ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ওয়াহিদা রহমান ও অন্যান্যের কথা

প্রকাশিত: ০১:০৭, ২৬ মার্চ ২০২১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ওয়াহিদা রহমান ও অন্যান্যের কথা

১৯৮৭-এর গ্রীষ্মকাল। একদিন বিকেল বেলায় মুম্বাইর প্রেসিডেন্ট হোটেলের লবিতে বসে মুম্বাইর বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ডাঃ গৌতম সেন, বাংলা সাহিত্যের দিকপাল শঙ্কর (মনি শঙ্কর) এবং আমি চা পান এবং গল্পগুজব করছিলাম। ডাঃ গৌতম সেন এফআরসিএস ইন্ডিয়া চাপ্তারের প্রেসিডেন্ট। সমস্ত ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদ। মনি শঙ্কর যিনি শুধু শঙ্কর নামে পরিচিত তাঁকে কোন বাংলা সাহিত্যপ্রেমীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। আমরা যখন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন দেশ পত্রিকার মুম্বাইর প্রতিনিধি সাংবাদিক সলীল ঘোষ এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। গৌতম সেন আমার সমবয়সী এবং পুরনো বন্ধু। তিনি সলীল ঘোষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ও বললেন, সলীল দা বাংলাদেশ এইড কমিটি (মহারাষ্ট্র) নামে একটি সংগঠন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্য তাঁর ওই সময়কার সাংগঠনিক কর্মকা- এবং পরিশ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে। এ কথা শুনে সলীল ঘোষ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আমি আর এমন কি করেছি? ওই সময় মুম্বাইর বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যারা বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন তাঁদের সম্পর্কে আমি অনেক তথ্য দিতে পারি। সলীল ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ। ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পূর্বে তিনি ব্রিটিশ রয়াল নেভীতে চাকরি করতেন। ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে মুম্বাইতে ভারতীয় সৈনিকরা যে বিদ্রোহ করেছিল, তার নেতৃত্ব যারা দিয়েছিলেন, সলীল ঘোষ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। আর ওই কারণে তিনি নৌবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। এরপর তিনি সাংবাদিক পেশায় যোগদান করেন। সলীল ঘোষের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে মনি শঙ্করের বলা একটি কথা বলে নিলে ভাল হবে মনে করি। তিনি বলেছিলেন, উপন্যাস লেখার চেয়ে ছোটগল্প লেখা অনেক কষ্টকর। এটা অনেকটা এ্যারোপ্লেন চালানোর মতো। বেশিরভাগ সাহিত্যিক ছোটগল্প লিখতে গিয়ে এ্যারোপ্লেনের মতো টেক অফ করেন। তারপর কিছু কথা চালাচালি করেন। গল্পটা শেষ করতে গিয়ে ধপাস করে ল্যান্ড করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া খুব কম সংখ্যক বাংলা সাহিত্যিক ভাল ছোট গল্প লিখেছেন। আমরা বাংলাদেশ বিমানের ককপিট ক্রুরা ফ্লাইটের যাত্রা বিরতির সময় মুম্বাইয়ের অবরয় হোটেলে থাকতাম। প্রেসিডেন্ট হোটেলের লবিতে আড্ডা দেয়ার পরের দিন সন্ধ্যা সাত-সাড়ে সাতটায় সলীল ঘোষ আমার হোটেলে এলেন। ডাঃ গৌতম সেন টেলিফোনে জানালেন, তিনি আটটার পরে আসবেন। মুম্বাইয়ে ডাক্তারদের চেম্বার বন্ধ করতে হয় সন্ধ্যা আটটার মধ্যে। সলীল দা ওই দিন আমার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দিয়ে বললেন, এর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী মুম্বাই চিত্র জগতের এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সে সময়ের কার্যকলাপের তথ্য বিবরণী এবং বেশ কিছু ছবি আছে। সলীল দা জানালেন ’৭১-এর ২৭ মার্চ মুম্বাইয়ের