ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিয়াস ফারুকী

শেষ বিকেল

প্রকাশিত: ০০:৩৪, ৫ মার্চ ২০২১

শেষ বিকেল

দিনটা ঝকঝকে পরিষ্কার সাদা ঘোড়ার মতো সতেজ। নিশ্চিন্ত মনে সাদা পোশাক পরে, সাদা কাঁশবনের আড়ালে প্রেম করার দিন। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার দিন। রাহাত আলী আর নাইরুণও মত্ত ছিল একে অপরের মাঝে। পবিত্রতা যেন ওদের অদেখা ভালবাসার চাঁদরে আড়াল দিচ্ছিল। হঠাৎ আকাশ যেন কামান দাগাল। মেঘের গর্জনে চমকে উঠল ওরা। ওদের মনে হলো কেউ যেন ওদের সতর্ক করছে। প্রকৃতিও যেন ওদের রক্ষায় ব্যস্ত। ওরাও সজাগ হলো। কিন্তু নিজেদের সামাল দিতে দিতে ঝড়টা আচমকাই চলে এলো। চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরল কতগুলো বিষাক্ত ছায়া। নাইরুণকে আড়াল করে রুখে দাঁড়াল রাহাত আলী খান। কিন্তু প্রতিরোধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। সে লড়ল মহাবীর কর্ণের মতো। আবার থমকে যেতে হলো ঠিক তেমনি, যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মহাবীর কর্ণের রথের চাকা মাটিতে ডেবে গিয়েছিল। নয়জনের বিরুদ্ধে ও একা। সুতরাং এ প্রতিরোধ যুদ্ধ একতরফা হতে খুব বেশি সময় নিল না। ওদের হাতে বেদম পিটুনির পাশাপাশি বউটা ক্রমশই চোখের সামনে থেকে প্রতিবিম্ব হয়ে গেল। ওর ছায়াটাও যেন এক সময় গরম পানির বাষ্পের মতো উবে গেল। স্ত্রীকে রক্ষা করতে না পারার গ্লানি তার নিজেকে ঘৃণার অতলে সেঁধিয়ে দিল। সে ভাঙতে শুরু করল। চোখের সামনে বউকে উবে যেতে দেখে তার স্বপ্ন, তার হৃদয়ে ভাঙল। যেন দপ করে ভালবাসার প্রাচীর ভেঙ্গে সেঁধিয়ে গেল নরম কাদায়। রাহাতের ভালবাসার সৌধ গুঁড়িয়ে গেল। ওর ভেতরের অদৃশ্য যন্ত্রণা ছড়িয়ে গেল ইথারে। একসময় সে নিজের বোধকে হারিয়ে ঢলে পড়ল অবশ শরীরে। পুরোটা শরীরে অসহ্য বেদনা নিয়ে নাইরুণ হাসপাতালের বিছানায়। প্রথমে ওকে নিয়ে গোল্লাছুট খেলেছে ওরা। ওর নিজস্ব প্রতিরোধ ভেঙ্গে গেলে ওকে নিয়ে বালিশ হাতবদলের খেলা খেলেছে। ভেতরে বাহিরে চূর্ণ নাইরুণ। হাসপাতালের সাদা বিছানায় শুয়ে আকাশের ভাঙ্গা মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাঙ্গা মেঘের মতো তার শরীর বিধ্বস্ত। তার চিন্তায় ঘুরপাক খায় ঘৃণ সময়টা। সে জানে শরীর একদিন জোড়া লাগবে। কিন্তু হৃদয়টা? রাহাতকে নিজের চোখের সামনে পশুগুলোর সঙ্গে একা লড়তে দেখেছে। নাইরুণকে রক্ষা করতে সে কী আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার। ওরা তাকে চোখের সামনে পশুর মতো পিটিয়েছে। স্বামীকে অত্যাচারের দৃশ্য তার নিজের ব্যথাকে ভুলিয়ে দেয়। নাইরুণ যতবার নিজেকে শেষ করার চিন্তা করেছে, রাহাত তার ভাবনায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই নয়জনের মাঝে সে দেখেছে পশুত্ব। কিন্তু রাহাত, সে তার প্রেমিক, তার স্বামী, পৌরষের উজ্জ্বল আকাশ। কাদা মাটি, জল তার প্রেমের বহুতল। নাইরুণ ফুঁপিয়ে ওঠে। হায়েনা খামচানো তার পুরো শরীরে প্রলেপ মাখিয়ে দেয় তার স্বামীর বীরত্ব। হায়েনাগুলো তার শরীর খাবলেছে ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ে