ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সঙ্গীত মনকে সতেজ করে

প্রকাশিত: ২০:২৮, ২৯ মার্চ ২০২১

সঙ্গীত মনকে সতেজ করে

লস এ্যাঞ্জেলস টাইমসের কলাম লেখক স্টিভ লোপেজের গল্পটা হয়ত অনেকেই জানেন। এক সকালে তিনি হেঁটে চলেছিলেন লস এ্যাঞ্জেলস শহরের কেন্দ্রস্থলের সরু রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ এক সুরের শব্দে তিনি থেমে যান। রাস্তার ধারে বসে তখন সঙ্গীত পরিবেশন করছিলেন এক আফ্রো-আমেরিকান মানুষ। আকর্ষণীয়, রুক্ষ এবং গৃহহীন লোকটি সেদিন একটা বেহালা বাজাচ্ছিলেন, যেটাতে ছিল মাত্র দুটি তার। এই লোকটির নাম ছিল নাথানিয়েল এ্যান্থনি আয়ার্স। এ নিয়ে স্টিভ লোপেজের একটি বই বের হয়েছিল। পরবর্তীতে নাথানিয়েলকে নিয়ে সিনেমাও হয়। সে সময় নাথানিয়েল প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক অসুখে ভুখছিলেন। এই বইটি পড়লে বা সিনেমাটি দেখলে বোঝা যায়, কী ধরনের চমৎকার একটা বন্ধন গড়ে উঠেছিল এই দু’জন মানুষের মধ্যে। এটা বোঝার জন্য যে, কিভাবে সঙ্গীত সেই বন্ধনটার আদল গড়েছে। শেষ পর্যন্ত সঙ্গীতই সহায়ক হলেছিল নাথানিয়েলকে সড়ক থেকে তুলে বাড়িতে আনার জন্য। থাক সে সব ইতিহাসের কথা। আসুন চোখ মেলে তাকায় আমরা আমাদের নিজেদের দিকে। এমন কেউ আছেন যার সঙ্গীত বা সুরের প্রয়োজন নেই? না, নেই। এ রকম মানুষ এই যান্ত্রিক জগতে মিলবে না। শুধু সঙ্গীত শোনায় আছে ভিন্নতা। কারও পছন্দ নজরুল কারও আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত বা কেউ সকালে শোনেন নজরুল আবার সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া শূন্যতা ভোগ করেন। আমাদের এই অঞ্চলে দেহতত্ত্ব গানেরও বেশ জনপ্রিয়তা আছে, সব বয়সী মানুষ পছন্দ করেন লালন সাই, বাউল আবদুল করিম কিংবা হাসন রাজার গান। তরুণরা সচরাচর ব্যান্ডসঙ্গীত শুনতে পছন্দ করে। ইদানীং রক বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণে ফিউশন গানও অনেকে শুনছেন। আবার অনেকে শুনতে ভালবাসেন ইউরোপিয়ান সঙ্গীত। অনেকের কাছে লিওনার্ড কোহেন, বব ডিলান, জন লেনন কিংবা জিম মরিসন তো দেবতুল্য ব্যক্তিত্ব। ওই যে ছেলেটা কানে হেডফোন গুঁজে অবচেতন মনে হেঁটে চলেছে। তার কি চিন্তা সেটা কেউ বলতে পারবে না, তবে এটুকু বলা যায় সে এই মুহূর্তে ভাল আছে। সে হয়ত তার প্রেমিকার কথা ভাবছে অথবা বব ডিলানের সেই ‘ঐড়ি সধহু ৎড়ধফ’ শুনে নিজেকে খুঁজে ফিরছে। সঙ্গীতের ওপর মানুষ এ ভালবাসা ঠিক কবে থেকে তার কোন সঠিক ইতিহাস কোন পাতায় লেখা নেই। তবে সঙ্গীত দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বৃষ্টি হোক বা না হোক, অবচেতন মনেই আমরা কিন্তু গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি ‘আজ ঝর ঝর মুখরও বাদল দিনে’ অথবা ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন।’ মনকে সুস্থ রাখে সঙ্গীত। শুধু সুস্থই না সতেজও রাখে। আপনি সঙ্গীত শুনে যে আনন্দ পান তা হচ্ছে ইহজাগতিক। আমরা কেউ সকালে সঙ্গীত শুনতে পছন্দ করি, কেউ দুপুরে আবার কেউ ঘুমাতে যাই সঙ্গীত শুনতে শুনতে। সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত অর্থ আছে। যারা সঙ্গীত স্রষ্টা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের দর্শন এবং ধ্যান-ধারণাই সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। আবার তাদের মনের অবস্থার কথাও সুর ও গান আকারে প্রকাশ পায়। এ হতে পারে তার প্রেমিকা বিচ্ছেদ বা নতুন প্রণয়, হতে পারে কোন কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আবার হতে পারে মায়ের জন্য গান, হতে পারে ভাই কিংবা বোনের জন্য গান। হতে পারে তার কোন প্রিয় ব্যক্তি এবং স্থানের জন্য। আর সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে হরহামেশাই হয়েছে এবং হচ্ছে গান। গান কথা বলছে মনের। আমরা মানসিকভাবে যে যখন যে অবস্থায় থাকি তখন সেই ধরনের সঙ্গীত বেছে নেই। সঙ্গীতের বেশকিছু ঘরনা আছে যাকে ইংরেজীতে বলে জনরা (এবহৎব) যেমন- রক, পপ, ক্লাসিক, জ্যাজ, ব্লুজ, হিপহপ বা র‌্যাপ ইত্যাদি। রক, পপ বা ক্ল্যাসিক ছাড়া আমাদের দেশে সঙ্গীতের সব ঘরানা তেমন বিকশিত হয়নি। তবে আমাদের দেশীও কিছু ঘরানা বহু আগে থেকেই ছিল যেমন- বাউল, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া কিংবা ভাটিয়ালি। যুগ যুগ ধরে এ ধরনের গান আমাদের পূর্বপুরুষদের খোরাক মেটালেও এখন আর সেই অবস্থায় নেই। আর নতুন কোন জারি বা ভাওয়াইয়া গানেও সৃষ্টি হচ্ছে না। সঙ্গীতকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট হয়েছে এক ধরনের ব্যবসা। এতে সঙ্গীত রচনা করে গ্রাহক কিংবা প্রচার মাধ্যমে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানি, ব্র্যান্ড এবং ট্রেডমার্ক সহযোগে লেবেল এবং বিক্রেতা। এক হিসাব অনুুযায়ী ২০০০ সালের পর থেকে গানের শ্রোতার সংখ্যা অসম্ভব আকারে বৃদ্ধি পেয়েছ। শ্রোতারা ডিজিটাল মিউজিক ফাইলগুলোকে এমপি-থ্রি প্লেয়ার, আইপড, কম্পিউটার এবং অন্য বহনযোগ্য আধুনিক যন্ত্রে সংরক্ষণ করছেন। গানগুলো ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড কিংবা অনলাইনে ক্রয় করে মনের ক্ষুধা নিবারণ করছেন। ডিজিটাল মাধ্যমে গান সংগ্রহ ও দেয়া নেয়ার মাধ্যমে বর্তমান সঙ্গীত ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। তবে ইন্টারনেট থেকে অবাধে বিনামূল্যে গান ডাউনলোড করার ফলে সঙ্গীতশিল্প এক ধরনের হুমকির মুখে রয়েছে। এ ছাড়া পাইরেসি মনের খোরাক মেটানো নির্ভেজাল এই বিনোদন শিল্পকে ঠেলে দিচ্ছে নিকষ আঁধারে।
×