ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি বাড়াতে ॥ ভেনামি চিংড়ি চাষের সম্ভাব্যতা

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ২৮ মার্চ ২০২১

রফতানি বাড়াতে ॥ ভেনামি চিংড়ি চাষের সম্ভাব্যতা

উৎপাদন, স্বাদ, বাজার মূল্য, ঐতিহ্য ও আভিজাত্য এসব কিছুর কারণে আমরা গলদা ও বাগদা চিংড়ির সঙ্গে খুবই পরিচিত । ভেনামি চিংড়ির সঙ্গে মোটেই পরিচিত নই। যেমন গলদা বা বাগদার বৈজ্ঞানিক নাম সাধারণ মানুষ জানে না। ভেনামিও এক প্রজাতির চিংড়ি মাছ (বৈজ্ঞানিক নাম : খরঃড়ঢ়বহধবঁং ঠধহহধসবর)। এটি প্রশান্ত মহাসাগর সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশে অতি পরিচিত। আবাসস্থল ছিল প্রধানত: মেক্সিকো। সেখান থেকে পেরু, ইকুয়েডর, আর্জেটিনা হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। এশিয়ায় বরং এখন এর কদর, উৎপাদন সবকিছু বেশি। পৃথিবীর প্রায় ৬২টি দেশে ভেনামি চিংড়ির চাষ হয়, এর মধ্যে এশিয়ার দেশ ১৬টি। কারণ এ চিংড়ির বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে আছে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি অর্থাৎ ক্রান্তীয় অঞ্চল বা কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে লবণাক্ত পানিতে চাষাবাদ, সঙ্গে আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কম আয়তনে বেশি পরিমাণ চিংড়ি চাষের সুবিধা এবং খাবার অনুপাতে চিংড়ি বৃদ্ধির পরিমাণ বেশি ইত্যাদি। এসব কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ তথা ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে ভেনামি চিংড়ির চাষ, উৎপাদন এবং রফতানি বৃদ্ধি ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। বিশ্ববাজারে হিমায়িত চিংড়ির বর্তমান রফতানি চিত্র সে তথ্যই প্রদান করে- হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতে ভারত পৃথিবীতে সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে, যা বাংলাদেশের তুলনায় ১২ গুণের বেশি। কিন্তু তাদের চিংড়ি চাষের জমি কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে আছে বলে আমরা গর্ব করি। কিন্তু আমাদের মাছ উৎপাদনের এলাকা বিশাল। বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্লাবন ভূমির এলাকা এবং এশিয়ার মাছ চাষের এলাকা বিবেচনায় আমাদের অবস্থান তৃতীয়। এদেশে চিংড়ি চাষের এলাকা প্রায় ২ দশমিক ৭৬ লাখ হেক্টর, এর মধ্যে বাগদা চিংড়ি চাষ এলাকা ১ দশমিক ৯৫ লাখ হেক্টর এবং গলদা চিংড়ি চাষ এলাকা ৮১ হাজার হেক্টর । সে তুলনায় ভারতের উপকূল অনেক বেশি লম্বা হলেও চিংড়ি চাষের এলাকা ১ দশমিক ৬৫ লাখ হেক্টর। অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশ্যা, পশ্চিম বাংলা এবং তামিলনাডুসহ কয়েক রাজ্যের কিছু অংশে চিংড়ি চাষ হয়। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ হচ্ছে ভেনামি চিংড়ির চাষ । ২০১৯ সালে তাদের উৎপাদন ছিল ৮ দশমিক ০৫ লাখ টন। বাগদা চিংড়ি যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি উৎপাদন সর্বোচ্চ ৪০০ কেজি, সেখানে হেক্টর প্রতি ভেনামির উৎপাদন প্রায় ৪০০০ কেজি। ফলে দ্রুত বেড়েছে সেখানে ভেনামি চিংড়ির চাষ । ২০০১ সালে ভারতের চিংড়ি উৎপাদন ছিল এক লাখ টন। আর ২০১৯ সালে তাদের উৎপাদন হয়েছে ৮ দশমিক ০৫ লাখ টন । ইন্দোনেশিয়ার আছে মহাপরিকল্পনা। তারা ১৬০ লাখ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ উৎপাদক