ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভুদের ভুলতে পারেনি ॥ ওরা এখনও পালিত সারমেয় দল হিসেবেই আছে

প্রকাশিত: ২৩:১১, ৯ মার্চ ২০২১

প্রভুদের ভুলতে পারেনি ॥ ওরা এখনও পালিত সারমেয় দল হিসেবেই আছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, এরা (বিএনপি) এখনও তাদের পুরনো প্রভুদের (পাকিস্তান) ভুলতে পারেনি। পাকিস্তানের দালালি, তোষামোদ ও চাটুকারিতার কথা ভুলতে পারেনি। তারা তাদের (পাকিস্তান) পালিত সারমেয় দল হিসেবেই এখনও আছে। এটাই হলো বাস্তবতা। তিনি বলেন, যে (জিয়াউর রহমান) পাকিস্তানী হানাদারদের সঙ্গে বাঙালীদের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা, যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যে (জিয়াউর রহমান) রাজনৈতিক দলের জন্ম দেয়, সেই দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভাষা ও মর্ম বুঝবে না, এটাই তো খুব স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তাই মুষ্টিমেয় কিছু লোক কী বলল, সে ব্যাপারে আমাদের কোন কথা বলা বা চিন্তা করার কিছু নেই। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে সোমবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে যারা (মুক্তিকামী বাঙালী) হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল, তাদের অনেককে জিয়াউর রহমান গুলি করে হত্যা করে। শুধু তাই না, পাকিস্তানী সেনা অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান ২৫ ও ২৬ মার্চ দুই দিনই হত্যাকাণ্ড চালান। ২৭ মার্চ সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে গিয়েছিল এই জিয়া। তিনি যাতে অস্ত্র নামাতে না পারেন, আমাদের স্বাধীনতাকামীরা তাকে আটকান। সরকারপ্রধান প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে, যারা এদেশটাকে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ক্ষমতা নিয়ে দেশের মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি। যারা এদেশটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়- তাদের তৈরি করা রাজনৈতিক দলের (বিএনপি) কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ কী আশা করে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মেরিনা জাহান, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী এবং উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। গণভবন প্রান্ত থেকে আলোচনা সভা পরিচালনা করেন দলের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। অনুষ্ঠানে মুজিববর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ‘মুক্তির ডাক’- এর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রতিটি অর্জনে বাঙালীদের অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তারা ক্ষমতা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই জানতেন যে, নির্বাচনে জিতলেও পাকিস্তানীরা বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা দেবে না, লড়াই করেই স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, সেজন্য সব প্রস্তুতি আগে থেকেই করে রেখেছিলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি অক্ষরই ছিল একেকটি নির্দেশনা। অতীতে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানীদের অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা, বঞ্চনার ইতিহাসের বর্ণনার পাশাপাশি ভাষণে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যতে কী করণীয় সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সর্বাত্মক গেরিলা যুদ্ধের জন্য ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করার পাশাপাশি শেষাংশে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম বলার মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার যে নির্দেশনা ৭ মার্চের ভাষণে দিয়ে গেছেন, সেই নির্দেশ বাঙালীরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে জনযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর মূল শক্তিই ছিল দেশের জনগণের শক্তি। সেই শক্তি নিয়েই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে। যারা বাঙালীর এই বিজয় মেনে নিতে পারেনি, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আবার গড়ে উঠছে, বাংলাদেশ আবার উন্নত-সমৃদ্ধ হবে- এটা যারা মেনে নিতে পারেনি, তারাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট চরম আঘাত হানে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে স্বাধীনতার পর ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশের সেই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ বাজানোও নিষিদ্ধ করা হয়, ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী শত বাধা, নির্যাতন উপেক্ষা করেই প্রতিবছর সারাদেশে তারা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজিয়েছে। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক নেতারই ভাষণ রয়েছে, যে ভাষণগুলো একদিন পরই হারিয়ে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু আজও ভাষণটির আবেদন এতটুকুও কমেনি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, দেশের একটি মুষ্টিমেয় একটি শ্রেণী আছে যারা এই ভাষণের মধ্যে কিছুই খুঁজে পায় না, কিছুই বোঝে না। তারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিষিদ্ধ করতে পারলেও আন্তর্জাতিকভাবে এই ভাষণটি তার জায়গা করে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ গবেষকদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণ নিয়ে গবেষণা করার কথা তুলে ধরে বলেন, ৪৩১ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সব ভাষণ নিয়ে তারা গবেষণা করে। সেই গবেষণায় মাত্র ৪১টি শ্রেষ্ঠ ভাষণ নিয়ে তারা একই বই প্রকাশ করেছে। সেই শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ অন্যতম হিসেবে সেখানে স্থান পেয়েছে। যে ভাষণে একটি জাতিকে অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করেছে। তিনি বলেন, দেশের কিছু নির্বোধ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যে কিছু খুঁজে না পেলেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের গবেষণায় সেটি ঠিকই উঠে এসেছে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ঘোষণা করে ওয়াল্ড হেরিটেজ হিসেবে রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটি ঘোষণা এককভাবে নয়, জাতিসংঘভুক্ত সব দেশের ভোট ও সমর্থন নিয়েই ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়েছে বলেও উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৭ মার্চের ভাষণের পর বিশ্বখ্যাত নিউজ উইকের নিউজে বঙ্গবন্ধুকে পোয়েট অব পলিটিক্স (রাজনীতির কবি) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের নির্দেশনা মুক্তিপাগল বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারলেও পাকিস্তানী হানাদারদের দালাল, চাটুকার, তোষামদকারীর দলের নেতারা কিছু বোঝেন না! একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের সময়ের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই সময় পাকিস্তানী শাসকদের পরিকল্পনা ছিল ও অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু কিছু বললেই আক্রমণ করে বোমা মেরে সমাবেশে উপস্থিত সবাইকে হত্যা করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সত্যিই ছিলেন একজন রাজনীতির কবি। বঙ্গবন্ধু ভাষণে কী বললেন বা কী নির্দেশনা দিলেন তা দেশের মানুষ ঠিক বুঝতে পেরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেও শত্রুপক্ষের বুঝতে দেরি হয়েছিল। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, একজন দক্ষ রণকৌশলী ছিলেন। পাকিস্তানীরা যে কোন মুহূর্তে আক্রমণ করতে পারে, তার জন্য কিন্তু সব রকম প্রস্তুতি এবং সব নির্দেশনা বঙ্গবন্ধু ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের দিয়ে গিয়েছিলেন। কোথায় যেতে হবে, কি করতে হবে, কোথায় থেকে অস্ত্র আসবে, কীভাবে ট্রেনিং হবে- সব ব্যবস্থাই তিনি করে গিয়েছিলেন। সবাইকে চলে গিয়ে প্রস্তুতি নিতে বললেও বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থেকে গিয়েছিলেন। তার কারণ যে, এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা যদি দেয়, সেই ঘোষণা অনেক সময় ব্যর্থ হয়। এটা অনেক দেশেই হয়েছে, অতীত ইতিহাস আছে। কাজেই আমাদের এই সংগ্রামটা যেন কোনমতে ব্যর্থ না হয়, আমাদের স্বাধীনতা যেন অর্জিত হয়- সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর একমাত্র লক্ষ্য। সেজন্য নিজের জীবনের যত ঝুঁকিই হোক- বঙ্গবন্ধু তা নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা জিয়াউর রহমান ॥ বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে মুহূর্তে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালাল, সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পিলখানার ইপিআরের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে প্রচার করা হয়। রেডিও, টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীন বাংলা অর্থাৎ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকেও ঘোষণাটি প্রচার করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতারা একের পর এক সেই ঘোষণার কথা প্রচার করতে থাকে। সেই সময় আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী সাহেব বললেন, আমরা তো ঘোষণা দিয়েই যাচ্ছি, সেবাবাহিনীর কাউকে নিয়ে আসো, তাহলে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ মনে হবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ওই সময় মেজর রফিক (সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম) এ্যামবুশ করে বসে ছিলেন। প্রথমে মেজর রফিককে এসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি রেডিওতে পাঠের কথা বলা হয়। তখন মেজর রফিক বলেন, আমি এখানে এ্যামবুশ করে বসে আছি, আমি যদি এখান থেকে সরে যাই তাহলে পাকিস্তানীরা এই জায়গাটা দখল করে নেবে। তখন জিয়াউর রহমান যেহেতু জনগণের কাছে ধরা ছিল, তাকেই ধরে নিয়ে এসে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটা পাঠ করতে বলা হয়। সেইভাবেই পরে জিয়াকে তারা (বিএনপি) ঘোষক বলে প্রচার চালায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে (জিয়াউর রহমান) ২৫ মার্চ রাতে, ২৬ মার্চ রাতে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানী অফিসার হিসেবে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে, সে কথাটা সবাই ভুলে যায়। কারণ সে (জিয়া) তো আগাগোড়াই পাকিস্তানের দালালি করে আসছিল। তার জন্মই তো ওখানে (পাকিস্তান)। লেখাপড়াও পাকিস্তানে। চাকরি সূত্রে এখানে এসেছিল। সেই সূত্রে বিবাহ করে পরবর্তীতে থেকে যায়। এই তো বাস্তবতা। তারপরও যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সকলকেই কিন্তু সম্মান দেয়া হয়েছে। জিয়াকে মেজর থেকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আর সেই (জিয়া) বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিল এবং ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল। সরকারপ্রধান এ সময় প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে, যারা এদেশটাকে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ক্ষমতা নিয়ে দেশের মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি। যারা এদেশটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়- তাদের (জিয়া) তৈরি করা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ কী আশা করে? ২৫ মার্চ রাতে বাঙালীর ওপর গুলি চালিয়েছিল জিয়া ॥ বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর হামলা করে। জাতির পিতা ওই সময় বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুতি নাও। রাস্তাঘাট যা কিছু আছে সব বন্ধ করে দাও। সারাদেশেই তখন বাঙালীরা ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। চট্টগ্রামে যারা রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল ২৫ মার্চ রাতে, তাদের উপরে যারা গুলি চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমানও একজন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে যেসব সংগ্রাম পরিষদের বাঙালীরা ব্যারিকেড দিচ্ছিল এই জিয়াউর রহমান গুলি করে তাদের অনেককে হত্যা করে। চট্টগ্রামে যারা মুক্তিযোদ্ধা, অনেকের কাছে জিজ্ঞাসা করলে এ তথ্য পাওয়া যাবে। বিদেশেও আছে, দেশেও অনেক আছে। তিনি বলেন, শুধু তাই না, জিয়াউর রহমান ২৫/২৬ মার্চ এই দুই দিন হত্যাকাণ্ড চালায়। ২৭ মার্চ যাচ্ছিল সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে। যে যাতে অস্ত্র নামাতে না পারে সেজন্য আমাদের যারা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ছিলেন তারা তাকে বাধা দিয়েছিল, সাধারণ জনগণ বাধা দিয়েছিল। সেখানেই জিয়াউর রহমানকে তারা আটকায়। জিয়াউর রহমানকে আটকিয়ে ছিল, যেন সে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে না পারে। তিনি বলেন, গণহত্যা শুরুর পরও যে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে যায়, জাতির পিতাকে হত্যা করে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করে যে (জিয়া) নিজেকে অবৈধ ক্ষমতাদখলকারী হিসেবে নিজে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে, অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসে সে দল গঠন করেছে, সেই দলের নেতারা ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা বুঝবে না, মর্ম বুঝবে না- এটা তো খুব স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এরা এখনও সেই পুরনো প্রভুদের ভুলতে পারেনি। কাজেই তারা কিছু বুঝবে না। শেখ হাসিনা বলেন, আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মাত্র ১২ বছরের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে জাতির পিতার যে স্বপ্ন ছিল মধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ; আমরা সেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। এটা বোধ হয় তাদের (বিএনপি) একটুও পছন্দ না। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হোক, স্বাধীনতা সফল হোক, বাংলাদেশের মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, সুন্দর জীবন পাবে, উন্নত জীবন পাবে, বাংলাদেশের মানুষ উন্নত হবে- এটা তো তাদের পছন্দ না। কারণ তাদের (বিএনপি) কাছে ক্ষমতা ছিল ভোগের বস্তু। হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে, বিলাস ব্যসনে জীবন ভাসিয়েছে। কাজেই তারা এদেশের মানুষের দুঃখকষ্ট বুঝবে কীভাবে? ইতিহাসকে তারা বিকৃত করেছে নিজেদের স্বার্থে। বিএনপির সব নেতাই করোনার টিকা নিচ্ছে ॥ দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ওরা (বিএনপি) কি বলল, এটা নিয়ে আমাদের কথা বলার দরকার নেই, এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করারও কিছু নেই। আমরা জনগণের পাশে আছি। আমরা জনগণের জন্য কাজ করি। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে তিনি বলেন, এই করোনাভাইরাসের সময় কত কথাই তো তারা (বিএনপি) বলেছে। এমনকি টিকা নিয়েও তো কত কটুক্তি? কিন্তু সেই টিকা তাদের (বিএনপি) নিতে হলো। আমি সরকারে আছি, পয়সা দিয়ে টিকা এনে বিনা পয়সায় দিচ্ছি। আর সেই বিনা পয়সায় টিকা তো তারা নিয়েছে। বিএনপি নেতারা, সবাই নিয়েছে। কিন্তু তার আগে বিএনপি নেতাদের কথাগুলো কি ছিল? তাই ওরা অনেক কথাই বলবে, কাজেই এটা নিয়ে আমার মনে হয়, আলোচনা করে সময় নষ্ট না করাই ভাল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু এদেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে বিজয়ী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন। তাঁর যে স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন- সেটাই আমরা করে যাচ্ছি। আমরা একটানা ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছি বলেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছেও একটা মর্যাদাপূর্ণ দেশ। বিশ্ব এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করার পর বিজয়ী জাতি হিসেবে জাতি মর্যাদা পেয়েছিল। সেই মর্যাদাই আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরাও জনগণের পাশে আছি। আর জনগণের কল্যাণ করাই আমাদের লক্ষ্য। মুজিববর্ষে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাংলাদেশের একটি মানুষও ভূমিহীন, গৃহহীন থাকবে না। প্রতিটি মানুষের জন্য একটা ঠিকানা আমরা করে দেব। সেই পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি এবং সেটা আমরা বাস্তবায়ন করছি। ইনশাল্লাহ, আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলবোই।
×