ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আশরাফ জামান

হোমারের একিলিস চরিত্র

প্রকাশিত: ২০:১২, ৯ এপ্রিল ২০২১

হোমারের একিলিস চরিত্র

॥ এক ॥ একিলিসের ক্রোধ নিয়ে ইলিয়ডের শুরু ও সমাপ্তি। হোমার ছিলেন মানব চরিত্র বিশ্লেষণে সুনিপুণ কারিগর। একিলিস চরিত্রকে সত্যিকার বীর হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন তিনি। একিলিসের দৃঢ় এবং আত্মপ্রত্যয়ী মন আছে। অবশ্য ক্রোধ তাকে সবসময় আত্মপ্রত্যয়ী থাকতে দেয়নি। আত্মসম্মানবোধ হলো তা চরিত্রের একটি বড় রূপরেখা। আগামেমনন যুদ্ধ বন্দিনী ক্রিমিসকে একিলিসের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে নিয়ে গেছে। যার জন্য সে একিয়ান পক্ষে যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকে। একিলিস বীর শ্রেষ্ঠ। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তান যে ঘৃণা করে আবার ব্যক্তিগত ক্রোধের জন্য যোগ দিতেও পারছে না। সে বলেছে, একিয়ানদের পরাজয় কামনা করে দেবতার কাছে প্রার্থনা করার জন্য। মনে মনে ক্রোধকে লালন করে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সে। তার চরিত্রে এই প্রথম দ্বন্দ্ব বাধে। একিলিস গর্বিত নিজেকে নিয়ে। তার বিশ্বাস সে ছাড়া ট্রোজানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করার মতো একিয়ানদের কেউ নেই। বীর হলেও বীরধর্মবিরোধী প্রতিজ্ঞা করে। আগামেমনন তাকে অপমান করেছে যা তার মতো লোক সইতে পারে না। একিয়ানদের ক্রমান্বয়ে সমূহ পতনের আশঙ্কায় ‘আগামেমননের ভ্রান্তিমোচন হয়। সে বুঝতে পারে এ যুদ্ধে জয়ী হতে হলে একিলিসের প্রয়োজন। নিজের ভুল স্বীকার করে বিসিসকে ফেরত দেয়ার চুক্তি করে তাকে যুদ্ধে ডাকল। এ ছাড়া শান্তির প্রস্তাব করে ট্রোজান মেয়েদের কুড়িজনকে এবং আর্গসে ফিরে গিয়ে তার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দান করে। এ ছাড়া আগামেমনন, কার্ডামাইল, ইনোপ, হায়াব কোবে, এন্থিয়া, এপিয়া ও পোতাসাস নামে সাতটি শহর তাকে দিতে চাইল। আগামেমননের শান্তি প্রস্তাবকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করল একিলিস। দণ্ডিত একিলিস আগামেমননের দেয়া প্রস্তাব ওসিসাস এসে জানালে তাকে বলেছে ‘আগামেমনন বা অবশিষ্ট দালালরা আমাকে জয় করতে পারবে না। কারণ আগামেমননের প্রতি একিলিসের ক্রোধ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে ওডিসাসের কাছে তার বক্তব্য পেশকালে। আগামেমননের দান সম্পর্কে বলেছে, ‘তার দান সম্পর্কে আমার বক্তব্য হচ্ছে যেমন লোকটিকে তেমনি তাঁর দানকেও আমি ঘৃণা করি। এর দশগুণ, বিশগুণ তার সর্বস্ব শুধু তাই নয়, ওর্চোমেনাস, থিবস, মিসরীয় থিবস প্রভৃতি রাজ্যের যেখানে ঘরের পর ঘর বোঝাই হয়ে আছে নানা শ্রেণীর ধনদৌলত আর এদের একশত দরজায় প্রতি দরজা দিয়ে ব্যস্তভাবে আনাগোনা করে অশ্বারোহী ও পথচারী দুইশত যোদ্ধা তাদের সমস্ত রাজস্ব এমনকি তার দান যদি সমস্ত শস্য বা ধূলিকণার সমানও হয়। তবু আগামেমনন আমাকে জয় করতে পারবেন না। যে তিক্ত অপমান আমি সয়েছি প্রথমে সেই অপমানের স্বাদ বাস্তবে তাঁকে পেতেই হবে। ॥ দুই ॥ বন্ধু প্যাট্রো ক্লাসবীর। তাই সে স্বজাতির বিপর্যয়ে বসে থাকতে পারেনি। বন্ধু একিলিসের কাছে যুদ্ধ যাত্রার জন্য অনুমতি চেয়েছে। একিলিস তাকে অবশেষে যুদ্ধ যাত্রার অনুমতি দিয়েছে। অবশেষে মনে মনে একিলিসদের পক্ষকেই সমর্থন করে আসছে। প্যাট্রোক্লাসের মাধ্যমে তার অন্তরজাত আকাক্সক্ষাই রূপায়িত হয়েছে। প্যাট্রোক্লাসের যুদ্ধে অংশগ্রহণ তার যুদ্ধে যোগদানের ইচ্ছার বহির্প্রকাশ মাত্র। বন্ধু প্রাণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসেনি তাই ট্রোজানদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে একিলিস। মুহূর্তে প্রতিহিংসার দাবানল জ্বলে উঠেছে তার মধ্যে। প্যাট্রোক্লাস তার হৃদয়ের মণিকোঠা। তাকে হারিয়ে বাঁচা যায় না। এতে তার সম্মান কমেছে। বন্ধু হত্যাকারী হেক্টরের প্রতি ক্রোধ তীব্র হয়ে উঠেছে একিলিসের। যুদ্ধে যাত্রাকালে ঘোড়া জান্থাস একিলিসকে নিয়তি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে কিন্তু তাতে ভীত হয়নি বীর। হেক্টরের মৃত্যুর পর তার মৃত্যু হবে জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়েছে শত্রুর মোকাবেলা করতে। ক্রোধ দীপ্ত একিলিস বলেছে, ‘আমি এক্ষুনি ছুটে গিয়ে আমার প্রিয়তম বন্ধুর হত্যাকারী হেক্টরকে খুঁজে বার করব। আমার মৃত্যুর জন্য চিন্তা নেইা। কারণ জিউস ও অন্যান্য অমর দেবতারা যখন তা নির্দিষ্ট করেই রেখেছেন তখন তা ঘটতে দেয়াই উচিত। ॥ তিন ॥ একিলিস বীর কিন্তু মহৎ নয়। সে হিংস্র, ক্ষমাশীল নয়। শত্রুকে ক্ষমা করতে জানে না সে। হেক্টরকে ক্ষমা করেনি একিলিস। নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তার মৃতদেহের অবমাননা করেছে। অমানুষের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছে প্রতিশোধ স্পৃহায়। বারজন ট্রোজন যুবককে হত্যা করে বন্ধু প্যাট্রোক্লাসের চিতায় উৎসর্গ করেছে। হেক্টর পথ যাত্রাকালে একিলিসকে বলেছে ‘তোমাকে আমি ভাল করেই চিনতে পেরেছি। আর তোমার ভাষাও আমি পড়তে পেরেছি। লৌহ কঠিন তোমার হৃদয়। একিলিসের এই যে হিংস্রতা এবং নির্দয়তার মাঝেও একটা হৃদয় তার ছিল। পাথরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঝর্ণাধারার মতো তার তার সে হৃদয়টা সর্বদা সুপ্ত থাকতে তাই হয়ত সহজে দৃষ্ট হয় না। ব্রিসিসকে ভালবাসত একিলিস। ওডিসামকে ব্রিসিস সম্পর্কে তাই বলেছে ‘বর্শার জোরে বন্দিনী করলেও আমিও মেয়েটিকে ভালবেসে ছিলাম।’ হেক্টরের মৃত্যুর পর তার বৃদ্ধ পিতা প্রিয়াসের সাথে একিলিস যে ব্যবহার করেছে তা থেকে তার হৃদয়ের সুন্দর দিকটি উদ্ঘাটিত হয়েছে, তখন আর আমরা তাকে হিংস্র ও নির্দয় বলতে পারি না। তার মধ্যে যেন একটা যথার্থ মানবতাবোধের পরিচয় পাই।
×