ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইমন মাহমুদ

সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চলতে চলতে চার বছর

প্রকাশিত: ২০:১২, ৪ এপ্রিল ২০২১

সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চলতে চলতে চার বছর

এই তো সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০০ একরের সবুজে মোড়া ক্যানভাসে পা রাখলাম। ২০১৭ সালের ৯ মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। শুরু হয়েছিল আমাদের বর্ণিল জীবনের এক নতুন গল্প। নতুন শিক্ষক, নতুন ক্লাসরুম, অচেনা কতগুলো মানুষ সব মিলিয়ে চোখে মুখে ছিল নতুন স্বপ্নের খোঁজ। সেই স্বপ্নের ঘোরেই দেখতে দেখতে কেটে গেল চারটি বছর। দুই বছর যেতে না যেতেই এই স্বপ্নের এক সারথী ফারিহা নুসরাত জেরিন আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে। এছাড়াও হারিয়েছি উকি মনকে এবং ফিল্ম এক্টিভিস্ট রণজিৎ দাস চৌহানকে; যে জীবনটাকে সেলুলয়েডের পর্দায় ভাসিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখত। আর সুহরাত জামিল চৌধুরী আছে বেলজিয়ামে। বাকিদের নিয়ে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, টানাপোড়েনের মাঝেই দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল অনেকটা সময়। বন্ধু! এই শব্দটা শুনলেই মাথার ভেতরে ছবির মতো একে একে ভেসে আসে দিনভর ঘোরাঘুরি, রাত জাগা আড্ডা, টাকা না থাকলে ধার চাওয়া, এক সঙ্গে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলতে যাওয়া। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা থেকে শুরু করে আধিপত্যের ধরনটাও বেশ বদলে যায়। অনেকে বলেন, শৈশব-কৈশোরের বন্ধুত্বের ভিত্তিটা একান্তই আবেগ নির্ভর। আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুত্ব অনেকটাই বুদ্ধিমত্তা কিংবা প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। সে যাই হোক! বন্ধু শব্দটাই কীভাবে যেন আমাদের একাকীত্বের অসহায়ত্ব ঘোচাতে পরিত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হয়। আমরা আসার আগেই একে একে এ ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নিয়েছে ৪১টি ব্যাচ। পুরনো স্মৃতির বিদায় আর নতুনের সম্মোহন এই দুইয়ে মিলে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব জমে উঠছিল বেশ। ঠিক তখনই এমন কিছু মানুষ এসে বন্ধুত্বে ভাগ বসাল যাদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের আনন্দের রেশ আজীবনেও ফুরাবে না। ক্লাস শেষে শহীদ মিনারে আড্ডা দেয়া, দলবেঁধে ক্যাম্পাস চষে বেড়ানো, হাঁটতে হাঁটতে গলা খুলে গান গাওয়া, চায়ের কাপে গল্পের ঝড়, চাঁদা তুলে বন্ধুদের জন্মদিনের কেক কাটা কিংবা রাতের বেলার বার্বি-কিউ পার্টি এই ঘটনাগুলো কেমন করে যেন দিনের ভিড়েও এখনেও নতুন, চিরসবুজ। তাই তো চোখের নিমিষেই চার বছরের হিসাব মেলাতে এখনও হিমশিম খাই। কখনও কখনও বিশেষ কিছু মুহূর্ত, স্মৃতি কিংবা অতীতকে আমরা ভুলতে পারি না। ইচ্ছা করেই বহমানতার স্রোতে ফেলে আসা অনিঃশেষ যন্ত্রণার পাললিক-জীবাশ্মকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে তার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন শোনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। সম্ভবত এমন কেউ নেই, যে হৃদয়-কূপের গভীরে গিয়ে নিরাশার তরল সন্ধানে নিমগ্ন থাকতে চায়। বন্ধুত্ব, এই সম্পর্কটার উপভোগ্যতা অন্য যে কোন সম্পর্কের চেয়েই একটু অন্যরকম, আলাদা কারণ এখানে কোন বাধ্যবাধকতা এবং পারিবারিক কিংবা আইনী দায়বদ্ধতার শৃঙ্খল থাকে না। সম্পর্কটা দিব্যি আগ্রহ, বোঝাপোড়া, মনের মিল-অমিল এবং অভ্যাসের উপর ভর দিয়েই টিকে থাকে বছরের পর বছর। বন্ধুত্বের সম্পর্ক যেহেতু আগে থেকে নির্ধারিত নয় এবং স্থায়িত্বও আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল, তাই এ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন হয় আলাদা যত্নের। সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যে ভালবাসা প্রকাশের। কেউ মনে করেন, প্রয়োজনে পাশে থাকা কিংবা বিপদে সাহায্য করার নাম বন্ধুত্ব। এর জন্য আলাদা করে আবেগ প্রকাশের কিছু নেই। আবার কেউ মনে করেন, বন্ধুর সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর না রাখলে কি আর বন্ধুত্ব হয়! কেউ কেউ ব্যস্ত ক্লাস, টিউটোরিয়াল, টিউশনি নিয়ে কেউ বা ব্যস্ত বিতর্ক, আবৃত্তি কিংবা অন্য কোন সাংগঠনিক কাজ নিয়ে। প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ততায় অতীতের স্মৃতি কখনও কখনও মিলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। আবার কখনও হাজার কাজের মধ্যে থেকেও কিছু চিরচেনা মুখ আমরা কখনোই ভুলতে পারি না কিংবা ভুলে থাকতে পারি না। প্রকৃতির পরিবর্তনের নিয়ম মেনে বৃক্ষের নন্দিত কুসুম, নদীর দুরন্ত ঝটিকা ঢেউ হারিয়ে যায়। কিন্তু বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আতরের সুবাসের মতো যা নিমিষেই শেষ হয়ে যায় না। টিকে থাকে আমৃত্যু। আমাদের অদৃশ্য যাত্রা কখনোই থামবে না, চলতে থাকবে।
×