ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

যুদ্ধাপরাধীর জামিন! মাদ্রাসায় সাত শ’ ছুরি!

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৮ এপ্রিল ২০২১

যুদ্ধাপরাধীর জামিন! মাদ্রাসায় সাত শ’ ছুরি!

বহু দুঃখে-কষ্টে জীবন কাটিয়েছে আমাদের গ্রাম-মফঃস্বলের শহীদদের ভাই, স্ত্রী, সন্তান এবং কৃষকের সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। কতদিন? ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে বঙ্গবন্ধু ও জেলে চার জাতীয় নেতার খুনীদের নেতা মুশতাক ও জিয়ার উত্থানের পর থেকে খালেদা-তারেক ও তার হাত ধরে বিএনপির মিত্র জামায়াতের শাসনামল। প্রায় ২১ + ৫ = ২৬ বছরের দীর্ঘ সময়। আমরা খুব বেশি জোরালোভাবে বিশ্বাস করতে না পেরেও জেলায় জেলায় ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আশা দিয়ে ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মহাজোটকে ভোট দেয়ার জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলাম। ঠিক বিশ্বাস হয়নি; ছাব্বিশ বছরে সরকারী মদদে, আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, অর্থবিত্তে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা ঐ বড় বড় রাঘব-বোয়াল যুদ্ধাপরাধীকে সত্যি সত্যি একদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হবে। সেই ২০০৮-এ তরুণ প্রজন্ম, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধপন্থী লাখ লাখ নারী-পুরুষ, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সমর্থকের অকুণ্ঠ সমর্থন মহাজোটের নেত্রী শেখ হাসিনাকে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে সহায়তা করেছে, এ কথা অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি এই যুদ্ধাপরাধী বিচারের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল- শহীদদের ভাই, স্ত্রী, সন্তান, প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য প্রদান, যার ওপর ঐ খুনী-ধর্ষকদের বিচারের সফলতা নির্ভর করবে। এই সাক্ষ্য দিয়ে বেশ ক’জন সাক্ষী ঐ যুদ্ধাপরাধীর সমর্থকদের হাতে খুন হয়েছেন! হায়! আমরা সাক্ষীদের তাদের প্রাপ্য সুরক্ষা দিতে পারছি না। এর মধ্যে যদি এই যুদ্ধাপরাধীরা জামিন পায় তাহলে তারা যে অমিতবিক্রমে সাক্ষী পরিবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, এটা কি বিচারক উপলব্ধি করেননি? আমরা বলতে চাই- কোন যুদ্ধাপরাধী গ্রেফতারের পর জামিন পেতে পারবে না, কেননা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধ সহিংস মানবতাবিরোধী অপরাধ। এরা এমনিতেই পলাতক থাকে। এরা যদি গ্রেফতার হয়ে জামিন পায় তাহলে প্রতিবেশী সাক্ষী যারা এদের হাতে স্বজনখুন প্রত্যক্ষ করেছে। তাদেরকে সাক্ষী হবার জন্য এই খুনী-যুদ্ধাপরাধীরা আবারও হত্যা ও নির্যাতনের টার্গেট করবে। এই হিসাবটি করা কি এতই কঠিন? তাছাড়া, কোন যুদ্ধাপরাধীর কি কারণে জামিন হবে? এই যে যশোর জেলার প্রেমচারা গ্রামের ’৭১-এর কুখ্যাত রাজাকার আমজাদ মোল্লার নামে মামলা করে এবং সাক্ষী দিয়ে হামলা, মামলা ও মৃত্যু আশঙ্কায় নিদ্রাহীন, শান্তিহীন দিন কাটাচ্ছে শহীদ পরিবারের বাদী ও সাক্ষীরা, তাদেরকে আমরা, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সাক্ষী সুরক্ষা আইন করে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের হাত থেকে সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে দাবি করেছিলাম। সেটি এখনও হয়নি। আর এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল কোন্ হিসাবে আমজাদ রাজাকারকে জামিন দিয়েছে? তা বুঝতে পারলাম না। তবে এটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি, বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার প্রতি যে অন্যায় পদক্ষেপ হয়েছে, তা বলা বাহুল্য। এখনই ট্রাইব্যুনাল তার সিদ্ধান্ত সংশোধন করে জামিন বাতিল