সব দৈনিক পত্রিকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালীদের হত্যাযজ্ঞ এবং বিভিন্ন স্থানে বাঙালীদের প্রতিরোধের সব সংবাদ ফলাও করে প্রকাশিত হয়। কয়েকদিন এমনি ধারায় বাংলাদেশে পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। এর ফলে মহারাষ্ট্রের সর্বত্র সাধারণ মানুষের বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তখন আমরা মনে করতে শুরু করি বাংলাদেশের জনগণের জন্য কিছু করার প্রয়োজন আছে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত বাঙালী সাংবাদিক সুব্রত ব্যানার্জির বাস ভবনে বেশ কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ব্যক্তি এক বৈঠকে বসেন এবং কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ও শরণার্থীদের সাহায্য করা যায় এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন। মুম্বাইয়ের খ্যাতিমান শিল্পপতি ও সমাজকর্মী মহিন্দ্র এ্যান্ড মহিন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপের মালিক মরিষ মহিন্দ্রকে সভাপতি এবং সলীল ঘোষকে অনারারি সেক্রেটারি নির্বাচিত করে বাংলাদেশ এইড কমিটি গঠিত হয়। ’৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মহারাষ্ট্রের গবর্নর ছিলেন, হায়দ্রাবাদের নবাব পরিবারের সন্তানÑ নবাব ইয়াবার আলী জং। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ এইড কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। নবাব ইয়াবার আলী জং ছিলেন একজন হৃদয়বানÑ উদারচেতা মানুষ। প-িতজন হিসেবে ভারতের বাইরেও তিনি পরিচিত ছিলেন। কোন সাম্প্রদায়িকতার চিহ্নও ছিল না তাঁর মধ্যে। এক সময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন তিনি। ওই সময় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ প্রতিহত করতে গিয়ে মুসলমান ছাত্রদের হাতে তিনি এমনভাবে প্রহৃত হন যে, সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। সলীল দার কথা শুনে মনে হলো, বাংলার বাইরে যে সব ব্যক্তি আমাদের স্বাধীনতার জন্য যারা যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন তাদের কার্যবিবরণী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখ থাকা উচিত। আমি বিশ্বাস করি এসব সম্মানিত ব্যক্তির তালিকায় নবাব ইয়াবার আলী জং, নবাব অব পতাউদি এঁনাদের নাম তালিকার একদম প্রথম দিকে স্থান পাবে। আওয়ামী সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে এঁনাদের অনেকের নাম সংগ্রহ করে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী সম্মাননা পদক দিয়েছেন। যাদের মৈত্রী সম্মাননা দেয়া হয়েছে, তাঁদের নিয়ে কী কোন গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে? আমার জানা মতে হয়নি। মৈত্রী সম্ভাবনা পাওয়ার যোগ্যদের অনেকের নাম বাদ পড়েছে। তাঁদের নাম এখনও সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। বিগত শতকের ন’য়ের দশকে ম্যাডাম খালেদা জিয়া যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তখন অনেক প্রচেষ্টায় উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা দীলিপ কুমারকে নিমন্ত্রণ করে বাংলাদেশে এনেছিলেন। ভেবেছিলেন, দীলিপ কুমার একজন মুসলমান। তাঁকে নিমন্ত্রণ করে আনতে পারলে বিএনপি নামের দলটির জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দীলিপ কুমার যে হিন্দু-মুসলমান বলে ধর্মীয় পরিচয়ের অনেক উর্ধের একজন মানুষ ছিলেন, এ কথা ম্যাডাম বুঝতে পারেননি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাঁর খুব ভাল করেই জানা ছিল। তিনি ছিলেন খুব উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষ। ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে দীলিপ কুমারকে প্রধান অতিথি করে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ওই সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বার বার শুধু বঙ্গবন্ধুর-প্রশংসাই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু এই উপমহাদেশেরই নয়, তিনি বিশ্বের অগ্রগণ্য ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। জিয়াউর রহমানের নাম তিনি একটি বারের জন্যও উচ্চারণ করেননি। মহারাষ্ট্রে যেসব পেশাজীবী এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোক মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন এবং অনেক বিষয়ে পরিশ্রম করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সংখ্যার বিচারে চিত্রজগতের শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই ছিলেন বেশি। সাংবাদিক, সহিত্যিকদের অবদানও কম নয়। শরণার্থীদের জন্য আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন ছিল যেমন, তেমনই প্রয়োজন ছিল নৈতিক সমর্থনেরও। এক কোটি শরণার্থীর বোঝা বহন করার দায়িত্ব ভারত সরকার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করতে পারত না। জনগণের সমর্থন ছিল বলেই ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িত হয়েছিল। শরণার্থী এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য আর্থিক সাহায্যে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন শিল্পপতিরা। জনসমর্থন সৃষ্টি করা এবং একই সঙ্গে আর্থিক সহায়তা দুটি কাজ এক সঙ্গে করেছিল, মুম্বাই চিত্রজগতের লোকরা এবং সাংবাদিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা। বাংলাদেশ এইড কমিটি সংগঠনে ১৮ জন ভাইস চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি, ট্রেজারার, জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং সদস্য সংখ্যা ছিল অনেক। অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান এবং শর্মিলা ঠাকুর ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান- চেয়ার পার্সনদের অন্তর্ভুক্ত। প্রথমে কমিটির অনারারি সেক্রেটারি ছিলেন মিসেস মাহবুব নসরুল্লাহ। পরে শারীরিক অসুস্থার কারণে ওই পদ থেকে তিনি অব্যাহতি নিলেও সব সময় সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। এইড কমিটি চালানোর সুবিধার জন্য কয়েকটি সাব কমিটি গঠন করা হয়। এই সাব কমিটিসমূহের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাঁরা বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া প্রচুর চাঁদার অর্থ সংগ্রহ করেন বিভিন্ন চ্যারিটি শো এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এ সবের মধ্যে ছিল, কাওয়ালি অনুষ্ঠান, মুসায়ারা বা কবিতা পাঠের আসর, ছবি প্রদর্শনী, পতাকা সপ্তাহ পালন ইত্যাদি। কবিতা পাঠের আসরে স্বরচিত কবিতা যারা পাঠ করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অভিনেত্রী মীনা কুমারী, শাবানা আজমীর বাবা কায়ফী আজমী এবং ভারতের শ্রেষ্ঠতম উর্দু ও হিন্দী ভাষার কবিরা। চ্যারিটি ড্রামা শোতে প্রতাপ শর্মার লেখা ‘বাংলাদেশ’ এবং মারাঠি ড্রামা ‘তুগলক’ খুব সফল হয়। ‘স্টার স্ট্রিং’ নামের শো সম্পর্কে সলীল ঘোষ বলছিলেন, ’৭১ পরে কোন উপলক্ষে মুম্বাইতে আজ পর্যন্ত এত বড় অনুষ্ঠান এবং মুম্বাই চিত্র জগতের সকল শিল্পীর এমন সমাবেশ ঘটেনি। ‘স্টার স্ট্রিং’ শোয়ের সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন কল্যাণজী, আনন্দজী এবং রাতুল দেববর্মণ। ’৭১-এ রাহুল নিজেই একটি গান গেয়েছিলেন। গানের কথা এবং সুরও ছিল তাঁর নিজের। ‘আমার একটি ছেলে ছিল/আমার একটি বউ ছিল’ নামের অমন আবেদনময় গান আমি জীবনে কমই শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ওই গানটি যখন প্রথম শুনি তখন আমার চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। রাহুলের বাবা শচীন দেববর্মণ ’৭১-এ বাংলাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে বহু অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। সুরকার সলীল চৌধুরীও অনেক অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। কিশোর কুমারও গান করেছেন। আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম বরিশাল জেলায়। বড় হয়েছি ওখানে মামা বাড়িতে। আমার মামা বাড়ির পাশের গ্রামেই ছিল অশোক কুমার, কিশোর কুমার এঁনাদের আদি নিবাস ছিল। ‘স্টার স্ট্রিং’ অনুষ্ঠানের প্রধান প্রধান গায়ক ছিলেনÑ কিশোর কুমার, শচীন দেববর্মণ, লতা মুঙ্গেশকর, মান্নাদে এবং আরও অনেকে। নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন শ্রীমতি জয়শ্রীটি, লক্ষ্মীছায়া, পদ্মা খান্না, বেলা বোস। মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন অভিনেতা প্রাণ ও রাম কামলানি। শিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন, শত্রুঘœ সিনহা এবং আসরানি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন অশোক কুমার, আশা পারেখ, অমিতাভ বচ্চন, অরুণা ইরানী, আসরানি, বিন্দু, দিলীপ কুমার, ধর্মেন্দ্র, হেমামালিনী, জিতেন্দ্র, জয়াভাদুড়ী, জনি ওয়াকার, কবির বেদী, মালা সিনহা, তনুজা, ওয়াহিদা রহমান এবং আরও অনেকে। অনুষ্ঠান চলেছিল ভোররাত পর্যন্ত। ‘স্টার স্ট্রিং’ নামের অনুষ্ঠানে এত লোকের সমাগম হয় যে চার্চগেটের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামের বিশাল চত্বরেও দর্শক-শ্রোতাদের স্থান সঙ্কুলান সম্ভব হয়নি। সলীল দাকে জিজ্ঞেস করেছিলামÑ আচ্ছা নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার অবদান বেশি? তিনি বললেন, বেশ পরিশ্রম করেছেন অনেকেই, তবে ওয়াহিদা রহমানের সমান কেউ না। তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের শূটিং বাতিল করে পর্যন্ত কাজ করেছেন। আমরা মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শীতের আগমনের কথা চিন্তা করে পুরনো কাপড়-চোপড় সংগ্রহ করেছি। নবেম্বর মাসে আমরা বিহার রাজ্যে স্থাপিত শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে ওই কাপড়-চোপড় বিতরণ করেছি। ওয়াহিদা রহমান পর্যন্ত মানুষের বাড়িতে গিয়ে অর্থকড়ি এবং কাপড়-চোপড় সংগ্রহ করেছেন। ওয়াহিদা রহমানের দেখা পাওয়াটাই ছিল যে কোন মানুষের জন্য একটা বড় ব্যাপার। ওয়াহিদা রহমানকেই আমার তখনকার মুম্বাই চিত্র জগতের সবচেয়ে সুন্দরী অভিনেত্রী বলেই মনে হতো। অভিনয় দক্ষতায় তাঁর সমকক্ষ তো কেউ ছিলেন না। তাই সত্যজিৎ রায়ের ছবি আরণ্যকে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে প্রিয় অভিনেত্রী মনে হয়েছিলেন, শর্মিলা ঠাকুর। এই দু’জন এবং নার্গিসের চেহারায় ছিল দারুণ একটা আভিজাত্যের ছাপ। মুম্বাইয়ের চিত্র জগতের মতো কলকাতার শিল্পীদের লোকদের মধ্যেও যে সাড়া পড়েছিল তা উপেক্ষা করার মতো নয়। এ প্রসঙ্গে আমি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমারের কথাই বলব। ’৭১-এর আগস্ট মাস। কয়েক দিনের জন্য কলকাতায় এসেছি। ওই সময় শুনলাম, উত্তম কুমার বাংলাদেশ শরণার্থী ফা-ে ১০ হাজার টাকা সাহায্য দিয়েছেন জানতে পেরে নাকশালপন্থী যুবকরা উত্তম কুমারের ভবানীপুরের বাড়িতে