ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিবৈষম্য ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়তেই ইউনেস্কো গঠিত হয়েছিল

প্রকাশিত: ১৮:১৪, ৭ এপ্রিল ২০২১

জাতিবৈষম্য ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়তেই ইউনেস্কো গঠিত হয়েছিল

অনলাইন ডেস্ক ॥ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক শাখা ইউনেস্কো গঠিত হয়েছিল ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই। যুদ্ধের কারণে এক দেশের মানুষের প্রতি আরেক দেশের মানুষের মনে যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, যে বর্ণবিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা মোকাবেলার লক্ষ্য নিয়েই তৈরি হয়েছিল জাতিসংঘের ব্যানারে এই সংস্থাটি। লন্ডনে ইউনেস্কোর সংবিধান পাঠ করা হয়েছিল ১৯৪৫-এর নবেম্বর মাসে। ব্রিটেনের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী, যিনি এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার প্রথম সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন, তিনি এই সংবিধান পাঠ করেন। এতে বলা হয়: "যেসব দেশের সরকার এই সংবিধানের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে, তারা তাদের জনগণের পক্ষে ঘোষণা করছে যে, ৯ই মে বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শান্তি অক্ষুণ্ন রাখতে আন্তর্জাতিক পরিসরে একটা দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ।" ওই সংবিধান পাঠ অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ মন্ত্রী বলেছিলেন, "মানবজাতির ইতিহাসে সবসময়েই আমরা দেখেছি যে এক সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে আরেক সম্প্রদায়ের গভীর অজ্ঞতা রয়েছে। আর এর থেকেই গড়ে উঠেছে পৃথিবীর এক দেশের মানুষের অন্য দেশের মানুষের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাস। "আমরা দেখেছি এই বিভেদই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশে দেশে যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।" ইউনেস্কোর মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার ব্যাপারে এমন একটা ভূমিকা পালন করা, যা দীর্ঘমেয়াদে শান্তি সমুন্নত রাখার আবহ তৈরি করবে এবং যুদ্ধের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে মানবজাতিকে সাহায্য করবে। জাতিবৈষম্য ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদী নিধনযজ্ঞ - যা হলোকস্ট নামে বেশি পরিচিত - তার ভয়াবহতার চিত্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য আর বর্ণবাদের বিষয়টা নিয়ে মানুষের মনে সবচেয়ে গভীর দাগ ফেলেছিল। ইউনেস্কো প্রতিষ্ঠার পর সংস্থায় সেনেগ্যলের প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন ডুডু ডিয়েন। পরে ওই সংস্থায় বর্ণ ও জাতি বিদ্বেষ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন তিনি। বিবিসিকে তিনি বলেন, হলোকস্টের মর্মান্তিক ঘটনার কারণ ছিল নাৎসীদের ইহুদী বিদ্বেষ। জাতিগত কারণেই ইহুদীদের তারা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। সেটা বিশ্বকে বিরাটভাবে নাড়া দিয়েছিল। তাই জাতি ও বর্ণবিদ্বেষ দূর করার একটা জোরালো অঙ্গীকারই ছিল ইউনেস্কো প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। প্রতিষ্ঠার পরপরই ইউনেস্কো জাতিগোষ্ঠীর একটা নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করে - যেখানে বলা হয়, "কোন একটি জাতি আরেকটি জাতির থেকে শ্রেষ্ঠ নয়।" ইউনেস্কোর সংবিধানে জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু এই ভিন্নতার কারণে কোন জাতি বা বর্ণের প্রতি বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কড়া ভাষায় নিন্দা জানানো হয়। ইউনেস্কোর এক সম্মেলনে ১৯৭৮ সালে জাতি ও বর্ণভিত্তিক বিদ্বেষ বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্রও গ্রহণ করা হয়। যাতে বলা হয়: "প্রতিটি মানুষ সমান আত্মমর্যাদা ও সমান অধিকার নিয়ে জন্মেছে। এবং প্রত্যেক মানুষ মানবজাতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।" "প্রত্যেক মানুষ বা জাতির নিজস্ব জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। কেউ কারো থেকে আলাদা হলে তার জন্য কোনভাবে কোন সময় কারো প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করা যাবে না।" ঔপনিবেশিক মানসিকতা: ডুডু ডিয়েন বলছেন যে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হওয়ার পর ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে যেসব দেশ এই সংস্থায় যোগ দিয়েছিল, এটা ছিল তাদের দিক থেকে নেয়া খুবই শক্ত একটা পদক্ষেপের ফসল। তারাই শুরু করেছিল এই আন্দোলন। তিনি বলেন, তাদের দাবি ছিল বর্ণবিদ্বেষ দূর করতে হলে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি এই বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। "মনে রাখবেন ওই সময়টাতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ একটা বিরাট আন্তর্জাতিক ইস্যু ছিল। আফ্রিকার দেশগুলো এবং দক্ষিণের দেশগুলো বর্ণবিদ্বেষের বিষয়টা ইউনেস্কোর সামনে আনে বর্ণবিদ্বেষের আরেকটা প্রকট দিক তুলে ধরার জন্য," বলেন ডুডু ডিয়েন। জাতিবর্ণ নিয়ে ইউনেস্কোর দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে দক্ষিণ আফ্রিকা এর আগেই ১৯৫৫ সালের শেষ দিকে ইউনেস্কোর সদস্যপদ ছেড়ে দিয়েছিল। ইউনেস্কো এরপর তাদের শিক্ষা কর্মসূচির অংশ হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবার কিছুদিনের মধ্যেই ডুডু ডিয়েন আরেকটি কাজে বেশি করে জড়িয়ে পড়েন। ঔপনিবেশিক শাসকেরা চলে যাওয়ার সময় তাদের শাসনাধীন দেশগুলোর মূল্যবান যেসব সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো ফেরত আনার ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। সাংস্কৃতিক সম্পদ পুনরুদ্ধার: সেনেগালের প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৭৩-৭৪ সালে তিনি প্রথমবারের মত ইউনেস্কোর কাছে একটি সিদ্ধান্ত পেশ করেন, যে সিদ্ধান্তের নাম ছিল 'সাংস্কৃতিক সম্পদের পুনরুদ্ধার'। "বিভিন্ন দেশ থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের সময় শাসকেরা সেই সব দেশের প্রাচীন ও মূল্যবান বহু সাংস্কৃতিক সম্পদ, সেসব দেশের ঐতিহ্য লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিল। এর শিকড়েও কিন্তু ছিল জাতিগত বিদ্বেষ। "আমরা বলেছিলাম একটা জাতির সাথে জড়িয়ে আছে তার সংস্কৃতি। বলেছিলাম কীভাবে সংস্কৃতির মধ্যে দিয়েই একটা জাতিসত্ত্বার প্রকাশ ঘটে," বিবিসিকে বলেন মি. ডিয়েন। যেসব ইউরোপীয় দেশ তাদের উপনিবেশ থেকে এসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে গিয়েছিল, তারা এই অভিযোগের উত্তরে যে যুক্তি দেখিয়েছিল, ডুডু ডিয়েন তা মেনে নিতে পারেননি। "মনে আছে ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা আমার বিবৃতির উত্তরে বলেছিলেন, 'মি. ডিয়েন, হ্যাঁ, আমরা নিশ্চয়ই অনেক কিছু নিয়ে এসেছিলাম - যেমন আপনার দেশ থেকে মুখোশ বা অন্য দেশ থেকে অন্য সম্পদ। "কিন্তু তার পেছনে নানা কারণ ছিল। তবে আমরা কিন্তু সেগুলো সংরক্ষণ করেছি, সেগুলো পুনরুদ্ধার করেছি, সেগুলো যাদুঘরে রেখেছি, যাতে বিশ্বের সব মানুষ সেগুলো দেখতে পারে," বলছিলেন মি. ডিয়েন। ডুডু ডিয়েন ও ইউনেস্কোতে তার সহকর্মীরা দেশগুলোকে বলেছিলেন যে এসব পুরাকীর্তি ফিরিয়ে দেয়াটাই হবে তাদের দিক থেকে যথাযথ দায়িত্বপালন। কিন্তু এর বিকল্প প্রস্তাবও ছিল। "ফেরত দেয়াটাই ছিল প্রথম অনুরোধ, সেটা হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এসব সামগ্রী ধার দেবার প্রস্তাবও ছিল। যেমন, সেনেগালের যেসব পুরাকীর্তি বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ফ্রান্সের