ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বালুচরে তরমুজ চাষীর মুখে হাসি

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ২৮ মার্চ ২০২১

বালুচরে তরমুজ চাষীর মুখে হাসি

পটুয়াখালীর বঙ্গোপসাগর পাড়ের চরজাহাজমারা ও চরকলাগাছিয়ার যে রুক্ষ বালুর চর বছরের পর বছর অনাবাদি পড়ে থাকত, সে পতিত জমিতে গ্রীস্মের রসাল ফল তরমুজের বাম্পার ফলন ফলিয়ে চাষীরা প্রমাণ করেছেন, কঠোর শ্রম আর লক্ষ্যে অটুট থাকলে সবই সম্ভব। দ্বীপ দুটির পুরো বুকজুড়ে এখন শুধুই সবুজের সমারোহ। এরইমধ্যে আগাম জাতের তরমুজে ভরে উঠেছে ক্ষেত আর চাষীর আঙিনা। বরিশাল-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ফড়িয়া-মহাজন, নৌকার মাঝিমাল্লাদের হাকডাকে সরগরম হয়ে উঠেছে দ্বীপের নির্জন প্রান্তর। চলছে ক্ষেত থেকে তরমুজ তোলা ও দরদাম শেষে বিভিন্ন মোকামে পাঠানোর ব্যস্ততা। অনুকূল আবহাওয়ায় আগাম তরমুজ উঠে আসায় দামও মিলছে ভাল। আর এতেই চাষীদের মুখে ফুটেছে তৃপ্তির হাসি। চরজাহাজমারা ও চরকলাগাছিয়ার অবস্থান বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে। এরপরে দক্ষিণে আর কোন জনপদ নেই। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে চর দুটি অনেকটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং দুর্গম। প্রাকৃতিক অবস্থানগত কারণে চর দুটির মাটি বালুর আস্তরণ দিয়ে ঢাকা। বছরে একবার মাত্র আমন ধানের চাষ হয়। তাও খুব অল্প পরিমাণ জমিতে। বছরের বাকি সময় চরের সমস্ত জমি অনাবাদি পরে থাকে। মিষ্টি পানির তীব্র সঙ্কট, চর দুটির জমি পতিত থাকার আরও একটি কারণ। গত বছর চর দুটির হাতেগোনা কয়েকজন চাষী মাটির বুকে গর্ত করে কঠোর পরিশ্রমে পানির ব্যবস্থা করেছিলেন এবং কিছু জমিতে আগাম জাতের তরমুজের চাষ করেন। তাতে তারা আশাতীত সাফল্য পান। এরই ধারাবাহিকতায় এবার আরও বেশি সংখ্যক চাষী তরমুজ চাষে এগিয়ে আসেন। এবারও তারা সাফল্য পেতে চলেছেন। আর চাষীদের এ কাজে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মীরাও এগিয়ে এসেছেন। এতে চাষীরা আরও উৎসাহিত হয়েছেন। সরেজমিনে দুটি বালুচরেই খেত ভর্তি আগাম জাতের তরমুজ দেখা গিয়েছে। আর প্রতিটি তরমুজই আকারে বেশ হৃষ্টপুষ্ট। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে তরমুজে মিষ্টতাও বেশি। চাষী, মহাজন-ফড়িয়া ও মাঝি-মাল্লাদের সকলকেই তরমুজ নিয়ে বেশ ব্যস্ততার চিত্র চোখে পরে। তরমুজ চাষীরা জানান, পটুয়াখালীর অন্যান্য এলাকায় ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে তরমুজের চাষ হয়। তারা এ সময়টা এগিয়ে নবেম্বর-ডিসেম্বর মাসে তরমুজের চাষ শুরু করেন। যার ফলে মার্চেই তারা ফলন পেতে শুরু করেছেন। চাষীরা আরও জানান, দুটি চরেই মিষ্টি পানির তীব্র সঙ্কট রয়েছে। এ সমস্যার সমাধান করা গেলে আরও বেশি তরমুজের চাষ হতো। এছাড়া চর দুটির বেশির ভাগ চাষীর নিজস্ব জমি নেই। মহাজনের কাছ থেকে মৌসুমের জন্য জমি ভাড়া নিতে হয়। এতে তাদের খরচ বাড়ে। অন্যথায় তারা আরও লাভবান হতেন। চরকলাগাছিয়ার তরমুজ চাষী দস্পতি ফেরদৌস পেয়াদা (৫০) ও জুলেখা বেগমের (৪০) নিজেদের কোন জমি নেই। অন্যের তিন একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। নিজেরা রাতদিন জেগে সেই জমিতে কুয়া কেটে পানি তোলার ব্যবস্থা করেছেন। নিজেরা জমি চাষ করেছেন। গাছের পরিচর্যা করছেন। পলিথিন দিয়ে ঝুপড়ি তুলে খেতে রাত কাটিয়েছেন। সব মিলে খরচ হয়েছে সোয়া লাখ টাকা। এরই মধ্যে ৯০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। আরও আনুমানিক লাখ তিনেক টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। জুলেখা বেগম জানান, তরমুজের জন্য প্রচুর মিষ্টি পানির প্রয়োজন। কিন্তু সাগরপাড়ের পানি লোনা। এতে কোন ফসল হয়না। তাই