ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে শিক্ষা ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ২০:১৮, ৬ এপ্রিল ২০২১

করোনাকালে শিক্ষা ব্যবস্থা

করোনার মহাদুর্বিপাকে সবচেয়ে বেহাল অবস্থা জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা কার্যক্রম। ২০২০ সালের ১৭ মার্চে বন্ধ হওয়া প্রাতিষ্ঠানিক পাঠক্রম আজ অবধি অবরুদ্ধতার যাঁতাকালে। নতুন বছরের শুরুতে সংক্রমণ কিছুটা ধীরগতি হলেও ৩১ মার্চ স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার সরকারী চিন্তা-ভাবনা পুনরায় স্থবির হয়ে আছে। কারণ মার্চের শুরু থেকেই করোনার দাপটে আবারও দেশ নতুনভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শনাক্তের হার পূর্বের তুলনায় উর্ধমুখী হওয়ায় সরকারকে আপাতত চিন্তা করতে হচ্ছে ঈদের আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যাচ্ছে না। শিক্ষা কার্যক্রমের এমন বিপন্ন অবস্থায় প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক। বিস্তারিত জানাচ্ছেন -নাজনীন বেগম করোনা দুর্যোগে শিক্ষা সঙ্কট সরকার থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক অনিশ্চয়তার শঙ্কা তৈরি হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের মূল ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করেছে। প্রথমেই সংসদ টিভির মাধ্যমে প্রাইমারী থেকে মাধ্যমিক পাঠক্রমের ওপর কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদান বন্ধ হলেও ছাত্রছাত্রীরা কোনভাবেই শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিল না। তবে প্রশ্ন থাকে সংসদ টিভির কার্যক্রম সেভাবে সর্বজনীন হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তির ত্রুটি-বিচ্যুতিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরা এমন পাঠদানে অংশ নিতে পারেনি। মহাপরিচালক অভিমত ব্যক্ত করেন- হঠাৎ বিস্তার লাভ করা এমন এক কঠিন দুঃসময়ে সহজে কোন সমস্যাকে দূর করা আসলেই মুশকিল। প্রথমত আমরা এই ধরনের তথ্যপ্রযুক্তির পাঠক্রমে আগে অভ্যস্ত ছিলাম না। তার চেয়েও বেশি বিজ্ঞানভিক্তিক পড়াশোনায় একটা সুশৃঙ্খল পদ্ধতি থাকে। যে কারণে শিক্ষকদেরও প্রথমদিকে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। পরে আস্তে আস্তে তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা কার্যক্রম নতুন গতি ফিরে পেতে সময় লাগেনি। এ ছাড়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সম্ভাবনায় বিশ্বমানের পাঠদান কর্মসূচীর দ্বার উন্মোচন হলো। ফলে চরম সঙ্কটে আমরা নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে যে ভাবে কাজে লাগালাম তার দামও কম নয়। তবে প্রান্তিক মানুষের হতদরিদ্র সন্তানরা যে মাত্রায় সরকারী সাহায্যে শিক্ষা গ্রহণে সম্পৃক্ত হয় সেখানে করোনার ছোবল কিছুটা পড়েছে। হতদরিদ্র কৃষক তার স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে দৈন্যদশায় দিনমজুরির কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। কিংবা কোন বালিকা শিক্ষার্থীকে বাল্যবিয়ের কোপানলে পড়তে সময় লাগেনি। সঙ্গত কারণে ঝরে পড়ার হার আগে ছিল না- করোনাকালে তা কিছুটা হলেও বেড়েছে। বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাম-গঞ্জে এই অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাক্রম সেভাবে সর্বজনীন হয়নি। কারণ হতদরিদ্র বাবা-মার ঘরে টিভিই থাকে না। আর যাদের ঘরে থাকে সেখানে বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণে সংসদ টিভি দৃশ্যমানও হয় না। শুধু তাই নয়, জেলা-উপজেলায় যাদের সংসদ টিভি দেখার সুযোগ রয়েছে তারা অনেকেই এই পড়াশোনায় মনোনিবেশই করতে পারেনি। ব্র্যাকের এই জরিপ নিয়ে গোলাম ফারুক সুচিন্তিতভাবেই দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে ব্র্যাকের জরিপের সময় সমস্ত শিক্ষার্থী প্রতিবেদন প্রস্তুতে ব্যস্ত ছিল। সে সময় অনলাইনভিত্তিক শ্রেণী কার্যক্রমও নিয়মিত ছিল না। পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তরণের মান নির্ণয়ে ডিসেম্বর মাসে প্রতিবেদন তৈরি করাও শিক্ষা কার্যক্রমের এক বিশেষ কর্মযোগ। সঙ্গত কারণে আরও প্রাসঙ্গিক বিষয় জানার ইচ্ছা থাকে-অটোপ্রমোশন। এ ব্যাপারেও আপত্তি জানান শিক্ষা অধিদফতরের এই উর্ধতন কর্মকর্তা। দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেন- কোনভাবেই অটোপ্রমোশন হয়নি। বিভিন্ন পাঠক্রমের আলোকে পরের ক্লাসে উঠতে যোগ্যতম বিবেচনায় প্রতিবেদন তৈরি করাও তাদের আবশ্যকীয় পরীক্ষা কার্যক্রম ছিল। যা প্রত্যেক শিক্ষার্থী স্ব-স্ব প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে জমা দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়ার