যাদুঘরে রয়েছে, যদি সেনেগাল সেগুলোর প্রদর্শনী করতে চায়, তাহলে ফ্রান্স হয় সেগুলো চিরকালের জন্য ফিরিয়ে দিক, না হলে সেগুলো এক বছরের জন্য সেনেগালকে ধার দিক।" এই প্রস্তাবের পর ইউরোপের দেশগুলো কয়েকশো' সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোকে ফিরিয়ে দিয়েছে। "এখনও ফেরানোর প্রক্রিয়া চলছে," বলছেন মি. ডিয়েন। সহিষ্ণুতার নীতি: ডুডু ডিয়েন পরবর্তীতে ইউনেস্কোর আন্ত-সংস্কৃতি এবং আন্ত-ধর্ম বিষয়ক সংলাপ বিভাগের পরিচালক হন। কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ কীভাবে পরস্পরের সাথে বাণিজ্য করেছে, কীভাবে তারা পাশাপাশি বসবাস করেছে, সেসব বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি বেশ কিছু অভিযানের কাজ শুরু করেন। এই গবেষণা জাতি, বর্ণ ও ধর্ম বিষয়ে সহিষ্ণুতা নিয়ে ইউনেস্কোর কাজে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছিল। এর ফলে ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো সহিষ্ণুতার নীতি বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্রও জারি করে। "আমরা পাঁচ সপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন দেশে গবেষণাধর্মী অভিযান চালাই। আমাদের প্রথম কাজ ছিল সিল্ক রোড নিয়ে - যা শুরু হয়েছিল চীনে," বলেন মি ডিয়েন। সিল্ক রোডের বাণিজ্য নিয়ে ১৯৯০ সালে ইউনেস্কোর হয়ে গবেষণার কাজ করেন ঐতিহাসিক, ভূতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ ও ধর্মীয় প্রতিনিধিদের একটি আন্তর্জাতিক দল। তারা চীনের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সাথে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করেন। "আমরা দেখতে চেয়েছিলাম মানুষ কীভাবে মানুষের সাথে লেনদেন করেছে। বাণিজ্যিক স্বার্থে মানুষের চলাচল তাদের পরিচিতিতে কোন প্রভাব ফেলেছে কি-না এবং এই চলাচলের সুবাদে তাদের সংস্পর্শে আসা অন্য মানুষের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কোনভাবে বদলেছে কি-না, আর বদলালে কেমন ছিল সেই প্রভাবের পরিণতি?" ওমানের সুলতানের দেয়া একটি জাহাজে, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের নিয়ে ইউনেস্কোর একটি দল ১৯৯০ সালের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করে ইতালির ভেনিস শহর থেকে। তাদের যাত্রাপথ ছিল সমুদ্রে প্রাচীন নৌ সিল্ক রুট ধরে। গবেষক দলটির ভেনিস থেকে জাপানের ওসাকা যেতে সময় লেগেছিল পাঁচ মাস, বলছেন মি. ডিয়েন। যাত্রাপথের প্রতিটি দেশকে তারা অনুরোধ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর তৈরি করা কমিটি যেন এই বাণিজ্য পথের বিভিন্ন ইস্যু চিহ্ণিত করে, এবং গবেষক দলের হাতে সেসব তথ্য তুলে দেয়। "আমাদের দলে ছিলেন প্রায় ৪০জন। আমাদের যাত্রাপথে ছিল ইতালি, গ্রিস, তুরস্ক, মিশর এবং আরও অনেক দেশ। প্রত্যেক দেশে আন্তর্জাতিক মানের কমিটিতে গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন বিষয়ের কথা আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন," জানান ডুডু ডিয়েন। আর এই তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে ইউনেস্কো বুঝতে পেরেছিল জাতি ও বর্ণ বিদ্বেষ দূর করার জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির গুরুত্ব কতখানি। এই যাত্রায় মি. ডিয়েন এমন সব মানুষের দেখা পান, যারা আগে কখনও আফ্রিকার কৃষ্ণ বর্ণের কোন লোক দেখেনি। "কিছু প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় মানুষ আমার গায়ের চামড়া ছুঁয়ে দেখেছে। আমিও তখন ওদের চামড়া ছুঁয়েছি। ওরা হেসেছে, আমিও হেসেছি। ভারী অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।" ডুডু ডিয়েনের সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসির ক্যারোলাইন বেইলি। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×