যে আচ্ছন্ন হয়ে আছে রাহাতের অস্তিত্বে। সে তার শরীর দিয়ে অন্তর নয়, অন্তর দিয়ে শরীর নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সে বুঝতে পেরেছে রাহাতরাই সত্য। রাহাতরাই এই বসুন্ধরার সন্তান। স্ত্রীর শরীর রক্ষায় রাহাত হেরে গেলেও। তার ভালবাসাকে অপমানিত হতে দেয়নি। তার স্বাভিমান তার অস্তিত্ব তাকে বিজয়ীর স্তম্ভে দাঁড় করিয়েছে। নাইরুণের চোখ বেয়ে নেমে আসে তপ্ত জলকণা। তবে এ জলকণা কষ্টের, না স্বস্তির। জানালার বাইরে দূর আকাশে ভেঙ্গে যাওয়া স্বচ্ছ মেঘগুলো তার ভাবনার মতো আবার একত্রিত হতে শুরু করেছে। রাহাত আলী খানের জ্ঞান ফিরে এলো হাসপাতালের বিছানায়। জ¦র ছেড়ে গেলে তাঁর বৃদ্ধ মা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বেশ ধকল গেছে তার শরীরের ওপর। একই সঙ্গে ধকল গেছে তার মায়ের ওপরও। পঁচিশ বছর বয়স। বোধকে পেরিয়ে যাওয়া। সময়ের ফেলে আসা রেলের বাষ্প ইঞ্জিনযুক্ত কয়লার ট্রেন যেন গত তিনদিন তার ওপর দিয়ে চলাচল করেছে। তাকে সেবা দিতে তার মাকে সময় ও অবস্থার সঙ্গে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ করতে হচ্ছে। স্বপ্ন ঘিরে গড়া ছিল কিশোরী নাইরুণের চৌহদ্দী। দুপুরে ভাত ঘুমের সময় বাড়ির সবাই যখন দিবা স্বপ্নে বিভোর থাকত। সেই সময় বাড়ির পুকুরে ভর দুপুরে রাহাত আলীর সঙ্গে চলত জলকেলী। অকৃত্রিম আনন্দে রাহাতকে ছুড়ে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তার আহ্বানে থাকত তার অবচেতন কিশোরী হৃদয়। ‘তুই যদি এক ডুবে পুকুর তলের মাটি নিয়ে আসতে পারিস তবে আমি তোর বৌ, না পারলে তোর জন্য ভেউ।’ আর অমনি রাহাত এক ডুবে পুকুর তলের মাটি নিয়ে আসত। তারপর নাইরুণকে ডাকত, ‘আয়, কাছে আয়। তুই কিন্তু এখন আমার বউ। দেব চুমু, ভাঙবে ঢেউ, আয় কাছে আয়।’ অজানা লজ্জা তখন নাইরুণকে ঘিরে ধরত। চটকরে ভিজে কাপড়সহ নাইরুণ পুকুর থেকে উঠে দিত ভোঁ দৌড়। আবারও জেগে ওঠে রাহাত। অবস্থা আবেগে, কিছুটা ঘোরের মাঝে বলতে থাকে ‘মাঝ পুকুরের মাটি এনে দিলাম, বললি বউ হয়ে সারা জীবন কাছে থাকবি। কোথায়! তুই তো তোর কথা রাখলি না। আচ্ছা মা, ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পুকুরে নামলে তারা কি জামাই বউ হয়ে যায়। কাদা তুলে আনলে কী হয় মা? কাদা বুঝি ফুল হয়ে যায়।’ ভাদ্র মাসের বর্ষার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রেম রাহাতকে সেই ছোট বেলার মাঝ পুকুরের কাদা মাটি বানিয়ে দিল। শিউরে বসা মা চমকে ওঠেন। ছেলেকে সান্ত্বনা দেন। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। তুই চিন্তা করিস না তুই সুস্থ হয়ে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। হারামজাদা সব ধরা পড়েছে। তুই দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আবারও ডুকরে ওঠে সে, ‘মা, কঠিন দম নিয়ে পুকুরের তলের কাদা মাটি আনলাম। ওই মাটি যে প্রেম, ওই মাটি যে শপথ, তা ভুলি কীভাবে মা। আমি যে অসহায়। ওর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমি যে কী মা’? জ্বরে ভোগার সময় বেশ কিছু স্বপ্ন দেখে