ছাড়পত্র পায়। অন লাইনভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সারাবিশ্বে প্রচলিত এক মানসম্মত বৈজ্ঞানিক কার্যবিধি। করোনা আমাদের অনেকভাবে সঙ্কটের আবর্তে ফেলে দিলেও নতুন এক জগতের উন্মোচন করেছে, যা এর আগে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবার অবকাশও হয়নি। যদিও এর প্রয়োজনীয়তা এবং প্রাসঙ্গিকতা একান্তই জরুরী। শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকরাও এই নতুন অভিগমনে নিজেদের পারদর্শী করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা অবারিত করেছেন। যার সুফল ইতোমধ্যে দৃশ্যমানও হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ার সঙ্কটও সংশ্লিষ্টদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। তবে শিক্ষার্থীদের পুরো এক বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। সঙ্গত কারণে মাধ্যমিক ও জুনিয়র পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে তাদের মান যাচাই-বাছাই আবশ্যক হয়ে পড়ে। প্রশ্ন থাকে অনেক শিক্ষার্থী সব বোর্ড পরীক্ষায় একই ফলাফল করে না। ফল নির্ণয়ে তাদের মান ওঠানামা করতে সব সময় দেখা যায়। তার ওপর উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশদ্বারের মাইলফলক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। যার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে ভর্তি পরীক্ষাও। এই ব্যাপারে মহাপরিচালক অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তার অভিমত তুলে ধরেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ করতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভর্তি পরীক্ষা-যা অনেকটাই ভর্তিযুদ্ধের মতো। আর এই ভর্তি পরীক্ষাই হবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মেধা ও মনন যাচাইয়ের সর্বোত্তম পন্থা- যা আগেও ছিল এবারও কোন ব্যতিক্রমী কিছু হচ্ছে না। এসব মান যাচাই-বাছাইয়ের প্রসঙ্গ শিক্ষার্থীদের আসলে বিড়ম্বনার শিকার করে। সুতরাং তাদের সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে উৎসাহিত করাই সময়ের দাবি। তিনি আরও বলেন-মূল্যায়ন পদ্ধতির নতুন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতম বিবেচনা করতে আরও একটি নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। সেখানে শুধু নির্দিষ্ট ছাত্র কিংবা ছাত্রী নিজেকে যাচাই করার চাইতেও শিক্ষকদের দৃষ্টিতেই সেই শিক্ষার্থী তার যথাযথ মানকে তুলে ধরতে সক্ষম হবে। সুতরাং শিক্ষার্র্থীদের মধ্যে ভাল-মন্দের ফারাক ঘুচে গেলেও শিক্ষকরা মেধাবী ছাত্রছাত্রী বিবেচনায় নিতে পূর্ণ সুযোগ পাবেন, যা আন্তর্জাতিক মানসম্মত যোগ্য শিক্ষার্থী যাচাইয়ের অন্যতম মাপকাঠি। প্রসঙ্গক্রমে বলে যান এই মাউশির অধিকর্তা-কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের তৈরি করা তথ্যচিত্র নির্মাণের কথা। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যে মাত্রায় শিশু ও তরুণরা ধারণ করে চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরে তা শুধু অসাধারণই নয়, একেবারে এক উন্নতমানের সময়োপযোগী কর্মযোগ। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে আয়েজিত এক প্রতিযোগিতায় মুজিব গ্রাফিক নোভেলের মতো কার্টুন চরিত্রে উপস্থাপন করা হয় জাতির জনককে। ৩০ জন শিশু-কিশোর তাদের কল্পনা ও স্বপ্নের তুলির ছোঁয়ায় অনবদ্য করে তোলে বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণীয় অবয়ব। সেখানে স্থান পায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ঐতিহ্যিক ভাষণ। তথ্যচিত্র নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর জীবনের হরেক ঘটনাপঞ্জীও অতি স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অল্প বয়সী শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে যে অবিস্মরণীয় তথ্যচিত্র উপস্থাপন করল তাতেও শিক্ষা কার্যক্রমে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হলো। ইতোমধ্যে বিসিএস পরীক্ষা এবং মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তবে কোথাও কোন স্বাস্থ্যবিধির মানার সুরক্ষিত বলয় দৃশ্যমান হয়নি। এ প্রসঙ্গে গোলাম ফারুক বলেন- গত ১ বছরে আমাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়টি চর্চা করাও বিশেষ প্রয়োজন ছিল। যেখানে সেখানে মানুষের অকারণ ও অবাধ যাতায়াতই শুধু নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করার দুঃখজনক চিত্রও আমাদের হতাশ করেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এবং সামাজিক দূরত্বের বিঘ্ন সৃষ্টি করা এই মুহূর্তে কোনভাবেই কাম্য নয়। লেখক : সাংবাদিক
×