ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. খুরশিদ আলম

বাংলাদেশ থেকে কেন পিছিয়ে গেল পাকিস্তান

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৫ এপ্রিল ২০২১

বাংলাদেশ থেকে কেন পিছিয়ে গেল পাকিস্তান

বিগত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান পিছিয়ে গেল কেন? যে শক্তিধর দেশটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সমস্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেল সড়ক, পোর্ট ধ্বংস করল; বিমান, জাহাজ, সোনা-রুপাসহ সমস্ত সম্পদ লুট করে নিয়ে গেল, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে মাত্র ১৮ ডলার রেখে গেল, সেই বাংলাদেশ এগিয়ে গেল পাকিস্তান থেকে । আর তারা পিছিয়ে গেল কেন? বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, মানবসম্পদ উন্নয়নে (যদিও এর আবিষ্কারক হলো পাকিস্তানের প্রয়াত অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক, যিনি সারাবিশ্বের উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন এবং পৃথিবীতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার লিখিত গ্রন্থ এখনও পড়ানো হয়) বাংলাদেশ ১৩৩ আর পাকিস্তান ১৫৪ (২১ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ), দারিদ্র্যের হার বাংলাদেশে ২১.৮% আর পাকিস্তানে ২৪.৩%, গড় আয়ু বাংলাদেশে ৭২.৬ আর পাকিস্তানে ৬৭.৩ বছর, হত্যার হার বাংলাদেশে প্রতি লাখে ২.৫ জন আর পাকিস্তানে ৪.৪১ জন, প্রত্যাশিত শিক্ষা বছর বাংলাদেশে ১১.৬ আর গড় শিক্ষা বছর ৬.২ এবং পাকিস্তানে প্রত্যাশিত শিক্ষা বছর ৮.৩ আর গড় শিক্ষা বছর ৫.২, মাথাপিছু আয় বাংলাদেশে যখন ১৮৫৬ ডলার তখন পাকিস্তানে ১২৮৫ (মোট ৫৭১ ডলার কম। আশ্চর্য ঘটনা হলো মাথাপিছু আয় ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানে মোট ১৪ বার কমে গেছে, যা বাংলাদেশে ৯ বার এবং তাও ২টি খুবই সামান্য)। ডলারের সঙ্গে মুদ্রার বিনিময়ে দেখা যায় এক ডলার সমান আমাদের ৮৫ টাকা, তাদের সেখানে ১৫৬ রুপী। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাংলাদেশ ৪৪ বিলিয়ন ডলার আর পাকিস্তানে ২০ বিলিয়ন ডলার বা অর্ধেকের চেয়েও কম। অথচ তাদের লোকসংখ্যা আমাদের চেয়ে ৪.৬৬ কোটি বেশি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৫.৯৭ কোটি আর বাংলাদেশের ৬.৫৫ কোটি। আজ বাংলাদেশের ১৬.৫৮ কোটি আর পাকিস্তানের ২১.২৪ কোটি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের হার (সিপিআর) হচ্ছে ৬৭%, সেখানে পাকিস্তানে ৫০%-এর নিচে। পাকিস্তান তুলা উৎপাদন করে আর বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তর গার্মেন্ট রফতানিকারী দেশ। তাই সম্প্রতি পাকিস্তানীরা যুক্তিসঙ্গত কারণেই তাদের দেশকে বাংলাদেশের মতো বানানোর দাবি জানিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের এ অবস্থা কেন? এর অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। যেমন- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি ধর্মীয়। রাজনৈতিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে হয়ত সকলে এক বাক্যে বলবেন যে, পাকিস্তান এমন একটি দেশ যা জন্ম থেকেই জ্বলছে। সেখানে মানুষ গণতন্ত্র দেখেনি, দশকের পর দশক ধরে সামরিক শাসন চলেছে। গণতন্ত্রের নামের যে ছিটেফোঁটা আছে সেটি মূলত বলা হয় মিলিটারি গাইডেড ডেমোক্রেসি। আবার বাংলাদেশেও প্রায় ১৫ বছর সামরিক শাসন ছিল। কয়েক বছর ধরে জেনারেল জিয়ার আমলে এখানে এমনকি রাতে কারফিউও চলত। তাহলে রাজনৈতিক দিক দিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক মিলও ছিল। তখন অনেক বিশ্লেষক বিশেষ করে ভারতীয় বিশ্লেষকরা আবার এ ধারণা পোষণ করতেন