ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নকল ও নিম্নমানের উপকরণ তৈরির কারখানা নিয়ন্ত্রণের বাইরে

মানহীন মশা বিতাড়ন উপকরণে ঠকছে ক্রেতা

প্রকাশিত: ২১:০৪, ৩ এপ্রিল ২০২১

মানহীন মশা বিতাড়ন উপকরণে ঠকছে ক্রেতা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মশার যন্ত্রণায় এখন অতিষ্ঠ মানুষ। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, কিউলেক্স মশার ঘনত্ব অন্য সময়ের চেয়ে চার গুণ বেড়েছে। অপরদিকে মশা মারতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কাজে এখনও দৃশ্যত কোন সুফল মিলছে না। ফলে নগরবাসীর ভরসা এখন নিজের কেনা মশা বিতাড়নের বিভিন্ন উপকরণ ও পণ্য। কিন্তু তাতেও রয়েছে বড় বিপত্তি। সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক নজরদারি না থাকায় এসব উপকরণ কিনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠকছেন ক্রেতারা। মশা তো বিতাড়িত হচ্ছেই না; উল্টো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন নগরবাসী। এখন মশা মারার বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে বাজারে। এর মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহার হচ্ছে কয়েল। যদিও কয়েল মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) একটি বাধ্যতামূলক পণ্য। তবে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজার কয়েল তৈরির কারখানার মধ্যে বিএসটিআইয়ের মান সার্টিফিকেট রয়েছে মাত্র ১০৩টি প্রতিষ্ঠানের। এর বাইরে বাজার আর পাড়া-মহল্লার দোকানে বিক্রি হওয়া কয়েলগুলোর নেই কোন মান। নেই কার্যকারিতাও। এসবের মান দেখে না কেউই। কোন কোন কয়েল জ্বালিয়ে মশা তাড়ানো যায় না। আর কিছু মশা তাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত কয়েলে দেখা যায়, মশাসহ টিকটিকি ও অন্যান্য প্রাণীও মরে যাচ্ছে। এর মানে ওইসব কয়েলে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মানবদেহের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। অনুমোদিত এবং বেপরোয়া কয়েল বাণিজ্যের বিষয়টি বিভিন্ন সময়ই ধরা পড়ে। চলতি মাসেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার দক্ষিণ মাতুয়াইল এলাকায় অবৈধ মশার কয়েল তৈরির একটি কারখানায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই অভিযানে এম এ্যান্ড আর এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানটি সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) লাইসেন্সবিহীন অবৈধভাবে পণ্যের মোড়কে গুণগত মানচিহ্ন ব্যবহার করে কয়েল তৈরি ও বিক্রি করে আসছিল। সেখানে বেশ কিছু ব্র্যান্ডের কয়েল ছিল। কিন্তু নেই কোন ল্যাব বা কেমিস্ট। এমনকি কয়েলে কত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় সেটাও বলতে পারেননি কোম্পানির কেউই। পরে প্রতিষ্ঠানটিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করে কারখানাটি সিলগালা করা হয়। এদিকে মশার উৎপাত বাড়তে থাকায় বিদেশ থেকে আমদানি করা এ্যারোসল, স্প্রে ও ক্রিমের বিক্রি বেড়েছে। তবে এসব পণ্যের ওপরও নেই কোন নিয়ন্ত্রণ। এর মধ্যে কোনটিই বিএসটিআইয়ের বাধ্যতামূলক পণ্য নয়। যদিও চাহিদা বাড়ায় দেশে এসব পণ্যের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। এসব পণ্য আমদানি বা তৈরি করতে গেলে শুধু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। দেশে এ পর্যন্ত ৪৫০টির বেশি ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ধরনের মশার ওষুধের (এ্যারোসল, ক্রিম ও অন্যান্য) লাইসেন্স দিয়েছে সংস্থাটি। যার মধ্যে অধিকাংশ আমদানি করা। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০টির মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো আমদানি ও উৎপাদন করে বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে লাইসেন্স দেয়া ছাড়া মান নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার নেই উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উইংয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আইইডিসিআরে মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বাস্তবে ট্রায়াল করে এগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরে বাজার তদারকি করার দায়িত্ব আমাদের নয়। নকল বা নিম্নমানের পণ্যের বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দেখবে।’ দেশের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র সংস্থা বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) সাজ্জাদুল বারী বলেন, ‘বাধ্যতামূলক পণ্য না হওয়ায় কয়েল ছাড়া মশা বিতাড়নের অন্যান্য পণ্যে তদারকি করা যাচ্ছে না। মানুষ হাজার হাজার পণ্য ব্যবহার করে। কিন্তু এর মধ্যে বিএসটিআইয়ের বাধ্যতামূলক পণ্য ২২৭টি, অর্থাৎ এই পণ্যগুলোর মান তদারকি করে থাকে বিএসটিআই।’ কয়েলেও যথেষ্ট তদারকি হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সিএম লাইসেন্স নেয়া ব্র্যান্ড কারা তা আমরা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মাঝে মাঝেই জানিয়ে দেই। কিন্তু নকল ও নিম্নমানের এতো বেশি কারখানা রয়েছে যে, সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারপরও প্রচুর মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। জেল-জরিমানাসহ কারখানা সিলগালাও করছে বিএসটিআই।’ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাবলিক হেলথ গ্রেড অর্থাৎ মানব শরীরের সংস্পর্শে আসার এসব পণ্যের জন্য নির্ধারিত কীটনাশকের ব্যবহারযোগ্য মাত্রা রয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত মশার কয়েল ও স্প্রেতে পারমেথ্রিন, বায়ো-এ্যালোথ্রিন, টেট্রাথ্রিন, ইমিপোথ্রিনের মতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। কোন পণ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় এসব ব্যবহার হলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদে কিডনি রোগে এবং ক্যান্সারেরও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। মশা মারার জন্য তৈরি বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলোরও একই অবস্থা। মানের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সেগুলো ব্যবহার করেও সন্তুষ্টি মিলছে না সাধারণ মানুষের। কিনতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। এখন মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট, ইলেকট্রিক মসকিটো কিলার, পাওয়ার গার্ড মেশিন, মসকিটো রিপেলার মেশিন, কিলার ল্যাম্প, কিলিং বাল্বের মতো সামগ্রীর ব্যবহার যেমন বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দামও। অন্যদিকে দিন দিন কমছে মান। বিক্রি বাড়ায় চীন থেকে নিম্নমানের সামগ্রীই আমদানি হচ্ছে বেশি। আর নিম্নমানের হওয়ায় এসব পণ্য থেকে দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে। সবশেষ গত ৫ মার্চ রাতে ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়কের শফিক ম্যানশনের পঞ্চম তলার একটি বাসায় মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাটে স্পার্ক থেকে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে একই পরিবারের তিনজন দগ্ধ হন।
×