তরমুজ চাষে মিষ্টি পানির জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। সরকারীভাবে মিষ্টি পানির ব্যবস্থা করলে চাষীরা লাভবান হতো। চরজাহাজমারার চাষী ফারুক হাওলাদার এ বছর পাঁচ একর জমিতে তরমুজ লাগিয়েছেন। মোট খরচ হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। আগাম চাষ করায় তিন শ’ পিচ তরমুজ বিক্রি করেছেন। প্রতিটি তরমুজ ২৮০ টাকা দরে দাম পেয়েছেন ৮৪ হাজার টাকা। এখনও পাঁচ লাখ টাকার মতো তরমুজ খেতে রয়েছে। ফারুক হাওলাদার জানান, স্ত্রী হাসি বেগমকে নিয়ে সরকারী আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করেন। নিজেদের জমি নেই। অন্যের জমিতে দিনমজুরি করেন। সাগরপাড়ের সমস্ত বালু জমি অনাবাদি থাকে। অন্যের কাছ থেকে সুদে টাকা এনে গত বছর বালুচরে প্রথম তরমুজ চাষ করেন। কিন্তু অতিবৃষ্টির কারণে ফলন কম হয়। এরপরও ভাল লাভ হয়েছিল। এ বছর বৃষ্টি হয়নি। তাই ফলন ভাল হয়েছে। এবার চাহিদাও বেশি। ফলে লাভও বেশি হচ্ছে। এদিকে এরইমধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মোকাম থেকে মহাজন-ফড়িয়ারা তরমুজ কিনতে চলে এসেছেন। এদেরই একজন আবুল কালাম জানান, গত মৌসুমে প্রতিটি তরমুজ কিনেছেন ৫০ থেকে ৭৫ টাকায়। এবার সে তরমুজের দাম উঠেছে আড়াই-তিন শ’ টাকা। আগাম বাজারে আসায় তরমুজের চাহিদা বেশ বেড়েছে। রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, জাহাজমারা ও কলাগাছিয়ার অনাবাদি বালু জমিতে তরমুজের চাষ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভাগের কর্মীরা চাষীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু চর দুটিতে বড় সমস্যা হলো পানির। তাই গভীর নলকূপ বসানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, জেলায় তরমুজের প্রায় অর্ধেকই চাষ হয় রাঙ্গাবালী উপজেলায়। গত বছর রাঙ্গাবালী উপজেলায় সাত হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছিল। এ বছর সাত হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পটুয়াখালীর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হৃদয়েশ্বর দত্ত জানান, দোঁআশ মাটিতে তরমুজের ফলন ভাল হয়। তবে চরজাহাজমারা ও চরকলাগাছিয়ার মাটির উপরিভাগে বালু রয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে মিষ্টি পানির জন্য বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন ও গভীর নলকূপ বসানোর জন্য অন্যান্য দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, গত বছর জেলায় ১৪ হাজার ৮২২ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছিল। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে উৎপাদন কম হয়েছিল। এরপরেও গত বছর ৭ লাখ ৪১ হাজার ১০০ টন তরমুজ উৎপন্ন হয়। যার মূল্য ছিল ৭৪১ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ বছর এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার ২৩৬ হেক্টর আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৭ লাখ ৮২ হাজার ৯৮০ টন তরমুজ উৎপন্ন হবে। গড়ে ১২ টাকা কেজি দরে যার মূল্য দাঁড়াবে ৯৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ তরমুজের মাধ্যমেই এবার পটুয়াখালী জেলায় হাজার কোটি টাকা আসছে। যাতে লাভবান হবেন চাষীসহ অনেকেই। চিংড়ির চাষ শুরুর সময় আমাদের কার্যক্রম গ্রহণ বাঞ্চনীয় ছিল। যেহেতু বিলম্ব হয়েছে, কাজেই ২টি ছোট বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতার উপর নির্ভর না করে সরকারী উদ্যোগে ও খরচে এবং প্রয়োজনে বিশেষ কার্গো বিমানে এ চিংড়ি পোনা এনে পরীক্ষমূলক চাষের কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। যেহেতু আমরা খুব বেশি বিলম্ব করেছি, কাজেই প্রক্রিয়াটি এখন ত্বরান্বিত করা খুবই জরুরী।
×