ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রণব মজুমদার

ঘুম চোখে আমেরিকা

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ২৭ মার্চ ২০২১

ঘুম চোখে আমেরিকা

- ওরে বাবারে! কতো বিদেশী মুদ্রা? ডলার, পাউন্ড, আরএমবি টাকা! দাঁড়ান দাঁড়ান আমি তুলে দিচ্ছি। - না না আমি তুলে নিতে পারবো। - আপনি বয়স্ক ভদ্রলোক ব্যক্তি। মানুষকে উপকার করা তো মানুষেরই দায়িত্ব! আমার গা লেগেই তো জিনিসগুলো পড়ে গেলো। মধ্য বয়সী লোকটির হাতব্যাগ থেকে নিচে পড়ে গেলো পাসপোর্ট ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা। ব্যাংকের কর্পোরেট শাখার সুবিশাল ফিটফাট ও মনোরম হাঁটার জায়গা। মুহিতের লক্ষ্য ছিলো বিদেশী মুদ্রা কেনাবেচার ৮ নম্বর কাউন্টারের দিকে। সামনে যে ভদ্রলোক ধীরে হেঁটে আসছেন তা মুহিত খেয়াল করেনি। মুহিত ভদ্রলোককে সোফায় নিয়ে বসালেন। - পানি খাবেন? আমার কাছে কাঁচের এক্সট্রা বোতলে পানি আছে। আমারটা আলাদা। - দাও বাবা! গলাটা শুকিয়ে গেছে সত্যি। সৃষ্টিকর্তা তোমার মঙ্গল করুন। মুহিতের ব্যাংকে আসার কারণ এবং বৃত্তান্ত জানলেন ভদ্রলোক। - বিশ্বে যত অশান্তি আমরা দেখছি তার কারণ হলো মুদ্রার দোষ। মুদ্রার প্রভাবে উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা যার যার মতো করে পারমাণবিক শক্তির ক্ষমতা দেখাচ্ছেন। বিশ্ব নেতৃত্বে ক্ষমতা দখলের লড়াই! আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বৈশি^ক জলবায়ু ও আবহাওয়ার ওপর। আমরাও সেই ক্ষতির শিকার! বেশ আলাপী মুহিত এবং কৌতূহলপ্রিয়। কথায় কথায় জানলো, ভদ্রলোকের নাম প্রজ্ঞাবান চৌধুরী। সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। অতিরিক্ত সচিব পদ মর্যাদায় একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে সর্বশেষ তিনি প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। ধানমন্ডিতে নিজের ফ্ল্যাটে বিপত্নিক এই ভদ্রলোক থাকেন। বিবাহিত মেয়েরা একজন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যজন ইংল্যান্ডে উচ্চতর গবেষণা কাজের সঙ্গে যুক্ত। নিঃসঙ্গ জীবন। মেধার গুণে এখন তিনি গবেষণা কাজে নানা দেশ ঘুরে বেড়ান। মুহিত বিজ্ঞানী ভদ্রলোককে তাঁর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। - আমার জন্য দোয়া করবেন আংকেল! ভদ্রলোক মুহিতের মাথা স্পর্শ করে বললেন - এই নাও আমার কার্ড। প্যারিসের কাজটা সেরে আসি। দেখা হবে আশা করি। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে বাবা। ভালো থেকো। মুহিত এসেছে দিলকুশায় ব্যাংকের এ শাখায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ১৫ দিন সময়ের একটি কর্মশালা। স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য এ আয়োজন। বিশ্ব ব্যাংকের সদস্যভুক্ত দেশের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নিচ্ছে। অংশগ্রহণকারী সকলের রিটার্ন টিকেট, থাকা ও খাওয়ার ব্যয় বহন করবে আয়োজক বিশ্ব ব্যাংক। স্কুলে ডিবেট ক্লাবের সকল প্রতিযোগিতায়ও সেরা মুহিত। মোহাম্মদপুরে নামকরা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে মুহিত। পড়াশুনায় শ্রেণীর বাইরে শিক্ষামূলক কার্যক্রমেও সে কৃতিমান। বেশ মেধাবী শিক্ষার্থী ও তার্কিক হিসেবে মুহিতকে ওর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করেছে। কর্মশালায় যোগ দিতে আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশে রওনা হবে মুহিত। মাল্টিপল ভিসা ৫ বছরের। বিমানের রিটার্ন টিকেট ব্যবস্থা আগেই সম্পন্ন হয়েছে। মুহিতের আব্বা বলেছেন, বিশাল দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র! অচেনা জায়গা, চেনাজানা নেই কেউ সেখানে। হাতে এক মাসের পকেট মানি থাকা জরুরি! দুই হাজার মার্কিন ডলার কিনে নিয়ে যাও। ওয়াশিংটন হোটেলে পৌঁছেই তো আয়োজকদের কাছে পয়সা পাওয়া যাবে না। অর্থই বিপদের বন্ধু! বাবা একই ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে এ শাখার সহকর্মী ব্যবস্থাপকের কাছে আব্বা এক লাখ আশি হাজার রেখে গেছেন কাল। কাউন্টার থেকে কর্মরত কর্মকর্তা মুহিতকে দিলেন ৩৭০০ টাকা এবং মুদ্রাক্রয়ের একটি ব্যাংক প্রত্যয়নপত্র ও পাসপোর্ট। ডলারের একশ’ মুদ্রামানের কুড়িটি নোট বুঝে নিলো মুহিত। ব্যাগে ঢুকালো সব। বাবার অফিসের গাড়ি করে এখানে এসেছে সে। জ্ঞানী পর্যটক ভদ্রলোকের কথা ভাবতে ভাবতে সে গাড়িতে ওঠে। রওনা দেয় মোহাম্মদপুর রিং রোডে ওদের বাড়ি অভিমুখে। ভালোই সে প্রস্তুতি। আম্মা দু’দিন আগে জামা কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে এটাচি বন্ধ করে রেখেছেন। এ ব্যাপারে ছোট ভাই রিয়াদ মাকে সাহায্য করছে। