ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ॥ ‘ইকোনোমিস্ট’ চক্রের গাত্রদাহ কেন?

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ৪ এপ্রিল ২০২১

শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ॥ ‘ইকোনোমিস্ট’ চক্রের গাত্রদাহ কেন?

পৌনে দুই শ’ বছর যাবত বিলাত থেকে প্রকাশিত ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা সাংবাদিকতা জগতের পথিকৃৎ বলে আমরা অনেকে উল্লেখ করি বা গর্ববোধ করি, কিন্তু কোন দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের সাংবাদিকতা তার তথাকথিত ঐতিহ্যকে কোথায় নামিয়ে দেয় সে নিয়ে কিছু কিছু গবেষণা হতে পারে। এই পত্রিকা বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর নিয়ে দুটি প্রতিবেদন ছেপেছে ২৭ মার্চ তারিখে (Bangladeshs growth has been remarkable, but is now at risk এবং অপরটি As it turns 50, Bangladesh is doing well, despite its politicians) যেগুলোর মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে সে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করছে। প্রকারান্তরে সে করেছে ‘গিবত’ যাকে আমরা অপসাংবাদিকতাও বলতে পারি। আর এজন্য সে ব্যবহার করেছে সূক্ষ্ম কথার মারপ্যাঁচ যা পড়লে মনে হবে প্রতিবেদনটি একটি গবেষণাপত্র ও বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেদকের বিশদ জ্ঞান আছে। বলাবাহুল্য, এই দুই প্রতিবেদনের কোথাও প্রতিবেদক, বিশ্লেষক বা গবেষকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এগুলো যদি রিপোর্ট বা প্রতিবেদনও হয় তাহলেও প্রতিবেদকের নাম এমনকি ভৎড়স ড়ঁৎ ফবংশ ইত্যাদি কিছুরই উল্লেখ নেই। এ থেকে মনে সন্দেহ জাগে কেউ বোধ হয় পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে এসব করাচ্ছে। সাম্প্রতিক আলজাজিরার ঘটনার পরে এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। কারণ, তথ্যানুসন্ধানে যেসব লোকের কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায় এদের অনেকেই লন্ডনে থাকেন, সে দেশের নাগরিক বা অভিবাসী। আবার প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার সরকারের সবই খারাপ আর অমুকের-অমুকের কাজ খুব ভাল এ রকম ইঙ্গিত দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের ফিরিস্তিতে সেসব অমুকদের গুরুত্ব তুলে ধরে একটা মিথ তৈরি করে দেয়ার চেষ্টাও আছে। ফলে দেশেও যে সেরকম অভিবাসী টাইপের ব্যক্তিত্ব বা মানুষ নেই যারা এসবে মদদ দেবেন না এমনও নয়। একটি প্রতিবেদনের শুরুতেই কেমন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক ও আত্মাহুতি দেয়া শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিরূপ ও অবমাননাকর মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছে এই প্যারা থেকে তা সহজেই অনুমেয়- No sooner had local politicians declared the independence of the eastern half of Pakistan (as Bangladesh had previously been) on March 26th of that year than the Pakistani army initiated a brutal war to crush the separatists, at a cost of somewhere between 500,000 and 3m lives. The fighting, along with devastating floods and cyclones, had turned the new country into one of the most destitute spots on Earth. এখানে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ডাকের কথা তো নেই-ই, বলা হয়েছে somewhere between ৫ লাখ থেকে ৩০ লাখের মতো মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়েছে বটে, কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে কিছু বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ও ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এখানেও একটি সন্দেহের উদ্রেক হয়, এনজিওদের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা দেশের মোট উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের শতকরা ১০ ভাগ বা এর চেয়ে কিছুটা কম হলেও এদের ভূমিকা কেন বড় করে দেখানো হয়? নিশ্চয়ই শুধু সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতেই, না হলে যারা এই জাতীয় ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন তাদের পরিচয় কি? এই খাতের মানুষদের সরব উপস্থিতি দেখা যায় যখন ওয়ান ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি হয় বা যখন আওয়ামী লীগ সরকারে থাকে। আমাদের উন্নয়ন ইতিহাসটা যদি ঠিকঠাকমতো লেখা হতো তাহলে