হবার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। অপরদিকে শুধুমাত্র ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন না করায় বিগত বছরগুলোতে আমাদের হিমায়িত চিংড়ির রফতানি কমেছে। বিগত কয়েক বছরে আমাদের চিংড়ি রফতানির ক্রমহ্রাসমান রফতানি চিত্র আরও নি¤œগতিতে নামার আশঙ্কা প্রকাশ করে- অর্থবছর হিমায়িত চিংড়ি রফতানি ২০১০-২০১১ ৫৪,০০০ টন ২০১৬-২০১৭ ৩৯,৭০৫ টন ২০১৭-২০১৮ ৩৬,১৬৮ টন ২০১৮-২০১৯ ৩৩,৩৬২ টন বাংলাদেশের উৎপাদিত চিংড়ির ৩৯% আমেরিকায় রফতানি হতো। সে বাজার ভেনামি চিংড়ির কারণে ভারত ও অন্য দেশের হাতে চলে গিয়েছে। ভারত বিশ্বে এখন সব চেয়ে বেশি চিংড়ি উৎপাদন করে এবং তাদের রফতানির প্রায় ৫০ শতাংশ আমেরিকায় এবং ২৫% চীনে রফতানি হয়। ভেনামি চিংড়ির উৎপাদনের সুযোগ সব দেশের নেই। ম্যানগ্রোভ সংবলিত উপকূল, লবণাক্ত পানি, উষ্ণ তাপমাত্রা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য ও সুযোগ সব আমাদের আছে। সুযোগ হচ্ছে চায়ের চায়ের কাপে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ার মতো। একটু বিলম্ব করলে বিস্কুট হারিয়ে যায়। আমাদের অনুকূল পরিবেশ ও প্রতিবেশ থাকায় সুযোগ এখনও হারায়নি, তবে রফতানি বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। ভারতের ১ দশমিক ৬৫ হেক্টরের চিংড়ি এলাকার মধ্যে আমাদের পার্শে¦ পশ্চিম বাংলার ৫১,০০০ হেক্টর। একই আবহাওয়া, পানি, পরিবেশ, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছু। সেখানে ১০ বা ১২ বছর যাবত ভেনামি চিংড়ির চাষ হলে আমাদেরও চাষ করতে অসুবিধা কোথায়? চিংড়ি উৎপাদন ও রফতানি প্রতি বছর কমলেও এটি এখনও আমাদের রফতানি আয়ের দ্বিতীয় খাত। প্রথম খাত পোশাক শিল্প অনেক এগিয়ে। কাজেই ভেনামি চিংড়ির চাষ হলে আমাদের রফতানি বৃদ্ধি পাবে। এ সঙ্গে চিংড়ি চাষ ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত লাখ লাখ মানুষের দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে। এ খাতে ঘটতে পারত অনেক কিছু ।কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কারণে হয়নি। এটা ভেনামি চিংড়ির দোষ নয়। দোষ আমাদের। ভেনামি চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই এর জন্য গঠিত হয়েছে টেকনিক্যাল কমিটি। কাজ করছে পরীক্ষমূলক ভেনামি চিংড়ি চাষ সংক্রান্ত উপ-কমিটি। ২টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে খুলনার পাইকগাছার লোনা পানি কেন্দ্রের ৬টি পুকুরে ওই কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের ব্যবস্থাপনায় ভেনামি চাষের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে । উক্ত ২টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান করোণার কারণে থাইল্যান্ড থেকে পোনা আনতে পারেনি। তইি বিগত বছর সেখানে কোন পরীক্ষামূলক চাষ হয়নি। এ বছর তারা পুনরায় পোনা আনার চেষ্টা করছে। ভারত বা থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ায় ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরুর সময় আমাদের কার্যক্রম গ্রহণ বাঞ্চনীয় ছিল। যেহেতু বিলম্ব হয়েছে, কাজেই ২টি ছোট বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতার উপর নির্ভর না করে সরকারী উদ্যোগে ও খরচে এবং প্রয়োজনে বিশেষ কার্গো বিমানে এ চিংড়ি পোনা এনে পরীক্ষমূলক চাষের কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। যেহেতু আমরা খুব বেশি বিলম্ব করেছি, কাজেই প্রক্রিয়াটি এখন ত্বরান্বিত করা খুবই জরুরী ।
×