগাছ ঘেঁষে বাঁদিকে একটি সড়ক চলে গেছে গ্রামের ভেতর। বিশ গজ এগিয়ে ডানদিকে আরেকটি সড়ক চলে গেছে। চন্দনকে বিভ্রান্ত দেখায়। এই বটগাছ পর্যন্ত সে আসতে পারে। তারপর পথ হারিয়ে ফেলে। তাঁর মধ্যে ঠিকানায় পৌঁছাবার তীব্র ব্যকুলতা। কী ভাবে সে পৌঁছাবে? এখন সে কোনদিকে যাবে? ওখানে পৌঁছাতে না পারলে তাঁর যে মুক্তি নেই।
দইয়ের ঘড়া কাঁধে একজন প্রবীণ ঘোষ এগিয়ে আসছে। ঘড়ার ওজনে কাঁধের লাঠি বেঁকে গেছে। লোকটির পিঠও কুঁজো হয়ে আছে। কাছে আসা মাত্র চন্দন ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।
দইয়লা বটগাছের ছায়ায় তাঁর দইয়ের ঘড়া কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখলো। মাথার গামছা খুলে মুখের ঘাম মুছে জিজ্ঞেস করলো, কোন গ্রাম?
জলসিঁড়ি গ্রাম। ধানসিঁড়ি নদীর ধারে।
অ... চিনেছি। সে তো বাম দিকের পথ ধরে মাইলটাক এগুলে পেয়ে যাবেন। কোন বাড়ি যাবেন?
চন্দনের হঠাৎ আনন্দ দপ করে নিভে গেল। কোন বাড়ি? অপ্রস্তুত হয়ে বোকার মতো দইয়লার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
দুইয়লা চন্দনকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল, তাইতো বলি, চেনা চেনা কেন লাগছে। বাবু, আপনি মজুমদার বাড়ির জামাই। ঠিক ধরেছি তো?
চন্দন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।
বিগলিত হেসে দইয়লা বলল, বাবু, আপনার বিবাহের মিষ্টি দই সব আমার হাতে তৈরি। বাড়ি ফিরে বলবেন যতিন ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। দেখবেন বাড়ির লোকেরা কি বলে। চলি বাবু।
চন্দন কিছুক্ষণ স্হানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকল। যতিন ঘোষ দৃষ্টির আড়াল হলে সে বাঁ- দিকের পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। অনেকটা পথ হাঁটার পর গাছগাছালি ঘেরা একতলা একটি পুরনো দালান বাড়ি দেখে চন্দন থমকে দাঁড়ালো। এর আগে বাড়িটি সে কোথাও দেখেছে। পুরানো ভাঙা দালান। প্রশস্ত উঠোন। শেওলা ধরা শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। পুকুরের চারধারে নারিকেল সুপারি গাছ। পুকুরটাকে ছায়াময় স্নিগ্ধ শীতল করে রেখেছে। ঘাটের দুপাশ ঘিরে বসার জায়গা। কোন কালে দেখেছে এখনো তেমনি আছে। কী আশ্চর্য, কোন পরিবর্তন হয়নি! এই ঘাটে বসে অনেক পূর্ণিমার রাত কেটেছে। তনু গাইছে, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...’। চন্দনের মনে হলো এখনো সেই জ্যোৎস্না রাতের গান এই তপ্ত দুপুরে ঘাট থেকে ভেসে আসছে। চন্দন ব্যাকুল নয়নে পুকুর ঘাটে খুঁজতে লাগলো গায়িকা সেই রমনিকে।
পুকুর ঘাটে এক বধূ থালা-বাটি মাজছিল। তাঁদের বাড়ির সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে কৌতুহলের সঙ্গে দেখছিল। মানুষটি এ গায়ের নয় হাব ভাবে বুঝা যাচ্ছে। কাউকে খুঁজছে বোধহয়। যেই ঘাটের দিকে লোকটি মুখ ফিরিয়েছে বধূ চমকে উঠলো। দ্রুত হাতে ঘোমটা টেনে দিলো। বধূর মনে ভূমিকম্প হচ্ছে। সে স্থির থাকতে পারছে না। থালা গ্লাস পুকুর ঘাটে রেখে সে দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। দেহের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পালঙ্ক ধরে দাঁড়ালো। চোখের জল বাঁধ মানছে না। সাত বছরের শ্যামা অবাক চোখে বলল, মা, তোমার কী হয়েছে! কাঁদছো কেন?
আনন্দে কাঁদছি রে মা। ভগবান আমার প্রার্থনা শুনেছেন। তোর বাবা ফিরে এসেছেন।
শ্যামা আনন্দ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো, কোথায়?
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে নিয়ে আয়।
শ্যামা ছুটে বাইরে এলো। চন্দন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে তাকিয়ে দ্বিধায় দুলছে। শ্যামার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো, চিনতে পারলো না। শ্যামা পাখির মতো উড়ে এলো, বাবা... বাবা কিচির মিচির ডাকে। চন্দনের হাত ধরে বলল, বাবা, এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? মা বলে, তুমি হারিয়ে গেছো। আমি প্রতিদিন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছি, বাবাকে ফিরে দাও ভগবান। আজ তুমি ফিরে এসেছো।
চন্দন বিব্রত হয়ে বলল, তুমি ভুল করছো খুকুমণি। আমি তোমার বাবা নই। আমি তোমাকে চিনি না।
তনু এরই মধ্যে শাড়ি পাল্টিয়েছে। সিঁথির সিঁদুর নতুন করে পরেছে। চোখে কাজল টেনেছে। চন্দনের কথা শুনে ছুটে ঘরের বাইরে এলো। মাথার ঘোমটা খুলে গেছে। শাড়ির আঁচল ধুলায় গড়াচ্ছে। চন্দনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যাকুল নয়ন তুলে তাকাল।
চন্দন চোখ সরিয়ে বলল, আপনার মেয়ে?
তনু কান্না আটকে বলল, হা।
ওর বাবা হারিয়ে গেছে?
মেয়েটি ওর বাবাকে দেখেনি। ওর বাবাও তাঁর মেয়েকে দেখেনি। তাই ওরা চিনতে পারছে না।
চন্দন বলল, একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন, এই বাড়িটাকে আমার চেনা চেনা লাগছে। আচ্ছা, এই বাড়িটা কি মজুমদার বাড়ি?
হা, আপনি মজুমদার বাড়ি এসেছেন।
গ্রামের নাম?
জলসিঁড়ি।
ধানসিঁড়ি নদীটি কোথায়?
গ্রামের শেষ মাথায়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। তারপর ধানসিঁড়ি নদী ঘুরে আসবেন। পুকুর ঘাটে স্নিগ্ধ ছায়ায় চন্দন বসলো। নির্মল শীতল বায়ুর পরশে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। তনু বলল, পূর্ণিমার রাতে এই পুকুর ঘাট অন্য রকম লাগে। পূর্ণিমার চাঁদ পুকুরের জলে ভাসে। জ্যোৎস্নায় পুকুর ঘাটে আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত বসে থাকি।
চন্দন ঘোরের মধ্যে বলল, এমন সময় ভেসে আসে সেই গান। ধরা দেয়। ধরা দেয় না। স্বপ্নে অচেতনে আমি তার পিছু পিছু ছুটি। খুঁজে মরি।
তনু পেছন ফিরে পুকুরের জলে আলো ছায়ায় তাকিয়ে রইলো। ভেসে এলো সুরেলা নারী কণ্ঠে, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...।
চন্দন চমকে উঠে, এইতো সেই গান, সেই কণ্ঠ! কে গাইলো?
তনু মুখ ঘুরিয়ে চন্দনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাঁর সজল চোখে জল টলমল করছে। মৃদু স্বরে বলল, আমি।
তুমি কে?
আমি তরুলতা মজুমদার। তোমার স্ত্রী।
আর ওই মেয়েটা?
আমাদের মেয়ে। শ্যামা। লক্ষ্য করছো শ্যামা অবিকল তোমার মতো দেখতে হয়েছে। তোমার মতো কোঁকড়া চুল, টিকালো নাক। গায়ের রঙটাও তোমার মতো শ্যামল বরণ। আমার মতো গৌরবর্ণ নয়।
এতসব হলো কখন? আমি শ্যামাকে কখনো দেখিনি।
এক পূর্ণিমা রাতে আমরা পুকুর ঘাট থেকে ঘরে ফিরছি। আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা। আমি পা পিছলে পড়ে যাই। আমার ব্লিডিং হচ্ছিল। তুমি পাগলের মত ডাক্তারের খোঁজে বেরিয়ে গেলে। সেই যে গেলে আর ফিরে এলে না। আট বছর পর ভগবান তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
আমি কে?