যে, পাকিস্তানের যে হাল হয়েছে বাংলাদেশেরও সে হাল হবে। তবে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা ভাল ছিল। পাকিস্তানের বৃহৎ এলাকা যথা- সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং খাইবার পাকতুনখোয়া প্রদেশ (সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) মূলত পাঞ্জাবের উপনিবেশ হিসেবে আছে বলে সেসব প্রদেশের লোকেরা মনে করেন। অর্থাৎ দেশের বৃহত্তর এলাকা একটি ক্ষুদ্র এলাকার কলোনি হিসেবে আছে। ফলে সেখানে বিনিয়োগ অনেক কম। রাজনৈতিকভাবে সেসব প্রদেশের লোকেরা নিজেদের আর এখন স্বাধীন মনে করে না। আমাকে অন্তত কিছু পাকিস্তানী বলেছেন যে, ‘তোমরা স্বাধীন হয়ে বেঁচে গেছ, আমরা এখনও স্বাধীন হতে পারলাম না।’ তাই পাকিস্তানের রাজনীতি উন্নয়নের অনুকূল এ কথা কেউ মনে করে না, অন্তত পাকিস্তানের বিরাট সংখ্যক নাগরিক তা মনে করেন না। এসব দেখে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী হামজা আলাভী বলেছিলেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র হচ্ছে ওভারডেভেলপড বা অতিবিকশিত। রাষ্ট্রের যা থাকা দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র মাথা ভারি করে রেখেছে। প্রায় ১০ লাখ সৈন্য এবং তাদের জন্য দেশের এক বিরাট সম্পদ ব্যয় করতে হচ্ছে। তারা তো তেমন উৎপাদনও করে না। আর বাংলাদেশের মাত্র ১.৫ লাখ সৈন্য। বাংলাদেশ যেখানে সরকারী ব্যয়ের ৯.৭% সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যয় করে, সেখানে পাকিস্তান ব্যয় করে ১৮.৪%, বাংলাদেশের দ্বিগুণ। পাকিস্তান বর্তমানে মোট ডিজিপির ২.৮% ব্যয় করে যা ১৯৭০ সালে ছিল ৬.৫০% এবং ২০০১-২ সালে ছিল জিডিপির ৪.৬%। তাতে দেখা যায় যে, পাকিস্তান প্রথম থেকে অনেক বেশি ব্যয় করে। আর এ ব্যয়ের মাধ্যমে সেই ১৯৭০ দশকে যে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করে মোট ব্যয় অনেক বাড়লেও জিডিপির তুলনায় তা কমে এসেছে। বর্তমানে পাকিস্তানের সামরিক ব্যয় বাংলাদেশী মুদ্রায় ৬৯,৮৫১ কোটি টাকা, যা আমাদের বাজেটের প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ। অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে প্রথমে মনে পড়ে পাকিস্তানের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হকের সেই বইটির কথা যেখানে তিনি দাবি করেন যে, উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পাকিস্তান শুরু থেকেই বিপথে হাঁটছিল। সেখানে তারা ২২ পরিবার সৃষ্টি করেছিল। অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তান শুরু থেকে পুঁজিবাদী ধারায় ছিল এবং নৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক ধারায় যাওয়ার চেষ্টা করেনি। ভুট্টোর শাসন আমলে কিছু প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল, তবে মোটা দাগে পাকিস্তান সব সময় পুঁজিবাদী ধারায় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ শুরু থেকেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। সমাজতান্ত্রিক পথে হেঁটেছে আবার তার ব্যর্থতা দেখে পুঁজিবাদের দিকে ফিরে এসেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলতে বাংলাদেশে তেমন কার্যকর কিছু ছিল না। ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন সব কলকারখানা ভারত এবং পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। আর এখানে তার কিছু ছিল না। যে সামান্য কিছু পাকিস্তান আমলে গড়ে উঠেছিল তা ১৯৭১ সালে যুদ্ধের কারণে তছনছ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ব্যাংক তৈরি করা থেকে শুরু করে সবকিছু করতে হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে সব ব্যাংকের শাখা এখানে ছিল, সেগুলো স্থানীয়রা পরিচালনা করতে পারলেও বিদেশী বাণিজ্য, মুদ্রা বিনিময় থেকে সব কিছুতে ছিল একটি কঠিন অবস্থা। কারণ তার সবকিছু পাকিস্তানীদের হাতে ছিল। বস্তুত সামাজিক অবস্থার কারণে পিছিয়ে গেছে পাকিস্তান। সেখানে সম্পত্তি ব্যবস্থা এমন যে, সমস্ত সম্পত্তি অল্প সংখ্যক লোকের হাতে রয়েছে। যারা জোতদার তারাই আবার শিল্প-কারখানা, ব্যাংক-বীমার মালিক, তারাই আমদানি-রফতানির মালিক, আবার তারাই সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক আমলা। ফলে পাকিস্তান দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত- একটি হচ্ছে ধনিক এবং আরেকটি হচ্ছে গরিব শ্রেণী। আর তাই সে দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠেনি। কোন একটি দেশে মধ্যবিত্ত না থাকলে সে দেশে শিল্পপণ্যের বা কৃষির বাজার গড়ে ওঠে না, বহুমুখী উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে ওঠে না। সামাজিক গতিশীলতা দেখা যায় না। এর যেমন অর্থনৈতিক দিক আছে তেমনি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে অর্থাৎ সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় না, জনগণের শাসন যে সামান্যটুকু সম্ভব তাও টিকে থাকে না। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় যে, তারা পাকিস্তানের নাগরিক কিনা সেটি তারা অনুভব করে না। তাই বলা যায় যে, পাকিস্তানে রাষ্ট্র আছে, কিন্তু নাগরিক নেই। একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সে দেশের সাধারণ নাগরিক, যারা একাধারে উৎপাদনকারী এবং ভোক্তা। নারীর অধিকার নেই বললেই চলে। যেমন- জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্স বাংলাদেশ ১৫৩ দেশের মধ্যে ৫০তম আর পাকিস্তান ১৫১তম। তাদের শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে কর্মে অংশগ্রহণ একেবারেই কম। বাংলাদেশে যেখানে ৩৬% নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ রয়েছে, সেখানে পাকিস্তানে মাত্র ২৫%। এখনও সেখানে অনার কিলিং বিদ্যমান। নারীর অংশগ্রহণে দেশটিতে আরও বিভিন্ন ধরনের ঘোষিত এবং অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এদিকে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ, এমনকি শিক্ষিত ব্যক্তিরাও বলেছেন যে, ‘আমাদের এটম বোমা আছে, কিন্তু তা দিয়ে আমরা কি করব, আমরা কি তা খাব?’ দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষা, চিকিৎসা, পানি এবং স্যানিটেশন ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি সে দেশের সরকারগুলো। পাকিস্তানের এই কাঠামোগত সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা মোটেও সহজ কাজ নয়। হামজা আলাভী বলেছেন যে, সেখানে ধনী শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে থাকা দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যেও কোন শ্রেণী সংগ্রাম নেই। কারণ তার মতে এক ধরনের আদিম বশ্যতা (প্রাইমর্ডিয়াল লয়্যালটি) বিরাজ করছে। সেখানে ব্যাপকভাবে ভূমি সংস্কার, সম্পত্তি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, সম্পদের ওপর কর আরোপ, সামাজিক গতিশীলতা নিশ্চিত করা, সকল প্রদেশের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা, নাগরিকদের প্রকৃত নাগরিক হিসেবে এবং নারীদের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করার সুযোগ নিশ্চিত না করলে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে আরও পিছিয়ে যাবে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে সে পরিবর্তন আনার জন্য অনেক বেশি সৃজনশীল (ইনোভেটিব) হতে হবে। লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক [email protected]
×