ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছেলের গায়ের রং নিয়ে বাকিংহাম প্যালেসের উদ্বেগ ছিল

ব্রিটিশ রাজপরিবারেও বর্ণবাদ রয়েছে, মুখ খুললেন মেগান

প্রকাশিত: ২৩:১২, ৯ মার্চ ২০২১

ব্রিটিশ রাজপরিবারেও বর্ণবাদ রয়েছে, মুখ খুললেন মেগান

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ ব্রিটিশ রাজপরিবারের জৌলুসপূর্ণ জীবনে থেকেও ভাল ছিলেন না প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী ও সাবেক মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কল। ডাচেস অব সাসেক্স বলেছেন, বিয়ের কিছুদিন পর থেকে পরিবারের মধ্যে থেকেও তিনি এত বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিলেন যে একটা সময় বেঁচে থাকার ইচ্ছাই হারিয়ে ফেলেন। ভাবছিলেন আত্মহত্যা করবেন। খবর বিবিসি, সিএনএন ও সিবিএস নিউজের। জনপ্রিয় মার্কিন উপস্থাপিকা অপরাহ্ উইনফ্রেকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে কয়েক শ’ বছরের পুরনো ব্রিটিশ রাজ পরিবার সম্পর্কে অনেক অজানা ও অপ্রিয় কথা বলেছেন হ্যারি ও মেগান দম্পতি। ৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় রবিবার রাতে সিবিএস টিভিতে সাক্ষাতকারটি প্রচারিত করা হয়। ‘অপরাহ্ উইথ মেগান এ্যান্ড হ্যারি : এ সিবিএস প্রাইমটাইম স্পেশাল’ শিরোনামের বিশেষ টিভি শোটি যুক্তরাজ্যের আইটিভিতেও স্থানীয় সময় সোমবার রাত ৯টায় প্রচারিত হয়। রাজপরিবারের দায়িত্ব ছাড়ার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করার পর থেকে এ পর্যন্ত এটিই মেগানের দেয়া প্রথম সাক্ষাতকার। সাক্ষাতকারে হ্যারিও প্রাসাদ জীবনে নিজের অনেক অপ্রিয় অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন। এই বহুল প্রতীক্ষিত সাক্ষাতকারটি এমন এক সময়ে এলো যখন একদিকে মেগান-হ্যারি এবং অন্যদিকে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের মধ্যে তিক্ত বিবাদ চলছে। উইনফ্রের এক প্রশ্নের জবাবে মেগান বলেন, বাকিংহাম প্যালেসের একজন শিকারে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। তার ছেলে আর্চির গায়ের রং কত কালো হতে পারে, সে অনুমান করা থেকে শুরু করে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কতবার মধ্যাহ্নভোজে গেছেন সবকিছুতে নাক গলাত প্যালেস। যখন আর্চি গর্ভে ছিল তখন তাকে জানানো হয়, তার সন্তানকে প্রিন্স উপাধিতে ভূষিত করা হবে না; যদিও এটি ছিল প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম। এটি তাকে মর্মাহত করেছিল। তারা আশা করছেন তাদের দ্বিতীয় সন্তান হবে মেয়ে। রাজপরিবারের কে বা কারা গায়ের রং নিয়ে উদ্বেগের কথা বলেছিল, তা প্রকাশ করেননি মেগান। তিনি নিজেই সে সময় চুপ ছিলেন, না তাকে চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছিল- এই প্রশ্নে মেগান বলেছেন- ‘পরেরটি’। উইনফ্রের সঙ্গে আলোচনায় রাজপরিবারে কাটানো জীবনের নানা জটিলতার কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্না আটকাতে চেষ্টা করেন মেগান। বলেন, বেঁচে থাকার ইচ্ছেই চলে গিয়েছিল। জীবন অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিতে পারছিলেন না। ওই সময় কথাগুলো প্রকাশ করতে আমি সত্যি লজ্জা পাচ্ছিলাম। বিশেষ করে হ্যারিকে বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। কেননা, আমি জানতাম, সে নিজেই এই পরিবারে কতটা ভুক্তভোগী। তবে এ-ও জানতাম, আমি যদি না বলি, তবে তা (আত্মহত্যা) করেই ফেলব... আসলে আমি আর বেঁচে থাকতে চাইছিলাম না। রাজপরিবারে থাকাকালীন তার মনে হয়েছিল, ব্রিটিশ গণমাধ্যমও শতাব্দী প্রাচীন বাকিংহাম প্যালেসের চক্রান্তের শিকার। রাজপরিবারের সদস্যদের ভাল-মন্দ দেখার চেয়ে তাকে (মেগান) কেমনভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে, সেটি নিয়েই বেশি আলোচনা চলছিল। হ্যারিকে বিয়ে করার পর রাজপরিবারে কিভাবে নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে আরও কিছু অভিযোগ করেন মেগান মার্কল। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের খুব বেশি নজরে পড়ায় একপর্যায়ে বন্ধুদের সঙ্গে তার মধ্যাহ্নভোজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। অবস্থা এমন যে আমি সবখানে আছি, কিন্তু আমি কোথাও নেই। রাজপ্রাসাদে থাকা নিজের জন্য অসহনীয় বোঝা হয়ে উঠলে মেগান বাকিংহাম প্যালেসের মানবসম্পদ বিভাগের সহায়তা চান। এ সময় তাকে বলা হয়, তিনি প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মী নন। তাই তাকে অন্য কোথাও সহায়তা চাইতে হবে। ডাচেস অব সাসেক্স বলেন, হ্যারিকে বিয়ে করার পর রাজপরিবার নিজে থেকেই তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু বাকিংহাম প্যালেসকে যারা চালান, তাদের থেকে পরিবারটির সদস্যরা ছিলেন আলাদা রকমের। তবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সব সময়ই ছিলেন একজন চমৎকার, আন্তরিক ও শুভাকাক্সক্ষী মনের মানুষ। প্রিন্স হ্যারির বড় ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের স্ত্রী ডাচেস অব ক্যামব্রিজ কেটের সঙ্গে নিজের বিরোধ নিয়ে প্রচলিত গুজব সম্পর্কেও কথা বলেন মেগান। বলেন, পোশাক নিয়ে কেটকে কাঁদিয়েছিলেন তিনি এমন খবর সঠিক নয় বরং সত্য হলো, তিনি (মেগান) নিজেই কেঁদেছিলেন। হ্যারি সাক্ষাতকারে বলেন, মেগান মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও রাজপরিবার থেকে কোন সাহায্য পায়নি। এ নিয়ে কথাও হতো না। হ্যারি আরও বলেন, মেগানের সঙ্গে তার সম্পর্কই তাকে বাঁচিয়েছে। এ সময় মেগান তার কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, বরং হ্যারির সিদ্ধান্তই পুরো পরিবারকে টিকিয়েছে। তখন হ্যারি বলেন, আমাদের যা করা উচিত ছিল, আমরা সেটিই করেছি। রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিষয়ে হ্যারি বলেন, তিনি সব সময় তার বাবা প্রিন্স চার্লসকে ভালবাসবেন। কিন্তু তার আচরণও তাকে ‘হতাশ’ করেছে। ভাই প্রিন্স উইলিয়াম সম্পর্কে হ্যারি বলেন, তিনি তাকেও ভালবাসেন; তবে তাদের দুজনের পথচলা ভিন্ন। তিনি আরও বলেন, আমি তাকে ভালবাসি, আগেও যেমনটা বলেছি। তিনি আমার ভাই এবং আমরা একসঙ্গে একই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা একই। তবে আমরা আলাদা পথে আছি। সাক্ষাতকারের একপর্যায়ে হ্যারি ও মেগান দুজনই বলেন, যদি প্যালেসের সবার সমর্থন পেতেন, তবে রাজপরিবারের সদস্য হয়েই তারা থেকে যেতে পারতেন। হ্যারি