করে ঐ রাজাকারকে জেলে ফেরত নিয়ে আসবেন- এটিই এ মুহূর্তে ট্রাইব্যুনালের কর্তব্য বলে মনে করি। রাজাকার দল উল্টো শহীদ রজব আলী বিশ্বাসের ছেলে ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী হতদরিদ্র কৃষক খোকন বিশ্বাস ও আবুল বিশ্বাসের নামে ১০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি মামলা করেছে। মুক্ত স্বদেশে একজন শহীদের সন্তানের এই কি প্রাপ্য? একে তো তারা দীর্ঘ ত্রিশ বছর বিচার পায়নি। যাওবা বিচার কাজ শুরু করা হয়েছে, সাক্ষ্যদান শুরু হবার পর কোন্্ বিবেচনায় জাতির এসব কলঙ্ক রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের জামিন দিল ট্রাইব্যুনাল? যুদ্ধাপরাধের বিচারের আইনটিতে জামিনের কোন সুযোগ ছিল বলে জানি না। এর ওপর তারা, অর্থাৎ খুনী-রাজাকাররা হত্যার হুমকি দিয়েছে সাক্ষী আলাউদ্দীন বিশ্বাস, রুহুল আমিন, রকিব উদ্দীন, রতন বিশ্বাসকে। সাক্ষ্য দেয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে আরেক সাক্ষী এহিয়ার রহমানের ভাই তফসির মোল্লাকে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাংবাদিকদের এহিয়ার রহমান বললেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু প্রেমচারা রাজাকারমুক্ত হয়নি।’ অথচ, সত্য ঘটনা হচ্ছে- রাজাকার আমজাদ মোল্লা যশোরের বাঘারপাড়ার প্রেমচারা গ্রামে ১৯৭১ সালে নিজের বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। স্থানীয় বহু মানুষকে হত্যাসহ সে নির্যাতন করেছে। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল এই খুনী আমজাদ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। উল্লেখ্য, এই জনকণ্ঠেই ২০০১-এর ‘সেই রাজাকার’ সিরিজে আমজাদ রাজাকারের নাশকতার বিবরণ প্রকাশিত হয়। আমজাদ রাজাকার জামিনে ছাড়া পেলে তার সহযোগী সমর্থক পলাতক থাকা মহসীন বিশ্বাস দেশে ফিরে এসে বলেছে- ‘আমজাদকে তো আটকে রাখতে পারিসনি, এখন দেখি তোদের কে বাঁচায়।’ আমাদের বক্তব্য একটাই- এখনই এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ও সরকার গঠিত ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধীদের হাতে দীর্ঘকাল নিগৃহীত, নির্যাতিত শহীদদের সন্তানদের সুরক্ষা দিতে ঐ আমজাদ মোল্লা গংয়ের সবাইকে গ্রেফতার করে তাদের এবং যুদ্ধাপরাধী সমর্থক, সাক্ষী হত্যাকারী হিসেবে ট্রাইব্যুনালের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এসব খুনী কতটা নির্দয় যে তারা এখনও এই মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের আমলে সাক্ষীকে হত্যা করতে ভীত হয়নি। যশোর এমনিতেই জঙ্গী কার্যক্রমের জন্য পরিচিত। সরকারের প্রশাসক ও পুলিশ এ বিষয়ে কি করছে জানি না। আশা করি ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা এখন থেকে যুদ্ধাপরাধীকে জামিন দেয়াটা শহীদ পরিবারের বাদী ও সাক্ষীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য করবেন। একদিন শহীদ পরিবার, বিশেষত দরিদ্র পরিবারগুলোকে বিচার চাইতে আমরা উৎসাহিত করেছি। আবার এখন তারাই ট্রাইব্যুনালের গাফিলতিতে হত্যার শিকার হচ্ছে। সরকার ট্রাইব্যুনালকে ’৭১-এর রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য গঠন করেছে; নিশ্চয় শহীদ পরিবারদের সাক্ষ্য দেয়ার কারণে আসামি করতে নয়। রাজাকার জামিন পেলে যা যা হয় তা কি জিয়া, খালেদা জিয়ার আমলে বিচারকরা দেখেননি? এখনও এই মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের আমলে জামিনদাতা বিচারক সেই রাজাকারকেই জামিন দিয়ে পুরস্কৃৃত করলেন। এ দুঃখ রাখব কোথায়? বিশ্বাস হয় না, রাজাকার সহযোগীরা এই মামলা চলাকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক খানের গাড়ি বহরে ঐ মহসীন বিশ্বাস হামলা করেছিল! এ ঘটনায় আবদুর রাজ্জাক খান থানায় বাদী হয়ে মামলাও করেছিলেন। তাহলে, এহেন রাজাকারপূর্ণ গ্রামের ঘৃণিত এক রাজাকারকে জামিন দিয়ে আমাদের