ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তৃতীয় প্রজন্মের কাছে মাইলফলক

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উক্তি দেশের মানুষকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করছে

প্রকাশিত: ২১:০৬, ৩ এপ্রিল ২০২১

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উক্তি দেশের মানুষকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করছে

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করতে নানা উক্তি যেমন দিয়ে গেছেন তেমনি উৎসাহিত করতেও বলে গেছেন বাঙালী সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার কথা। ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি।’ বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনার দেশ গড়ার। ‘আমাদেরকে সোনার দেশের সোনার মানুষ হতে হবে। ‘এ স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।’ মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদের পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আর ৩০ লাখ শহীদের লাল রক্ত আর বাংলার চিরায়িত সবুজের রঙে রাঙ্গানো পতাকায় ফুটে উঠছে আমাদের বিজয় নিশান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীতেই এদেশের জন্মের অর্ধশত বার্ষিক পূর্ণ হলো। যা তৃতীয় প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় বার্তা হয়ে থাকবে। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসগুলো কপিরাইট হচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো কবি, সাহিত্যিক আর লেখক স্বাধীনতার ইতিহাসকে কপিরাইট করে নিজের নামে বই ছাপিয়ে দিচ্ছে। আর এসব বই আবার নিজের বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধবী বা আত্মীয় স্বজনের নামে উৎসর্গ করছে। প্রশ্ন উঠেছে যারা এসব কপিরাইট মাস্টার তাদের অনেকের জন্মও হয়নি স্বাধীনতার জন্মলগ্নতো দূরে থাক এর ১০/২০ বছর পরেও। কি মজা পাচ্ছেন তারা এসব কপিরাইটে। কোন না কোন বই থেকে ইতিহাসকে তুলে ধরে নিজের নাম জুড়ে দিয়ে লেখক, কবি, সাহিত্যিক বনে যাচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কিছু বলছে না। কপিরাইট আইনের প্রয়োগ না হলে ব্যাঙের ছাতা নয় শুধু পিঁপড়ের মতো টানাটানি হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির জন্য ও আদর্শ জাতি গঠনে নানা উক্তি স্মরণে রাখতে অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়া ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ এখনও কানে বাজে। যা একটি জাতি গঠনে তথা বাঙালী জাতিকে সমৃদ্ধ করতে এখনও পর্যন্ত অবদান রেখে যাচ্ছে। এ ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ আপনারা আমার ওপর বিশ্বাস নিশ্চয়ই রাখেন। জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেইমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই, ফাঁসির কাষ্ঠে আসামি দিয়েও আমাকে নিতে পারে নাই। ‘যে রক্ত দিয়ে আপনারা আমায় একদিন জেল থেকে বাইর করে নিয়ে এসেছিলেন এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম-আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্তের ঋণ শোধ করব, মনে আছে? আমি রক্ত দেয়ার জন্য প্রস্তুত’। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধু নিজেকে বাংলার সন্তান দাবি করে বলেন, ‘আমি বাঙালী, আমি মানুষ। আমি মুসলমান। মুসলমান একবার মরে দুইবার মরে না। বঙ্গবন্ধু যখন কারাবন্দী ছিলেন তখনও তিনি জাতির উদ্দেশে বলেছেন ‘ কোন জেল জুলুমই কোনদিন আমাকে টলাতে পারেনি, কিন্তু মানুষের ভালবাসা আমাকে বিব্রত করে তুলেছে। ‘আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মত নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু। ‘মজলুম দেশবাসীর বাঁচার জন্য সংগ্রাম করার মতো মহান কাজ আর কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।’ ‘দেশের সাধারণ মানুষ যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির উদ্দেশে বলেছেন, ‘বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে হবে। দুর্নীতি আমার বাংলার কৃষক করে না। দুর্নীতি আমার বাংলার শ্রমিক করে না। দুর্নীতি করে শিক্ষিত সমাজ।’ বঙ্গবন্ধু নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে বলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। বিশ্বে শোষিতের সংখ্যা কম নয়। শোষকরাই শোষণ করছে শোষিতের ওপর। বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধু সরকারী চাকুরেদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকারী কর্মচারীদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তারা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তারা জনগণের বাপ, জনগণের ভাই, জনগণের সন্তান। তাদের এ মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।’ তিনি সরকারী কর্মচারীদের উদ্দেশে আরও বলেছেন, ‘সমস্ত কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন।’ ‘শ্রমিকদের সম্মান দিয়ে কথা বলুন, তাদের পরিশ্রমে আমার আপনার বেতন হয়।’ দেশ পরিচালনায় প্রয়োজন নেতৃত্ব। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনদিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ তিনি রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, তারা হীন, নীচ ও তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালবাসে সে কোনদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। ‘পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না’-এ উক্তিটিও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। মানুষের ভালবাসা ও মানুষকে ভালবাসা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে আমি আমার জনগণকে ভালবাসি। আর আমার বড় দুর্বলতা হচ্ছে আমি তাদেরকে বড্ড বেশি ভালবাসি। কারণ, মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে।’ ‘যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারেন। বাঙালী জাতিকে দুর্বলতা দূর করে শক্তি ও মনোবল বৃদ্ধি করতে তিনি জাতির উদ্দেশে বলেছেন ‘আমি চিন্তা ভাবনা করে যে কাজ করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয় সংশোধন করে নেই। কারণ যারা কাজ করে তাদের ভুল হতেই পারে, আর যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না’- তিনি এ উক্তিটি করেছেন তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এ রেসকোর্স ময়দান থেকেই। তার এ আহ্বানে সাড়া দিয়েই তখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালী এবং তাদের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ করে এদেশকে স্বাধীন করেছে। ফলে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা। পেয়েছি লাখো শহীদের রক্তে মাখা লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই উক্তি যেখানে তিনি প্রকাশ করেছেন নিজের স্বাধীনতা অর্জনের মূল মন্ত্র। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির উদ্দেশে বলেছেন, ‘ এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে যেদিন বাংলার কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের দুঃখের অবসান হবে। আমরা বীর বাঙালী-এ গর্বটুকু করতে পারি শুধু জাতির পিতার অগাধ দেশপ্রেমের কারণে। আর আমরা বাংলাদেশী তাও বলতে পারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারণে। বঙ্গবন্ধুই হানাদার পাকিদের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতিকে জাগ্রত করতে কারাগারের প্রকোষ্ঠে থেকেও হুঙ্কার দিয়েছিলেন। মহান স্বাধীনতার ঘোষক থেকে শুরু করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ স্লোগানে বাংলার মুক্তিপাগল মানুষকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন।
×