ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির খপ্পরে হেফাজত

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ৮ এপ্রিল ২০২১

স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির খপ্পরে হেফাজত

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে মাওলানা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মাওলানা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তার গড়া এ সংগঠনটির নেতৃত্ব জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিএনপির সহযোগিতায় ছিনতাই হয়ে গেছে। ছিনতাইকারীরা সকলেই হাইব্রিড এবং কথিত নেতা। এদের হাতে হেফাজত এখন জিম্মি হয়ে আছে। হেফাজতের বর্তমান এ নেতৃত্ব মূল লক্ষ্যভ্রষ্ট, নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত। এরা মূলত স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত শিবির চক্র এবং জঙ্গীবাদের সমর্থকদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করতে তৎপর। ফলে হেফাজতের সমর্থক এবং এ সংগঠনের অরাজনৈতিক কার্যক্রম সমর্থন করে এমন লাখ লাখ কওমি মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক এবং দেশের আলেম ওলামা ও তৌহিদী জনতা বর্তমানে চরম এক বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। এতে করে সংগঠনের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। সংগঠনের মূল আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যের বিপরীতে যারা কাজ করছে তাদের অতি দ্রুত বহিষ্কার করতে হবে। মূল ভাবধারার নেতৃত্বে সংগঠনকে পুনর্গঠন করতে হবে। অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এর কার্যক্রম বাস্তবায়নের ধারায় এগোতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই এবং এ নিয়ে কোন বিভক্তিও থাকতে পারে না। হেফাজত সরকারবিরোধী কোন ধরনের তৎপরতার সঙ্গে লিপ্ত হতে পারে না। শুধুমাত্র পবিত্র ইসলামের নীতি আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ^াসী। সম্প্রতি হেফাজত নেতা (বাবুনগরী গ্রুপ) যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হকের নারীঘটিত অসামাজিক কর্মকা- এবং রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা, হাইব্রিড নেতাদের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাংচুর ও ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী কওমি মাদ্রাসার লাখ লাখ ছাত্র শিক্ষক এবং দেশের আলেম ওলামা সমাজের মুখে চুন কালি দিয়েছে। বুধবার বিকেলে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপে পরিষ্কারভাবে সুনির্দিষ্ট এসব বক্তব্য দিয়েছেন হেফাজতের শফী গ্রুপের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহী। তিনি এ গ্রুপের যুগ্ম-মহাসচিব। এ পদে এখনও বহাল বলে দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, জামায়াত-শিবির এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতায় হেফাজতের নেতৃত্ব ছিনতাই হলেও প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর সমর্থকরা পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। সংগঠনে আসল নেতৃত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠায় আগামী রমজানের পর জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে উচ্ছৃঙ্খল ঘটনাবলী এবং মামুনুলের পরকীয়ার কারণে বর্তমান সরকার এখনও কেন এ্যাকশনে যায়নি তা নিয়ে দেশের লাখ লাখ হেফাজত সমর্থক ও আলেম ওলামাদের মাঝে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অতি সম্প্রতি সংসদে দাঁড়িয়ে মামুনুলের নারী কেলেঙ্কারি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে উচ্ছৃঙ্খল কর্মকা-ের ব্যাপারে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মামুনুলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত সেই নারীর পরিচয়ও উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া জান্নাত আরা ঝর্ণা নামের সেই নারীর পুত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিষ্কার করেছেন কীভাবে মামুনুল তার মা’র (ঝর্ণা) সংসার ভেঙ্গেছেন এবং কীভাবে মামুনুলের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি। এসব বক্তব্যের পর রাষ্ট্রীয় আইনে মামুনুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, যেহেতু বর্তমান হেফাজত নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতাবিরোধী এবং জামায়াত-শিবির চক্রের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে সেটি মাওলানা আহমদ শফীর সমর্থিত লাখ লাখ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র ও আলেম-ওলামার কাছে স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার। তিনি আরও বলেন, হেফাজত প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে যারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল না তারাই এখন হেফাজতের কর্ণধার। মূলত এরা হাইব্রিড। শফীবিরোধী গ্রুপ হিসেবে জুনায়েদ বাবুনগরী নিজেই এদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। তিনি আরও দাবি করেছেন, মামুনুল এবং তার সমর্থক নেতাদের অবিলম্বে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। শফীর মৃত্যুর পর নিজেদের মনগড়া একটি কমিটি করে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের ২৪ নায়েবে আমির, ৬ যুগ্ম-মহাসচিবসহ বিভিন্ন পদের অনেককে বাদ দেয়ার ঘটনাটি এ সংগঠনের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়ের রচনা করেছে। টেলিফোনে একান্ত সাক্ষাতকারে মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহী আরও বলেন, হেফাজতকে পুনর্গঠন করার সময় এসেছে। অবৈধ কাউন্সিলের মাধ্যমে যারা নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন তাদের বহিষ্কার করা হবে। মাওলানা মামুনুলের নারী কেলেঙ্কারি ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ঝর্ণা নামের সেই মহিলা যদি আসলেই তার স্ত্রী হয়ে থাকে তা প্রমাণ করতে হবে। আর যদি পরকীয়ার ঘটনা হয় তাহলে দু’জনকেই গ্রেফতার করতে হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সরকারের কি দুর্বলতা রয়েছে। হেফাজত সরকারবিরোধী বা রাজনৈতিক কোন সংগঠন নয়। ইসলামের নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠায় হেফাজতের নীতি আদর্শ, যা মাওলানা শাহ আহমদ শফীর মূল উদ্দেশ্য ও নীতি ছিল। এ নীতি ও আদর্শ নিয়েই হেফাজতের প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি আরও জানান, বর্তমান হেফাজত নেতৃবৃন্দের অন্যায় ও অসামাজিক কার্যক্রম, রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা, সরকারবিরোধী অপতৎপরতাকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। শফীবিরোধী গ্রুপের সঙ্গে জড়িতরা নেতৃত্ব ছিনতাই করে বর্তমানে যেসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। হেফাজতকে পরিশুদ্ধ করা এখন মাওলানা শফীর লাখ লাখ অনুসারীদের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। যেসব কথিত নেতা হেফাজতকে পরিচালনার নেতৃত্ব বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছেন তাদের হাতে সংগঠনটি নিরাপদ নয়। এছাড়া দেশের লাখ লাখ আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা বর্তমান হেফাজতের এহেন কর্মকা-বিরোধী। সরকারের কাছে নিশ্চয়ই এসব বিষয় এতদিনে পরিষ্কার হয়েছে। এরপরও এসব কথিত নেতাদের বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশন কেন নেয়া হচ্ছে না তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। হেফাজতের দ্বিধা বিভক্ত গ্রুপের এ যুগ্ম-মহাসচিব পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার কওমি মাদ্রাসার জন্য যা করে দিয়েছেন তা পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়ের আগের দাবি ছিল। তার মতে, বর্তমান সরকারের ইসলামবিরোধী তৎপরতা না থাকার পরও অযথা পবিত্র ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে হেফাজতের বর্তমান হাইব্রিড নেতারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন। বর্তমান সরকার প্রধান যখন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখনও এসব কথিত এবং বর্তমান হাইব্রিডরা এর বিরোধিতায় ছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর যোগ্য নেতৃৃত্বের কারণে তা বানচাল করা যায়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আহমদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনটিকে এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফেলা হয়েছে জামায়াত-শিবির ও স্বাধীনতাবিরোধীদের খপ্পরে। এ সংগঠনটিকে রাষ্ট্রবিরোধী ও স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ও আদর্শের পথে পরিচালিত করতে হবে। এটাই ছিল প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির নীতি ও আদর্শ। হেফাজত উচ্ছৃঙ্খলতার পক্ষে নয়। সন্ত্রাসবাদের পক্ষে নয়। রাষ্ট্রের এবং জনগণের, বিশেষ করে ইসলামের শিক্ষা বাস্তবায়নের পক্ষেই হেফাজতের প্রতিষ্ঠা। কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ এ সংগঠনটির মূল মন্ত্র নয়। কিন্তু সংগঠনটি যাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে তারা মূলত জামায়াত-শিবিরসহ স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হচ্ছে। এসব অপশক্তির হাত থেকে হেফাজতকে রক্ষার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর সমর্থকদের এক কাতারে শামিল হওয়ার একান্ত অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এর অন্যথায় সংগঠনটির ভাবমূর্তি ভুলুণ্ঠিত হতেই থাকবে। যা প্রকারান্তরে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক এবং দেশের লাখ লাখ আলেম ওলামা ও তৌহিদী জনতার কপালে কলঙ্কতিলক হয়েই থাকবে।
×