শংকর কুমার দে ॥ প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার এমন ছয়জনের খুনের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ভয়ঙ্কর এক শীর্ষ জঙ্গী নেতা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার অভিযানে কয়েকবার ধরা পড়তে গিয়েও হাত ফসকে যাওয়া জিয়া এখন কোথায়? ধরা পড়ছেন না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আবারও অভিযান পরিচালনা শুরু করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে চিহ্নিত এই জঙ্গী নেতা মোবাইল ফোনসহ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে এখন ঘাপটি মেরে আত্মগোপন করে আছেন দেশের ভেতরেই। এই শীর্ষ জঙ্গী নেতা যতদিন পর্যন্ত ধরা না পড়বে ততদিন খুবই বিপদ। দীর্ঘ আট বছর পলাতক জীবনে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরার খুব কাছাকাছি চলে গেলেও শেষ পর্যন্ত চোখে ফাঁকি দিয়ে গা ঢাকা দেন। ধরার সব ধরনের ফাঁদ পেতে অভিযানে মাঠে নেমেছে বলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) দাবি।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রগতিশীল লেখক ব্লগার অভিজিত, নীলাদ্রি, দীপনসহ কয়েকজন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেজর জিয়ার দেশে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে তার নেটওয়ার্কের গ্রেফতার হওয়া অন্তত ৫০ জঙ্গী। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, মেজর জিয়া বাংলাদেশেই আছেন। তার দলের সিংহভাগই ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। এই কারণে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন। বিজ্ঞান লেখক অভিজিত হত্যার সময় ঘটনাস্থলের ১০০ ফিট দূরেই ছিলেন জিয়া। সেখানে উপস্থিত থেকে পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন। অভিজিত হত্যা মামলার চার্জশীটেও বিষয়টির উল্লেখ আছে। অভিজিত হত্যার রায় ঘোষণার পর থেকে কারও সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ।
তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের বিষয়ে ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনা সদর দফতর এক সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টায় সম্পৃক্ততার দায়ে দুই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সৈয়দ জিয়াউল হক পালিয়ে গেছেন। সংবাদ সম্মেলনে এটুকুই জানানো হয় তখন। আর তাকে ধরিয়ে দিতে ছবিসহ সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। এর চার বছর পর মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক ও ব্লগারদের হত্যায় সৈয়দ জিয়াউল হক জড়িত বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৬ সালে পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়, সৈয়দ জিয়াউল হক আল-কায়েদাপন্থী জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান। এই জঙ্গী সংগঠন ২০১৩ সাল থেকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাওয়ার পর এখন প্রায় এক বছর ধরেই তার জঙ্গী নেটওয়ার্কে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৩ সালে আনসার আল ইসলামের তাত্ত্বিক গুরু জসীম উদ্দীন রাহমানী গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেন, রাজধানীর বছিলায় যে মসজিদে তিনি খতিব ছিলেন সে মসজিদে যাতায়াত ছিল জিয়াউল হকের। যোগাযোগ ছিল ইমেলেও। এরও প্রায় তিন বছর পর ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাড্ডার সাঁতারকুলে একটি অভিযানের পর পুলিশ সংগঠনটির কাঠামো সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। তারা জানতে পারে, এই সংগঠনের সামরিক প্রধান জিয়াউল হক। বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক অভিজিত রায়সহ ছয়জন মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার খুনের বিচার শেষে আবারও আলোচনায় এসেছেন সৈয়দ জিয়াউল হক। ছয়টি খুনের ঘটনাতেই তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। প্রশ্ন উঠছে, তিনি কোথায়? ধরা পড়ছেন না কেন?
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসির সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত সৈয়দ জিয়াউল হক কোথা থেকে কোথায় গেছেন, তার একটা চিত্র পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাকে গ্রেফতারের খুব কাছাকাছি গিয়েছিল অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ। রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুলে দীর্ঘ সময় ছিলেন তিনি। ঢাকা, টঙ্গী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহে কয়েকবার অভিযান পরিচালনায় পুলিশের খুব কাছকাছি থেকে সটকে পড়তে সক্ষম হয় দুর্ধর্ষ এই শীর্ষ জঙ্গী নেতা। বিভিন্ন চেহারায় সৈয়দ জিয়াউল হকের ছবি স্কেচ করে তাকে ধরার চেষ্টা করা হয় যাতে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে না পারে তিনি। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত এই ভয়ঙ্কর জঙ্গী নেতা ধরা না পড়বে ততদিনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তিনি এক ভয়াবহ বিপজ্জনক।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামসহ তার জঙ্গী নেটওয়ার্কের অন্তত অর্ধশত জঙ্গী সদস্যদের গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে কারাও সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে না জিয়া। তার মোবাইল ফোন বন্ধ। ইমেল নেই। ভার্চুয়াল যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর ৪০ দিন পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেখানে দুটি সন্তান আছে জিয়ার। তবে বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তার শ্বশুরসহ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করেছে পুলিশ। স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেন জিয়া। পুলিশ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে তার হদিস পাওয়ার জন্য। চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াকে ধরতে পুলিশের সর্বাত্মক অভিযান চালাচ্ছে বলে সিটিটিসির কর্মকর্তার দাবি।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: