ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দণ্ডিত ৪৭ যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে পুলিশ

প্রকাশিত: ২২:০৬, ৮ মার্চ ২০২১

দণ্ডিত ৪৭ যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে পুলিশ

শংকর কুমার দে ॥ স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর এই মার্চ মাসে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে আদালতে মৃত্যুদণ্ড ও আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পালিয়ে বেড়ানো ৪৭ যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে পুলিশ। বিগত আট বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত মৃত্যুদণ্ড ও আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এসব যুদ্ধাপরাধী। পলাতক ৪৭ যুদ্ধাপরাধী আসামির মধ্যে ৩৫ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও ১২ জন আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্যসহ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এসব যুদ্ধাপরাধীকে সাজা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর পলাতক এই যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুন্যাল আদালতে ৪২ মামলায় রায় হয়েছ এসব যুদ্ধাপরাধীর। আদালতের রায়ে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের অর্ধেকই পলাতক থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিগত ১১ বছরে যুদ্ধাপরাধী মামলার রায় হয়েছে ৪২টির। এই ৪২ মামলায় আসামির সংখ্যা ১০৬। এই ১০৬ আসামির মধ্যে মৃত্যুদণ্ড ও আমৃত্যু কারাদণ্ড সাজা হয়েছে ৯৬ জনের। এর মধ্যে ৪৭ জন আসামি পলাতক। পলাতক যুদ্ধাপরাধী আসামি ৪৭ জনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ৩৫ জন ও আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ১২ জন। পলাতক দণ্ডিত আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে পুলিশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালত থেকে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর একটি তালিকা পাওয়া গেছে। এতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ৩৬ আসামি এখনও পলাতক আছেন, তারা গ্রেফতর হওয়ার পর পরই তাদের দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব। কারণ ট্রাইব্যুনালে এসব আসামিদের বিরুদ্ধে যে রায় এসেছে, তার বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপীল করা হয়নি। গ্রেফতার হলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে কারও জন্য আর আপীলের কোন সুযোগ নেই। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের ক্ষেত্রেও আপীল করার কোন সুযোগ নেই, তারা গ্রেফতার হওয়ার পর আমৃত্যু কারাগারে থাকতে হবে। তবে তার মৃত্যুপরোয়ানা জারি হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ যে কারই থাকে। যে কারণে ট্রাইব্যুনালের রায়ই চূড়ান্ত হিসেবে তাদের খুঁজে বের করে ফাঁসি কার্যকরের জন্য পলাতক দণ্ডিতদের খুঁজছে পুলিশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ট্রাইব্যুনালের একজন পাবলিক প্রসিকিউটর বলেছেন, পলাতক এসব আসামিদের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্র তাদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করেছিল। তাদের জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়েই ট্রাইব্যুনালে বিচার নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হলে ট্রাইব্যুনালের আর কোন দায়িত্ব থাকে না। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর দণ্ড কার্যকরের দায়িত্ব এসে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মতো ট্রাইব্যুনালের মামলার পলাতক আসামি কেউ দেশের বাইরে থাকলে তাকে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালেরও দায়িত্ব আছে। এই তিন মন্ত্রণালয় একাত্তরের মানবতাবিরোধী পলাতক দণ্ডপ্রাপ্তদের রায় কার্যকরের জন্য ভূমিকা রাখবে। পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৬ যুদ্ধাপরাধী ॥ ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রোকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বিচার চলাকালে এই আসামি অনুপস্থিত থাকায় মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপীলও দায়ের করা হয়নি। এরপর ২০১৩ সালের ৩ নবেম্বর বদর নেতা ফেনীর দাগনভূইয়ার আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চৌধুরী মঈনউদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই দুই আসামি পলাতক থাকায় রায় কার্যকর হয়নি। ২০১৪ সালের ১৩ নবেম্বর বিএনপি নেতা ফরিদপুরের নগরকান্দার এম ডি জাহিদ হোসেন খোকনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এই আসামিও পলাতক। আরেক পলাতক যুদ্ধাপরাধী ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সৈয়দ হাসান আলীকে ২০১৫ সালের ৯ জুন মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ে এই আসামিকে সরকার ইচ্ছে করলে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করতে পারে বলে বলা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ৩ মে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের পাঁচ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে চারজনের মৃত্যুদণ্ড এবং অপর একজনের আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে রাজাকার কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নান, নাছির উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে ক্যাপ্টেম এটিএম নাছির এবং মোঃ হাফিজ উদ্দিন মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পলাতক রয়েছেন। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই এক মামলায় জামালপুরের আট আসামির বিরুদ্ধে দণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পলাতক আছেন আব্দুল মান্নান, আশরাফ হোসেন ও আব্দুল বারী। ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর রায় হওয়া শরীয়তপুরের পালংয়ের রাজাকার ইদ্রিস আলী সরকার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পালিয়ে আছেন। এরপর ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল রায়ে কিশোরগঞ্জের নিকলির দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধী সৈয়দ মোহাম্মদ হুসাইন ওরফে হোসেন পলাতক রয়েছেন। একই বছরের ২২ নবেম্বর রায়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের ছয় রাজাকারের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এদের মধ্যে পাঁচজনই পলাতক। তারা হলেন- আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ, রুহুল আমিন, আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী, নাজমুল হুদা ও আব্দুর রহিম মিয়া। ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি রায়ে মৌলভীবাজারের রাজনগরের পাঁচ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনের আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া নেছার আলী ও মোবারক মিয়া পলাতক রয়েছেন। এরপর একই বছরের ১৩ মার্চ রায়ে নোয়াখালীর সুধারাম উপজেলার পাঁচ আসামিকে দণ্ড দেয়া হয়। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আবুল কালাম ওরফে একেএম মনসুর পলাতক রয়েছেন। ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই রায়ে মৌলভীবাজারের চার রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এদের মধ্যে আব্দুন নূর তালুকদার ও আব্দুল মোছাব্বির মিয়া পলাতক আছেন। আরেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মোঃ আনিস মিয়া রায় ঘোষণার দুই মাস পর মারা যান। একই বছরের ৫ নবেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার রাজাকার লিয়াকত আলী ও কিশোরগঞ্জের রাজাকার আমিনুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনই পলাতক। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দুই হোতা আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করা যায়নি। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ট্রাইব্যুনালের এক রায়ে নেত্রকোনার পূর্বধলার সাত রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এদের মধ্যে পাঁচজনই পলাতক। এরা হলেন- শেখ আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মাওলানা, আব্দুল খালেক তালুকদার, কবির খান, আব্দুল সালাম বেগ এবং নুর উদ্দিন ওরফে রাদ্দিন। অপর দুই আসামি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। একই বছরের ২৪ এপ্রিল নেত্রকোনার আটপাড়ার দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে হেদায়েত উল্লাহ আনজু পলাতক রয়েছেন। ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর গাইবান্ধার সদর উপজেলার পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এদের মধ্যে আব্দুল জব্বার মণ্ডল, জাছিচার রহমান ওরফে খোকা, আব্দুল ওয়াহেদ মণ্ডল ও মনতাজ আলী বেপারী ওরফে মমতাজ পলাতক আছেন।
×