বহুল কাক্সিক্ষত দীর্ঘদিন পর শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দ- না হয়ে জামিন হলো কেন? সংবাদপত্রে প্রকাশিত আরেকটি খবর পড়ে আঁতকে উঠলাম। দুই মাদ্রাসায় সাত শ’ ছুরি পাওয়া গেছে। হেফাজত নেতারা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে তাদের যতরকম নাশকতামূলক কর্মকা- সংঘটন করে তাতে তাদেরকেই উলুখাগড়ার মতো ব্যবহার করে। এ সংবাদ দেশের সবার জানা। তাছাড়া দেশে জঙ্গী জন্মদানের প্রথম আঁতুড়ঘর যে কিছুসংখ্যক মাদ্রাসা ছিল তা বহুবার প্রকাশ পেয়েছে। উপরন্তু সেই নারীবিরোধী মৌলানারা বড় হুজুর, ছোট হুজুরদের জমানা দেখেছি। মোল্লা শফীর তেঁতুল তত্ত্ব, মেয়েদের ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার তত্ত্বও শুনেছি। এখন হেফাজতী-জামায়াত-বিএনপির সেই প্রাচীন আওয়ামী লীগ, হিন্দু সম্প্রদায়, বাঙালী সংস্কৃতিবিরোধী, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিরোধী ধ্বংসাত্মক কর্মকা- দেখছি। সুতরাং, মাদ্রাসায় কোরান-হাদিস কতটা শেখানো হয় আর ছোরা খেলা কতটা শেখানো হয়- তা এই মাত্র শতাধিক ছুরি পাওয়াই প্রমাণ করে। তবে প্রথমত- যত অশান্তি, অরাজকতা, নাশকতার শিরোমণি হেফাজত নেতা বাবুনগরী ও মামুনুল হককে দ্রুত হুকুমের আসামি অর্থাৎ মূল উস্কানি হিসেবে গ্রেফতার করে বিচার শুরু করার কাজটি দেখতে চায় দেশের জনগণ। ওদের দুজনকে আর সমাজে মুক্ত থাকতে দেখতে চায় না কেউই। সবাই জানে- ওরা দুজন হুকুমের আসামি অর্থাৎ ওরা উস্কানি না দিলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বা জামায়াত-শিবির-বিএনপির গু-ারা এমন নাশকতা-অগ্নিসন্ত্রাস করত না। দ্বিতীয়ত- সরকারকে বলব, অনেক হয়েছে। বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। এবার সময় হয়েছে- বঙ্গবন্ধুর দ্বারা গঠিত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের সময় এসেছে। প্রধানমন্ত্রীকে বলব- এই শিক্ষা রিপোর্টটিও যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মতোই জাতির বিভক্তি দূর করে জাতির এক হবার একটি উপায় বা হাতিয়ার হবে। মাদ্রাসার নাম মাদ্রাসা থাকতে পারে, কিন্তু সরকারী-বেসরকারী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসাকে সরকারী কারিকুলাম অনুসরণ করতে হবে এবং সবার শিক্ষার মাধ্যম হবে- বাংলা। সব ছাত্রছাত্রী দেশের ইতিহাস-ভূগোল-জানবে, বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা করবে, খেলাধুলা করবে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়বে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষা সমানভাবে সব শিক্ষা কেন্দ্রে শেখানো হবে। আশ্চর্য, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের উপযোগী ধর্মনিরপেক্ষ, জ্ঞান-বিজ্ঞানভিত্তিক বৈষম্যহীন শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও কর্ম তৎপরতার মধ্যে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন অন্যতম। সেটিই আমাদের জন্য অনুসরণীয় হবে, যেটি এখনও প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক। সত্যি, বারবার বিস্ময় মানি, বঙ্গবন্ধুই যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইবুনাল আইন তৈরি করেছিলেন। আবার বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। এটমিক এনার্জি সেন্টাও তিনি করেছিলেন। বিকেএসপি একাডেমিও তিনিই গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন। পৃথিবীতে এমন একজন জননেতার জন্ম হয়েছে কোথাও? আমরা যে কত সৌভাগ্যবান জাতি তা আমরা এখনও বুঝিনি। আবুল ফজলের রচনা ‘শেখ মুজিব তাঁকে যেমন দেখেছি’ বইটিতে তাঁর পুত্র শেখ কামালের ছোট একটি বর্ণনা থেকে জানতে পারছি, তরুণটিও কতই না গুণের অধিকারী হয়ে বড় হচ্ছিল। আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটি শেখ কামালকে পিতার পক্ষে পুত্রী উৎসর্গ করলাম। লেখক : শিক্ষাবিদ
×