রাহাত আলী খান। নাইরুণকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। আকাশে মেঘের মতো ক্ষণে ক্ষণে চিত্র আঁকে তার হৃদয়ে। খেলা করে নাইরুণের মসৃণ কালো চুল নিয়ে। নাইরুণ বারোতে আর সে চৌদ্দতে। নাইরুণকে বধূ ভাবতে শিহরণ জাগে তার হৃৎপিণ্ডে। বিভিন্ন বাহানায় ওর হাত ছুয়ে দিতে ভাল লাগে। মনে হয় শরীরে অদ্ভুত এক বিদ্যুত খেলা করে। ওরা চাচাত ভাইবোন। সবাই মনে করে ওরা ভাই বোন। একই বাড়ির আন্তরিকতা স্বাভাবিক। কিন্তু রাহাত আলী খানের মা জানেন এ শুধু ভাই-বোনের অন্তরঙ্গতা না এর আড়ালে রয়েছে প্রভাতের সূর্য। মোলায়েম আলো রয়েছে। রয়েছে উন্মুুখ আবেগ। জ¦রের প্রকোপ কমতেই রাহাত আলী খানের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। স্বপ্ন বাস্তবের আদলে জেগে উঠে মধ্য গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের মতো। তাও যেমন তেমন না। যেন চৈত্র মাসের কুকুরের হা করা মুখের ব্রহ্মতালু দর্শনের মতো গরম। সে বুঝতে পারে সে এখন নিম্নমুখী গড়ান দেয়া সময়। শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায় একটু আগে যে স্বপ্ন দেখেছে তা তার জীবনের স্যালুলয়েড থেকে, পেরিয়েছে অনেক বছর পূর্বে। শরীর কাঁপতে থাকে তার। চোখ ঝাপসা। চোখের পানি তাকে আরও ভাসিয়ে নিয়ে যায় আবেগে। তার বিছানার পাশে বসে থাকা মায়ের কাছে জানতে চায় নাইরুণ সম্পর্কে। তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে। শুকনো ঠোঁট জোড়া মৃদু ফাঁক হয়ে। দুর্গন্ধযুক্ত নিশ^াস নিয়ে মাকে বলে, মা বলতে পারো নাইরুণ এখন কই। তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে মা। শাড়ির আঁচলে চোখ মোছেন মা, তার করা ভুলের জন্য নাকি ছেলের এই অবস্থার জন্য বোঝা যায় না। ছেলের আবেগকে সযত্নে বুকে জড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে উত্তর দেন, ‘নাইরুণ ভাল আছে বাপ। তুই চিন্তা করিস না। তুই সুস্থ হলেই তার সঙ্গে দেখা হবে।’ রাহাত জানতে চায় ‘ভাল থাকলে ও আমার কাছে আসে না কেন।’ সাবধানে নিজের মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে চোখটা মুছে নেন তিনি। বলেন, ‘ও আসবে বাবা। আমরা দুজনেই হাসপাতালে থাকলে বাসা দেখব কে বাবা।’ বলেই রাহাতের বিছানার পাশ থেকে উঠে চলে যান তিনি। সন্তানের অলক্ষ্যে ইচ্ছে মতোন চোখের পানি ঝরাণ। তিনি ভাল করেই জানেন এই মুহূর্তে তাকে সুস্থির থাকতে হবে। তার সন্তান ও পুত্রবধূ যে এখন কঠিন পরীক্ষায়। জ¦রে ফেটে যাওয়া ফ্যাকাসে সাদা হয়ে যাওয়া র্ঠোট ও ডেবে যাওয়া চোখ নিয়ে মায়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে সে। মায়ের চেহারা দেখে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করে সে। চোখের কোনে পানি গড়িয়ে পড়ে। যেন বলতে চায় মাগো আমার এই বুকে যে বিসুভিয়াস। নাইরুণ যে আমার সাতমনিহার। মায়ের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবারও তন্দ্রার নিকট নিজেকে শপে দেয়। অনিশ্চিত তন্দ্রা তাকে ঘুমের অতলে যেতে দেয় না। তাকে বেঁধে রাখে মাঝামাঝি। ঘুরে ফিরে তাকে নিয়ে যায় নাইরুণের নিকট।
×