আক্রমণ করেছিল। উত্তম কুমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য কিছুদিনের জন্য মুম্বাই গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। ওই সময়ের একটা দিনের কথা মনে পড়ে। কলকাতার পুলিশ এক দিনে বেশ কিছু সংখ্যক নকশাল যুবককে গুলি করে হত্যা করেছিল। এরপর থেকে নকশালপন্থীদের উপদ্রব একদম কমে গিয়েছিল। নকশালপন্থীদের কঠোরহস্তে দমন করার সব কৃতিত্ব তখনকার পশ্চিম বাংলার গবর্নর সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের। মুম্বাই শহরের রাস্তায় যারা জুতা পালিশ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাঁরা যা করেছিল, সে কথা উল্লেখ করার মতো। ১৫ অক্টোবর ’৭১। মুম্বাই শহরের কয়েক শ’ ছেলে যারা জুতা পালিশ করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, ওই দিন তারা যা উপার্জন করেছে তার সবটাই মুক্তিযুদ্ধে খরচ করার জন্য মহারাষ্ট্র এইড কমিটির হাতে তুলে দেবে। জুতা পালিশ করে যে ছেলেরা, তাদের চাঁদার অঙ্কটা কত ছিল জানি না, তাদের হৃদয়টা যে খুব বড় ছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রায়ই মুম্বাই যেতাম। ১৫ অক্টোবর ’৭১-এর কথা মনে করে মুম্বাই শহরের রাস্তায় যারা জুতা পালিশ করে তাদের দেখলে সম্মান দিয়ে কথা বলি। এই প্রসঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি সময় ক্যাপ্টেন খালেক (বীর প্রতীক) ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দিন (বীরউত্তম) এবং আমাকে কলকাতায় যেতে হয়েছিল। আমাদের থাকতে হয়েছিল ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রটোকল মেনে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর খারোয়া আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন লাঞ্চ এবং ডিনার করতে পার্ক সার্কাস স্ট্রিটের একটি দামী রেস্তরাঁয়। ওখানে লাঞ্চ এবং ডিনারের সময় দেখতে পেয়েছিলাম আমাদের গোঁপওয়ালা একজন সেক্টর কমান্ডারকে। একজন সুন্দরী মহিলা ছিলেন তাঁর সঙ্গী। ওই সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রীকে আমি চিনতাম। সেক্টর কমান্ডার সাহেব যখন সুন্দরী গার্লফেন্ডকে নিয়ে ওই দামী রেস্তরাঁয় লাঞ্চ এবং ডিনার করছিলেন, তখন মুম্বাইয়ের রাস্তার জুতা পালিশ করার ছেলেদের কথা খুব মনে পড়ছিল। সম্ভবত এটা ২০১০ বা ২০১১ সাল। আওয়ামী লীগ সরকার মৈত্রী সম্মাননা দিয়েছিলেন ওইবার বেশ কিছু সংখ্যক ভারতীয় নাগরিককে। আমন্ত্রিত হয়ে চীন মৈত্রী ভবনে গিয়েছিলাম। মৈত্রী সম্মাননা গ্রহণ করতে এসেছিলেন, মুম্বাইয়ের অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান। সেই পঞ্চাশ বছর আগে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ‘সোল বা সাল’ ছবিটি দেখেছিলাম। তখন তাকে সিনেমার পর্দায় মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম। তখন থেকে তিনি ছিলেন আমার কাছে ‘স্বপ্নপুরীর রাজকন্যা।’ ওই ছবির গান গেয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়। মৈত্রী সম্মাননার অনুষ্ঠান শেষে, প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর স্টেজের ওপর উঠে সম্মাননা পাওয়া অতিথিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি গিয়ে ওয়াহিদা রহমানের সামনে দাঁড়ালাম। তিনি হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন। তাঁর সঙ্গে দু’মিনিট কথা হয়েছিল। তারপর তিনি বললেন, তাঁদের নিয়ে যে বাস হোটেলে সেটা অপেক্ষা করে আছে। তাই তাঁকে চলে যেতে হবে। করমর্দন করার সময় আমার স্বপ্নপুরীর রাজকন্যার হাতের স্পর্শ পেয়ে নিজেকে সেদিন ধন্য বলে মনে করেছিলাম।
×