অপরাহ্কে জানান, মেগান ও রাজপরিবারের মধ্যে সম্পর্কের মোড় পাল্টে যায় অস্ট্রেলিয়ায় তাদের সফরে যাওয়ার পর। সেখানে সাধারণ মানুষ ও কমনওয়েলথের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মেগান যেভাবে নির্দ্বিধায় মিশে যান, তাতে রাজপরিবারের সদস্যরা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়ায় যে মেগানের মধ্যে মা প্রিন্সেস ডায়ানার পরিণতিই দেখতে পাচ্ছিলেন। হ্যারি বলেছেন, তিনি রাজপরিবারের দায়িত্ব ছেড়েছেন বোঝাপড়ার সঙ্কটের কারণে। তাছাড়া তার ভয় ছিল, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবার না ঘটে। ১৯৯৭ সালে নিজের মা প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন তিনি। বলেছেন, নিজের দাদি, ব্রিটিশ রানীকে তিনি অন্ধকারে রাখতে চাননি, কারণ তাকে তিনি খুবই শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু বাবা প্রিন্স চার্লস তার ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। দাদির সঙ্গে আমার এ নিয়ে তিন দফা কথা হয়েছিল। আর বাবা ফোন ধরা বন্ধ করে দেয়ার আগে তার সঙ্গেও দুই দফা কথা হয়েছে। পরে উনি আমাকে বলেছিলেন, আমি সব কথা তাকে লিখিতভাবে জানাতে পারি কিনা। এক বছর আগে হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান রাজপরিবারের দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারও সঙ্গে কোন আলোচনা না করে তাদের নেয়া এ সিদ্ধান্তে তোলপাড় সৃষ্টি হয় রাজপরিবারে। ওই সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছিলেন বিশ্ববাসী। এই দম্পতি জানিয়েছিলেন, তারা স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে চান। সম্প্রতি হ্যারি ও মেগান জানিয়ে দেন, তারা আর কখনও রাজদায়িত্বে ফিরছেন না। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথও ডিউক অব সাসেক্স ও ডাচেস অব সাসেক্সকে তাদের রাজকীয় উপাধি এবং রাজপরিবার থেকে পাওয়া সুযোগ-সুবিধা বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজকীয় দায়িত্ব ছাড়ার পর গত বছর হ্যারি ও মেগান যুক্তরাষ্ট্রের লস এ্যাঞ্জেলেসে চলে যান। এরপর থেকে এক নতুন জীবন শুরু করেছেন এই দম্পতি। সিবিএস নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গ মা আর শ্বেতাঙ্গ বাবার ঘরে জন্ম নেয়া মেগান সাক্ষাতকারে বলেন, ২০১৮ সালে রাজপরিবারে বিয়ে হওয়ার আগে তিনি ছিলেন সাদাসিধে জীবনের মানুষ। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর অসহায়ত্ব বোধ তাকে গ্রাস করেছিল। সিবিএস টেলিভিশন ওই সাক্ষাতকারের ৩০ সেকেন্ডের একটি টিজার প্রকাশ করেছিল কয়েকদিন আগেই। তখন থেকেই সবার আগ্রহ ছিল এই সাক্ষাতকার নিয়ে। রয়টার্স লিখেছে, এই সাক্ষাতকার তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পর্ক আরও তিক্ত করে তোলার প্রেক্ষাপট তৈরি করল। এদিকে হ্যারি- মেগানের সমালোচকরা বলেন, রাজপরিবারের দায়িত্বে যে নিষ্ঠা প্রয়োজন, তার বদলে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন ‘গ্ল্যামারকে’। অন্যদিকে তাদের সমর্থকদের ভাষায়, সেকেলে ব্রিটিশ ধ্যানধারণা যে এখনও বর্ণবাদের চেতনা বহন করে চলেছে মেগানের প্রতি তাদের আচরণই তার প্রমাণ।
×