আমরা ‘ডকুমেন্টেড’ দেখতে পেতাম এদের বিকাশ হয়েছে কিন্তু সব স্বৈরাচারের আমলেই। ফলে উদ্দেশ্য কী ছিল তারও একটা বিশ্লেষণ আমরা সে ইতিহাসে পেয়ে যেতাম। কিছু সাময়িক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়া আর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কিছু উদ্ভাবন ছাড়া বৈদেশিক অর্থপুষ্ট বেশিরভাগ এনজিওদের পরিণতি হয়েছে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে। দেশের উন্নয়নে ব্র্যাকের অবদানের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যদিও তাদের প্রসঙ্গই আলাদা। কারণ, ব্র্যাক সামাজিক উন্নয়ন ও উদ্যোগ ব্যবসায় সফল মডেল কিন্তু তাদের ২০১৯ পর্যন্ত প্রকাশিত হিসাব দেখলে দেখা যায় বৈদেশিক অনুদান ও ক্ষুদ্র ঋণ আয়ের নির্ভরতা কোন অংশে কম নয়। কিন্তু আমরা মনে রাখব না যে একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিচালনা নীতি-ই তার অংশীদারদের সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে? সেখানে আলাদাভাবে উন্নয়নের কৌশল বজায় থাকে? শেখ হাসিনার নেতৃত্বের যে প্রধান কৌশল সেটা holistic বা সামগ্রিক, এই কৌশলের ছায়াতলেই তো সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে ও অবদান রাখছে, যে কারণে বাংলাদেশ কোথায় কোথায় উন্নতি করেছে সেসব সূচক নিয়ে দুনিয়ার কেউই আর মাথা ঘামায় না, তারা বুঝতে চায় নেতৃত্বের কৌশল ও সবকিছুকে দেখছে ‘নেতৃত্বের ম্যাজিক’ হিসেবেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান নেতৃত্বের উন্নয়ন মডেল সারাবিশ্বে প্রশংসিত হলেও ইকোনমিস্ট বা আলজাজিরাদের গাত্রদাহ হয় কেন? আসলে কি তাদের গাত্রদাহ হয়, নাকি আমাদের কারও কারও হয়? আমাদের মধ্যে তাদেরই হয় যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, যারা এখনও মনে করে বাংলাদেশ কেন পাকিস্তানের চেয়ে বেশি এগিয়ে যাবে? বা তারা মনে করে শেখ হাসিনার সরকার নয় তারও আগে থেকে পুষ্ট করা বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোরই অবদান বেশি। ক্ষুদ্র ঋণ না থাকলে আর গার্মেন্টসের বিকাশ না হলে এসবের কিছুই নাকি হতো না। কিন্তু একটি সহজ প্রশ্ন, ক্ষুদ্র ঋণের অবদান-ই যদি এত বেশি হবে তাহলে এ যাবত যে কয়েক লাখ কোটি ক্ষুদ্র ঋণের বাজার বিস্তৃত হলো সেটা দিনে দিনে বাড়ছেই কেন? দেশের মানুষ যদি দারিদ্র্য অবস্থা থেকে বের হয়ে না আসবে তাহলে এতদিনের এত টাকা গেল কোথায়? ক্ষুদ্র ঋণের বাজার কি এখন সাধারণের দৈনিক উন্নতির জন্য দেয়া হয়, না কি অনুন্নয়ন খাতে, ‘ট্রেডিং’ বা স্থানীয় বাজারের মজুদ ব্যবসা করতে বেশি দেয়া হয়? ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের সক্ষমতা কি হয়েছে? তাহলে সেই ‘৯৮ সালের বন্যার সময় খোদ গ্রামীণ ব্যাংক বা এই করোনাকালে সরকারের কাছে দলে দলে এরা হাত পাতে কেন? ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের পরতে পরতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়েছে। ধান ভানতে যেয়ে শিবের গীত গেয়ে নানা প্রসঙ্গের নেতিবাচক উপস্থাপনা করা হয়েছে যা নিন্দনীয় ও সাংবাদিকতা ঐতিহ্যের দাবিদারের জন্য খুবই বেমানান। এমনকি প্রতিবেদনগুলোয় অযাচিতভাবে নাম, তারিখ ছাড়া বা সূত্র ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, তার পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত ভুল তথ্য দিয়ে টেনে আনা হয়েছে। যে কেউ ভাল করে পড়লে বুঝবেন এত অপ্রাসঙ্গিক রীতিতে সেসব উপস্থাপন করা হয়েছে যা পেশাগত রীতিনীতির কাছে হার মেনেছে। এসব নেতিবাচক প্রচারণার উদ্দেশ্য একটাই- বর্তমান সরকারকে বিশ্ব পাঠকের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার অপপ্রয়াস। কিন্তু এরা বোকার স্বর্গে বাস করে। দুনিয়ার কোথাও একটা নজিরও নেই যে, মানুষের মুক্তির জন্য যে সংগ্রাম বা মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য যে সংগ্রাম, তা কোনদিন তাঁবেদার কুচক্রের ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয়ে থেমে গেছে। এ দেশের চূড়ান্ত মুক্তির সংগ্রাম ও বিজয় অনিবার্য যা বঙ্গবন্ধুর অর্জনে লেগেছিল ২৪ বছর। বাঙালী যখন ব্রিটিশ-পাকিস্তানীদের ফেরত পাঠাতে পেরেছে তখন এসব হীন প্রপাগান্ডার কুশীলবদেরও ফেরত পাঠাতে পারবে। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ‘উন্নয়ন ও মুক্তির দেশ’ হিসেবেই গণ্য হবে, যদিও তখন এসব ‘ইকোনমিস্ট’ সাহেবরা আর টিকে থাকবে কি-না সন্দেহ। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×