ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিষিদ্ধ হচ্ছে আরও সাত জঙ্গী সংগঠন

প্রকাশিত: ২২:১৯, ৭ মার্চ ২০২১

নিষিদ্ধ হচ্ছে আরও সাত জঙ্গী সংগঠন

শংকর কুমার দে ॥ দেশে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে এমন সাত জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে এক বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থা এই সাত জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ করার তালিকা পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পুলিশের তালিকায় এই সাত জঙ্গী সংগঠন কালো তালিকাভুক্ত। সশস্ত্র লড়াই করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকান্ডের অভিযোগে সাত জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলেই সাত জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখায় যে সাত জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ করার তালিকা দেয়া হয়েছে তাতে নাম রয়েছে উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত, নব্য জেএমবি, দাওলাতুল ইসলাম বাংলাদেশ, হেযবুত তাওহিদ, আত-তামকীন, তামীরউদ্দীন বাংলাদেশ ও তৌহিদী ট্রাস্ট। সাত জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার জন্য যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। এই সাত জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, দেশে গোপনে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে এমন জঙ্গী সংগঠনগুলোর বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)। নামে বেনামে অন্তত অর্ধশতাধিক জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা চালানোর খোঁজ পেয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে জঙ্গী তৎপরতা ও উগ্র ইসলামি সংগঠন হিসেবে ইতোমধ্যেই আট জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত আট জঙ্গী সংগঠন হচ্ছে, আল্লার দল, জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি জঙ্গী সংগঠন কালো তালিকাভুক্ত রয়েছে। এসব সংগঠনকে আমরা মনিটরিং করছি। এর মধ্যে তামীরউদ্দীন বাংলাদেশ, নব্য জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের সক্রিয় এ্যাক্টিভিস্ট গ্রেফতার হয়েছে। যখন যেখানে গোপনে বা প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতার করছে। তবে সর্বশেষ আল্লাহর দল নামে জঙ্গী সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে সাত জঙ্গী সংগঠনের নাম নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে সেই জঙ্গী সংগঠনগুলো মনিটরিং করে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জঙ্গী কার্যক্রম বেড়ে যায়। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে একযোগে প্রায় একই সময়ে ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা চালানো হয়। এ সময়ে জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে শাহাদত-ই-আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ (হুজি), জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়। এরপর আট জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আট জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নিষিদ্ধ করার পরও হুজি ও জেএমবির কার্যক্রম চলতে থাকে। এখনও হুজি ও জেএমবির কার্যক্রম রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের আমলে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৩ সালের ১১ মে বরগুনায় আহলে হাদীস বাংলাদেশ ও আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা জসীমউদ্দিন রাহমানী গ্রেফতার হন। এরপর জসীমউদ্দিন রাহমানীর কাছ থেকে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে যে, তার সংগঠনের নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ২০১৫ সালের ২৫ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ওই বছরেই দেশে কয়েকজন লেখক, শিক্ষক, বগার ও বিদেশী নাগরিকদের হত্যা করে জঙ্গী সংগঠন। আনসার আল ইসলাম নামে একটি জঙ্গী সংগঠন এসব হত্যার দায়ভার স্বীকার করে। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত আট জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ৩০ নবেম্বর একদল সশস্ত্র ব্যক্তি মতিঝিলে বলাকা ভাস্কর্যটি ভাংচুর করে। এ ঘটনায় পুলিশ উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতের ৮ সশস্ত্র কর্মীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা রাজারবাগ বড় পীর হুজুর সৈয়দ দিল্লুর রহমানের অনুসারী। উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সংগঠনটি সেখান থেকে পরিচালিত হয়। হুজুর সৈয়দ দিল্লুর রহমানের নির্দেশে তারা বলাকার মূর্তি ভাংচুর করেছে। এ ঘটনার কয়েক মাস পর উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতের সশস্ত্র অনুসারীরা বিমানবন্দর গোলচত্বরে বাউলের ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফেলে। ২০১৭ সালে হাইকোর্ট চত্বরে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যটি স্থাপনের কয়েক দিনের মধ্যে উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সেটি সরিয়ে ফেলতে উড়োচিঠিতে হুমকি দেয়। পরবর্তীতে ওই বছরের ২৬ মে গভীর রাতে উচ্চ আদালত কর্তৃপক্ষ লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলে। এসব জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সংগঠনটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, আল্লাহর দল জঙ্গী সংগঠনটি ১৯৯৫ সালে জাতীয় সংসদের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আব্দুল মতিন মেহেদী ওরফে মুমিনুল ইসলাম ওরফে মহিত মাহবুব ওরফে মেহেদী হাসান ওরফে মতিনুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও সাদুল্যাহপুর থানা এলাকা থেকে এই সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করা হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার সঙ্গে আল্লাহর দলের সংশ্লিষ্টতার তথ্য মেলে। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ধানমন্ডির গ্রীন রোডের সরকারী কোয়ার্টার থেকে র‌্যাব মতিন মেহেদীকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে মতিন মেহেদী ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়ে টাঙ্গাইল কারাগারে বন্দী রয়েছেন। মতিন মেহেদীর অনুপস্থিতিতে গ্রেফতার আব্রাহিম আহমেদ হিরো আল্লাহর দলের ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাব অভিযান চালিয়ে আব্রাহিম আহমেদ হিরো (৪৬), আবদুল আজিজ (৫০), শফিকুল ইসলাম সুরুজ (৩৮) ও রশিদুল ইসলামকে (২৮) গ্রেফতার করে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের হাতে নব্য জেএমবির শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। এছাড়া ডিবি ও র‌্যাবের হাতে দাওলাতুল ইসলাম বাংলাদেশ, হেযবুত তওহিদ, আত-তামকীন, তামীরউদ্দিন বাংলাদেশ ও তৌহিদী ট্রাস্টের নেতাকর্মীরা গ্রেফতার হয়। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে অর্ধশত জঙ্গী সংগঠনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এসব তালিকাও পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। যেই অর্ধশত জঙ্গী সংগঠনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতে নাম রয়েছে, আহলে হাদিস আন্দোলন বাংলাদেশ, জামাত-আস-সাদাত, শাহাদত-ই-নবুয়ত, জামাত-আস-সাদাত জামিউতুল ফালাহ, ইসলামিক সলিডারিটি ফ্রন্ট, মুসলিম মিল্লাত, আল হারাত-আল-ইসলামিয়া, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট, তৌহিদী জনতা, আল খিদমত, হিজবুল মাহদি, হিজবুল্লাহ ইসলামী সমাজ, দাওয়াতি কাফেলা, বাংলাদেশ এন্টি টেররিস্ট পার্টি, আল মারকাজুল আল ইসলামী, আল ইসলাম মার্টেনস ব্রিগেড, সত্যবাদ, শরিয়া কাউন্সিল, জমিয়ত আহলে হাদিস আন্দোলন, তাজির বাংলাদেশ, হায়াতুর ইলাহা, ফোরকান মুভমেন্ট, জামিউতুল এহজিয়া এরতাজ, আনজুমানে তালামিজ ইসলামিয়া, কলেমার জামাত, সাহাবা পরিষদ, কাতেল বাহিনী, মুজাহিদিন-ই-তাজিম, এশার বাহিনী, আল ফাহাদ, হরকাতুল মুজাহিদিন, জাদিদ আল কায়দা ও জাদিদ আল সাবাব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে জঙ্গী সংগঠনগুলো তৎপরতা চালাচ্ছে। জঙ্গীরা ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করার মাধ্যমে সাংগঠনিক কাঠামো মজবুত করার পরিকল্পনা করছে। জঙ্গী গোষ্ঠী গণতন্ত্র বা বাংলাদেশের সংবিধানে বিশ্বাসী নয়। জঙ্গী তৎপরতার নামে মানুষজন হত্যা করছে জঙ্গী গোষ্ঠী। বর্তমানে জঙ্গী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে। জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। তবে গোপনে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে তৎপরতা চালাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটকা পড়ছে জঙ্গীরা। গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদে ও তথ্যানুসন্ধানে সাত জঙ্গী সংগঠনের নাম কালো তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা।
×