ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

কাবাডিতে সুদিনের আশা

প্রকাশিত: ০০:১১, ৭ এপ্রিল ২০২১

কাবাডিতে সুদিনের আশা

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের খেলাধুলার গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে বিভিন্ন ফেডারেশন পুনর্গঠন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে পশ্চিম বাংলার আসানসোলে ভারতের জাতীয় কাবাডি অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ থেকে কাজী আনিছুর রহমান ও আমীর হামজা আসানসোলে যান। তখন থেকে কাবাডি খেলার নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশে জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৮০ সালে ভারতের এনআইএস থেকে কাবাডি খেলার ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে আবদুল হক বাংলাদেশে কাবাডি খেলার কলাকৌশল ও নিয়মকানুন প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে কাবাডি খেলা নিয়মিত ইভেন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন থেকে কাবাডি খেলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখে। ১৯৯০ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে কাবাডি খেলাকে অন্তর্ভুক্ত করে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। এরপর থেকে কাবাডি নিয়মিত ইভেন্ট হিসেবে এশিয়ান গেমসে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের কাবাডির স্বর্ণযুগ ছিল ১৯৮৫-২০০৯ সাল পর্যন্ত। এই ২৪ বছরে বিশ^কাপ, এশিয়ান গেমস, এশিয়ান ইনডোর গেমস এবং সাউথ এশিয়ান গেমস ... এই চারটি আসরে অংশ নিয়ে কোন শিরোপা জিততে না পারলেও ছয়টিতে দ্বিতীয় ও চারটিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। এক সময় কবাডিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে অনেক। তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে ইরান, পাকিস্তান, জাপান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কার মতো নবাগতরা। সর্বশেষ ২০১৬ বিশ^কাপে বাংলাদেশ গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে। এশিয়ান গেমসে নিয়মিত দ্বিতীয়-তৃতীয় হলেও শেষ তিনটি আসরে (২০১০, ২০১৪, ২০১৮) বাংলাদেশ যথাক্রমে পঞ্চম, সপ্তম ও পঞ্চম হয়। আর সাউথ এশিয়ান গেমসে তারা সর্বশেষ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল সেই ১৯৯৫ আসরে। এরপর শেষ ৫টি আসরে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সদিচ্ছা, পরিকল্পনা, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা-অদক্ষতা-অদূরদর্শিতার ফলেই বাংলাদেশের কাবাডি বছরের পর বছর পিছিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যারা কাবাডির দায়িত্বে এসেছেন, তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিলম্বে হলেও ধীরে ধীরে আবারও এগিয়ে যাচ্ছে বা জেগে উঠতে শুরু করেছে বাংলাদেশের কাবাডি। তারই দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে গত ২ এপ্রিল। বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক কাবাডি টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক বাংলাদেশ। শুক্রবার পল্টনের ভলিবল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনালে তারা ৩৪-২৮ পয়েন্টে হারায় কেনিয়াকে। খেলার প্রথমার্ধে কেনিয়া ১৮-১০ পয়েন্টে এগিয়েছিল। ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় হন বিজয়ী দলের আরদুজ্জামান মুন্সি। বেস্ট ক্যাচার হন বাংলাদেশের মঈনুল ইসলাম। একই দলের তুহিন তরফদার হন টুনামেন্টসেরা খেলোয়াড়। আন্তর্জাতিক কাবাডিতে এটাই লাল-সবুজ বাহিনীর প্রথম শিরোপা। এর আগে এশিয়ান গেমসে ৩টি রৌপ্যপদক অর্জনই ছিল এতদিন পর্যন্ত তাদের সেরা সাফল্য। টুর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্নামেন্ট তৃতীয় স্থান অধিকার করে শ্রীলঙ্কা। খেলা শেষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এমপি। এ সময় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম, কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি ও র‌্যাবের ডিজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এবং টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান, ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক উপস্থিত ছিলেন। খেলা শেষে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক তুহিন তরফদার বলেন, ‘আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। আমরাই চ্যাম্পিয়ন। তিন মহাদেশের দেশ অংশ নিয়েছিল টুর্নামেন্টে। আমরা একে একে সবাইকে হারিয়েছি।’ দলের ভারতীয় কোচ সাজুরাম গয়াত বলেন, ‘সেরা দল হিসেবেই টুর্নামেন্টে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। ছেলেদের প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছে তারা। আশাকরি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ দল তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে।’ গত ২৭ মার্চ শুরু হয়েছিল আলোচিত এই আসরটি। ৫ জাতির এই টুর্নামেন্টে স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও পোল্যান্ড, কেনিয়া, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা অংশ নেয়। আসরে চ্যাম্পিয়নশিপে আগেই চোখ রেখেছিল বাংলাদেশ। ঘরের ট্রফি ঘরেই রেখে দেয়ার প্রত্যয় শুনিয়েছিলেন জাতীয় কাবাডি দলের অধিনায়ক তুহিন তরফদার এবং দলের ভারতীয় কোচ সাজুরাম গয়াত। বাংলাদেশ দলের সাফল্যের মূলে ছিল জিয়াউর রহমান ও আরদুজ্জামান মুন্সির মতো ভালোমানের খেলোয়াড় থাকা। এছাড়া তিনজন নতুন খেলোয়াড়ও অসাধারণ খেলেছেন। বাংলাদেশের পরবর্তী এশিয়ান গেমস (২০২২ সালে চীনের হ্যাংঝু)-এ ব্রোঞ্জপদক পুনরুদ্ধার করা। এই আসর সামনে রেখে সকাল-বিকেল দু’বেলা অনুশীলন করে লাল-সবুজ বাহিনী। দেশী কোচের পাশাপাশি বিদেশী কোচদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ অনুশীলন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ৩৯ জনের প্রাথমিক দল নিয়ে চলেছে বাংলাদেশের অনুশীলন। ট্রায়ালে সংখ্যাটা ছিল ৮২ জনের। সেখান থেকে ৫৩ জন হয়ে পরে ঠেকে ৩৯ জনে। সবশেষ ২০১৯ নেপাল এসএ গেমসে ভালো করতে পারিনি বাংলাদেশ। দলে চার সিনিয়র খেলোয়াড় তখন ছিলেন না। তবে বঙ্গবন্ধু কাপে সেই আফসোসে পুড়তে হয়নি। পূর্ণশক্তির দল নিয়েই এবার অংশ নেয় বাংলাদেশ এবং সাফল্যও পায় তারা। ফাইনাল শুরুর আগে বাংলাদেশ দলের ভারতীয় কোচ সাজুরাম গয়াত বলেছিলেন, বাংলাদেশ দল পাঁচ জাতির এ টুর্নামেন্টে চমৎকার ফর্মে রয়েছে। গ্রুপপবে প্রতিটি ম্যাচই অসাধারণ খেলেছে। সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ দল ফাইনালেও শতভাগ সাফল্য পাবে। অল্পদিনের প্রশিক্ষণে দলটি দারুণ খেলছে।’ সাজুরাম আরও বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক কাবাডি টুনামেন্ট নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার আয়োজন। এ ধরনের আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনকে ধন্যবাদ।’ দলের অধিনায়ক তুহিন তরফদার ফাইনালে নামার আগে বলেছিলেন, ‘টুনামেন্টের শুরু থেকেই আমরা ফাইনালে খেলার আত্মবিশ্বাস নিয়েই খেলে আসছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ। আমরা সেই লক্ষে পৌঁছে গিয়েছি। সামনে এখন একটিই ম্যাচ। প্রতিপক্ষ যেই হোক, ফাইনালে তাদের হারিয়ে শিরোপাটা ফেডারেশন কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিতে চাই।’ তবে ফাইনালের আগের ম্যাচে মাথায় আঘাত পেয়ে শেষ চার মিনিট খেলতে পারেননি বাংলাদেশ দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় আরদুজ্জামান মুন্সি। রেইড দিতে গিয়ে শ্রীলঙ্কান এক খেলোয়াড়ের হাঁটুর ধাক্কায় মাথায় আঘাত পান আরদুজ্জামান। তবে দলকে স্বস্তি দিয়ে ফাইনালের আগে আরদুজ্জামান খেলার মতো সুস্থ ও ফিট হয়ে ওঠেন। টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি ও র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ও জনতা ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস ছালাম আজাদ, হাফিজুর রহমান খান, শাহীন আহমেদ ও ইয়াসির আহমেদ খান এবং ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ও টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান এবং পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (ডেভেলপমেন্ট) গাজী মোঃ মোজাম্মেল হক। শেষের জন ট্রফিও উন্মোচন করেন। প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্যে কি সুদিন ফিরবে বাংলাদেশের কাবাডির? এটাই এখন ক্রীড়াপ্রেমীদের প্রশ্ন? * আন্তর্জাতিক কাবাডিতে বাংলাদেশের আগের যত সাফল্য : বিশ^কাপে ২০০৪ ও ২০০৭ সালে তৃতীয় স্থান, এশিয়ান গেমসে ১৯৯০, ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে দ্বিতীয় স্থান, এশিয়ান ইনডোর গেমসে ২০০৭ ও ২০০৯ সালে তৃতীয় স্থান এবং সাউথ এশিয়ান গেমসে ১৯৮৫, ১৯৮৭ ও ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।
×