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র রিয়াদ শাহরিয়ার সাইন পেন দিয়ে সাদা একটি কাগজে ইংরেজিতে লিখেছে মুহিত শাহরিয়ার ৩৫ /৩ রিং রোড, মোঃপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ। নিচে আব্বার নাম, ইমেইল ও সেলফোন নম্বর। পরদিন মুহিতের মার্কিন মুল্লুকে যাত্রা! রাত সাড়ে আটটায় আব্বা রিফাত শাহরিয়ার, আম্মা নাসরীন সুলতানা ও ভাই রিয়াদ মুহিতকে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। এমিরেটসের বোয়িং ৭৭৭ সুপরিয়র বিমান। বিমানটি যখন টেক অফ করলো তখন রাত এগারোটা বেয়াল্লিশ মিনিট। মাঝখানে দুবাইয়ে দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। উড্ডয়নের সোয়া পাঁচ ঘণ্টা পর বিমানটি যখন দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবতরণ করলো তখন স্থানীয় সময় রাত দুইটা পঞ্চান্ন মিনিট। বিমানে প্রায় একদিন সময়ের ভ্রমণ এবং ১৫/১৬ দিনের সফর তাই ফিকশন, অর্থনীতি, মহাকাশ বিজ্ঞান ও ভ্রমণ কাহিনীর একাধিক বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে মুহিত। প্রথম বিমানে একা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তাই নানা চিন্তায় তার ঘুম আসেনি। বই পড়া ছাড়াও আসনের সামনে স্থাপিত টিভি মনিটরে একটি হলিউডের মুভি দেখেছে। আকাশযানে লম্বা ভ্রমণ। ওয়াশিংটনের ডোলস এয়ারপোর্ট বিমানটি যখন ল্যান্ড করলো তখন ওয়াশিংটন সময়ে বাজে সকাল ন’টা ১১ মিনিট। মনে হতে পারে মাত্রই তো সোয়া ন’ ঘণ্টার পথ। কিন্তু সূর্যের আবর্তন এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনে এরই মধ্যে বিমান ভ্রমণে মুহিতের কেটে গেছে প্রায় ২২ ঘণ্টা। এয়ারপোর্টে আয়োজকরা হোটেলে পৌঁছানোর জন্য গাড়ির ব্যবস্থা রেখেছে। মুহিতের থাকার ব্যবস্থা যে হোটেলে তার নাম অ্যাডাম’স ইন। ডাবল বেড। সুসজ্জিত প্রশস্ত ঘর! অত্যাধুনিক সব ধরনের ব্যবস্থা। কর্মশালায় অংশ নেয়া, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে কেটে গেল মুহিতের ১৭ দিন। ওয়াশিংটনের বাইরে যাওয়ার সাহস করল না সে। আয়োজক বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে মুহিত ঘুরে এসেছে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়, নাসা সদর দফতর, লিংকন মেমোরিয়াল, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, ইয়ার্ড পার্ক, কেনেডি সেন্টার, ইউনাইটেড স্টেটস, বোটানিক্যাল গার্ডেন, এশিয়ান আর্ট, আফ্রিকান আর্ট এবং ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। সকালে অফিসে যাবার সময় আব্বা দেখেন অনেক সময় অবধি বড় ছেলে ঘুমোচ্ছে! বাসায় রাখা মুহিতের শিয়রে থাকা আব্বার পুরানো অ্যান্ড্রয়েট ফোনসেটটার পাওয়ার সুইচ অফ করে দেন তিনি। তারপর নিচে নেমে গাড়িতে উঠে অফিসে রওনা দেন। প্রতিদিন সকালে আম্মা মুহিতের শোবার ঘরে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দেন। আজও তাই করলেন। সকালে এসে দেখেন মুহিতের বিছানায় জ্যাক কেওয়াকের অন দ্য রোড ফিকশন উপন্যাসের অনুবাদ বইটি। আমেরিকা ভ্রমণ কাহিনীর ওপর লেখা বইটির কথা আম্মাকে মুহিত আগে বলেছিল। আম্মা বুঝতে পেরেছেন বইটা শেষ করে ও ঘুমিয়েছে। আম্মা ওকে ডাকলেন সজোরে। - কিরে আর কত ঘুমাবি? অট অট বাবা! মুহিত ঘুমের ঘোরে ঘোংগাচ্ছে। আর অস্পষ্ট স্বরে বলছে - হোয়াইট হাউসে যাওয়া হলো না, ইসরে! হায় ডোনাল্ড ট্রাম্প! কাছে এসেও তোমাকে দেখার সুযোগ পেলাম না! মা মুহিতের মাথায় হাত স্পর্শ করতেই চোখ মেলে তাকালো সে। - কিরে বাজে স্বপ্ন দেখছিলি? দিক ওদিক তাকিয়ে মুহিতের উত্তর - আমিতো এতদিন আমেরিকায় ছিলাম আম্মু! অলঙ্করন : প্রসূন হালদার
×