তুমি চন্দন মজুমদার। আমার স্বামী। শ্যামার বাবা।
শ্যামা ছুটে এসে চন্দনকে জড়িয়ে ধরলো, বাবা... বাবা... বাবা...।
চন্দন দু’হাতে শ্যামার মুখখানি ধরে নিঃষ্পলক নয়নে তাকিয়ে রইলো। চন্দনের মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল।
শ্যামা... শ্যামা...।
নাস্তার টেবিলে মাধবী জিজ্ঞেস করলো, শ্যামা কে?
চন্দন বলল, কে জানে!
তুমি ঘুমের ঘোরে বার বার শ্যামা শ্যামা করছিলে, তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভাবলাম তোমার নতুন কোন বান্ধবী কি না?
চন্দন শব্দ করে হাসলো, শ্যামা সাত বছরের একটি ছোট মেয়ে। স্বপ্নে মাঝে মধ্যে দেখা হয়।
মাধবীর মুখ ম্লান হয়ে গেল। চন্দনের পিতৃ হৃদয়ের আকাঙ্খা সে পূরণ করতে পারেনি।
সন্ধ্যার পর মাধবীকে নিয়ে চন্দন ঈদের কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে। এ দোকান সে দোকান ঘুরে মাধবী খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লো। দুজনের হাতে শপিং ব্যাগ। ট্যাক্সির জন্য চন্দন হন্যে হয়ে পড়ে। ধরতে পারে না।
মাধবী বলল, আর যে হাঁটতে পারছি না।
চন্দন বলল, তুমি এখানটায় দাঁড়াও। আমি রাস্তা পার হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে আসি।
রাস্তা পার হয়ে ট্যাক্সির খোঁজে চন্দন বেশ কিছুটা পথ চলে এসেছে। ট্যাক্সি না পেয়ে চন্দন খুব অস্থির হয়ে পড়ছে। রাস্তায় একটা জটলা। কান্নাকাটি শোনা যাচ্ছে। চন্দন কৌতুহলে মুখ বাড়ালো। একটি ছোট মেয়ে এসে চন্দনের হাত ধরলো।
একি শ্যামা! কাঁদছো কেন?
মা জ্ঞান হারিয়েছে।
ভিড় ঠেলে চন্দন সামনে গেল। লোকজনের ভিড় দেখে ক্ষেপে গেল, একজন মানুষ মরতে বসেছে, আপনারা ভিড় করে দেখছেন কী? প্লিজ, একটা ট্যাক্সি ডাকুন।
ট্যাক্সিতে চন্দনের কাঁধে মাথা এলিয়ে বসেছে তরুলতা। চন্দন তাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। অন্য পাশে বসেছে শ্যামা।
শ্যামা বলল, বাবা, তুমি আমাদের চিনতে পেরেছো?
চন্দন হেসে বলল, বলে কি পাগলি মেয়ে। তুমি আমার শ্যামা। আমার মা- জননী। আমি তোমার ছেলে।
বলতো আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ধানসিঁড়ি নদীর ধারে জলসিঁড়ি গ্রামে। আমাদের বাড়িতে। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় আমরা পুকুর ঘাটে গান শুনবো...
তরুর চোখ বেয়ে জল পড়ছে। সে মৃদুস্বরে গাইলো, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে....
দশ বছর হয় মাধবীর স্বামী চন্দন নিখোঁজ হয়েছে। থানা - পুলিশ, হাসপাতাল -মর্গ, পত্রিকা টিভি নানা খোঁজ খবর করেও জীবিত অথবা মৃত চন্দনকে পাওয়া যায়নি। মাধবী আর বিয়ে করেনি। সে চন্দনের অপেক্ষায় আছে। সে বিশ্বাস করে তাঁর চন্দন একদিন ফিরে আসবে।