ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘শিশু বক্তা’ গ্রেফতার

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ৮ এপ্রিল ২০২১

‘শিশু বক্তা’ গ্রেফতার

শংকর কুমার দে ॥ হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে এ্যাকশন শুরু করেছে সরকার। রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে বুধবার নেত্রকোনা থেকে ‘শিশুবক্তা’ হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীকে আটক করেছে র‌্যাব। হেফাজত নেতারা সোনারগাঁও থানায় মামুনুল হকের টাকা খোয়া গেছে বলে যে অভিযোগ করেছেন, তা যে মিথ্যা ও অসত্য তার প্রমাণ মিলেছে নারীসঙ্গী ঝর্ণার ভাইরাল হওয়া এক অডিওতে। ঝর্ণা অডিওতে বলেছেন, ব্যাগ ও টাকা সরিয়ে রেখেছেন তিনি। সারাদেশে হেফাজতের তা-বের ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত, মদদদাতা, অর্থদাতা, সবার বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে নারীসহ অবরুদ্ধ হন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। সে সময় ফেসবুকে এসে মাদানীকে কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনা করতে দেখা যায়। এছাড়া গত কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানি দেয়া ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী, সরকার, রাষ্ট্রবিরোধী ও অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এসব বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত ২৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের মোদিবিরোধী মিছিল থকে ‘শিশু বক্তা’ রফিকুল ইসলামকে পুলিশী হেফাজতে নয়া হয়েছিল। পরে আবার ছড়ে দেয়া হয়। শিশু বক্তা হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। থাকেন গাজীপুরে। তিনি নেত্রকোনার পশ্চিম বিলাশপুর সাওতুল হরা মাদ্রাসার পরিচালক। বুধবার সকাল থেকেই হেফাজতে ইসলামের বেশকিছু কর্মী ফেসবুক লাইভে এসে অভিযোগ করেন, রফিকুল ইসলাম মাদানীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়ে গেছে। তার মুক্তি চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কর্মসূচীর ঘোষণাও দেয়া হয়। রফিকুল ইসলাম রাজধানীর জামিয়া মাদানীয়া বারিধারা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। শারীরিক আকৃতিতে ছোট হওয়ায় তাকে সবাই ‘শিশু বক্তা’ বলেন এবং এ হিসেবেই পরিচিতি পান তিনি। নেত্রকোনা জলার পশ্চিম বিলাশপুর সাওতুল হরা মাদ্রাসার পরিচালক রফিকুল ইসলাম ২০ দলীয় জোটভুক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও রাবেতাতুল ওয়ায়েজিনের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলেও জানা যায়। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, রফিকুল ইসলাম বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছিলেন। সম্প্রতি তার রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উস্কানিমূলক অনেক বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। এই অভিযোগে তাকে বুধবার (৭ এপ্রিল) দুপুরে নেত্রকোনা থেকে আটক করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন র‌্যাব কর্মকর্তা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস থেকে গত ২৮ মার্চ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে তা-ব চালায় হেফাজতে ইসলাম। এই ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও অসংখ্য আহতসহ কোটি কোটি টাকার সরকারী-বেসরকারী সম্পদ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ও ভাংচুর করে নষ্ট করে তারা। হতাহতদের রক্তের দাগ না শুকাতেই এবং হতাহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন না করেই এক নারী নিয়ে গত ৩ এপ্রিল বিবাহবহির্ভূত এক নারীকে বিনোদন করতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও রয়েল রিসোর্টে গিয়ে ধরা পড়েন হেফাজতের যুুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। মামুনুল হককে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। এরপর থেকে হেফাজত কর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাংচুর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে স্ট্যাটাস, লাইভে এসে রাষ্ট্র, সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। অর্ধডজনের বেশি অডিও-ভিডিও ॥ তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের অনৈতিক কর্মের প্রায় এক ডজন অডিও-ভিডিও ফাঁস হওয়ায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে নারীসঙ্গীসহ স্থানীয় লোকজনের কাছে অবরুদ্ধ হন তিনি। সেই নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের নানা প্রশ্নবাণে তাকে ধরাশায়ী হতে দেখা যায়। স্ত্রীর পরিচয় যথাযথভাবে দিতে পারছিলেন না মামুনুল হক। এছাড়া রিসোর্টের রেজিস্টারে তিনি নারীসঙ্গীর নাম উল্লেখ করেন আমেনা তৈয়্যেবা। কিন্তু ওই নারী জানান, তার নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা। এখানে উল্লেখ্য, আমেনা তৈয়্যেবা মামুনুল হকের প্রথম স্ত্রীর নাম। গণমাধ্যমে এই নারীঘটিত কেলেঙ্কারির কথা শুনে মামুনুলের স্ত্রী মুষড়ে পড়েন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মামুনুল হকের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর ভোটার আইডি বা ন্যাশনাল আইডিতে স্বামীর নাম হিসেবে মামুনুল হকের নাম উল্লেখ নেই। অর্থাৎ তিনি মামুনুল হকের স্ত্রী নন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হক অনৈতিক কর্মকা- করতে গিয়ে ধরা খেয়ে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। রিসোর্ট থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীরা তাকে ছিনিয়ে নেয়ার পর তিনি তার স্ত্রী আমেনা তৈয়্যেবাকে ফোন করেন। স্ত্রীকে তিনি ফোনে জানান, রিসোর্টে থাকা ওই নারী জনৈক শহীদুল ইসলামের স্ত্রী। বিষয়টি নিয়ে কিছু মনে না করার অনুরোধ জানিয়ে হেফাজতের এই নেতা স্ত্রীকে বলেন, ‘কেউ জিজ্ঞাসা করলে তুমি বইলো আমি সব জানি।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের অডিও ফাঁস হওয়ার পরপরই ওই নারীসঙ্গী যে মামুনুল হকের বৈধ স্ত্রী নন সে বিষয় কিছুটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এরমধ্যেই আরও পাঁচটি অডিও ফাঁস হয়। যেগুলোতে গত কয়েক দিনে মামুনুল হক ও তার কথিত সেই নারীসঙ্গীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এমনকি ওই নারী মামুনুল হককে সাগর তীরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির কথাও মনে করিয়ে দেন। জবাবে মামুনুল ঝামেলা শেষ হলে সেই ইচ্ছা পূরণ করবেন বলে ওই নারীকে আশ্বস্ত করেন। মামুনুল ওই নারীকে যে স্ত্রী হিসেবে দাবি করেছিলেন সেই দাবি প- হয়ে যায় মামুনুল হকের বোন ও তার প্রথম স্ত্রীর অডিও ফাঁসের মাধ্যমে। প্রথম স্ত্রী বলেন, ‘সত্যি কিনা’ ॥ মামুনুল হকের বড় বোন অডিওতে মামুনুল হকের স্ত্রীকে বিষয়টি নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে শিখিয়ে দেন কেউ ফোন করলে কি বলতে হবে। মামুনুল হকের বোনকে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি বলবা আমার শাশুড়ি বেঁচে থাকতেই এই বিয়ে হয়েছে। আমার এতে সম্মতি ছিল। আমরা পরিবারের লোকজন সবাই তোমার সঙ্গে আছি। ঝামেলা একটু শেষ হোক।’ অডিওতে মামুনুল হকের প্রথম স্ত্রীর কণ্ঠে শোনা যায়,‘সত্যি’ ? ভাইরাল হওয়ার পর ঘটনা দেখেছেন বলে জানান প্রথম স্ত্রী। ঝর্ণার সঙ্গে মামুনুলের ফোনালাপ ॥ গত ৩ এপ্রিল শনিবার বিকেলে এক সঙ্গিনীসহ হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্মসচিব মামুনুল হককে সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে ঘেরাও করে আটকে রাখে স্থানীয় জনতা। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে উক্ত সঙ্গিনীকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন এবং নাম বলেন আমেনা তৈয়্যেবা। এমনকি রিসোর্টে ওঠার সময় পরিকল্পিতভাবেই রেজিস্টার খাতায় তার স্ত্রীর নাম ও এনআইডি নাম্বার লিখেছিলেন। তার সঙ্গিনীর আসল নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা। রিসোর্ট থেকে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপে মামুনুল হক বলেন, তার সঙ্গে থাকা ওই নারী ঝর্ণা তার বন্ধু শহীদুল ইসলামের স্ত্রী। পরিস্থিতির কারণে তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন এবং তাকে অনুরোধ করেন যাতে তিনি উক্ত বিয়ের কথা জ্ঞাত বলে স্বীকার করেন, তার স্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করে জিজ্ঞাসা করেন ঘটনা ‘সত্য কিনা’ ? তার জবাবে মামুনুল বলেন তিনি এসে সব বুঝিয়ে বলবেন। এর পরপরই মামুনুলের বড় বোন তার প্রথম স্ত্রীকে ফোন করে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করলে কৌশলে উত্তর দিতে বলেন।
×