ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁদপুরে কাজী নজরুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ৫ মার্চ ২০২১

চাঁদপুরে কাজী নজরুল ইসলাম

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) চাঁদপুরে এসেছেন একাধিকবার। যদিও চাঁদপুর তাঁর গন্তব্য ছিল না। তিনি কলকাতা, কুমিল্লা কিংবা তেওতা যাওয়ার পথে চাঁদপুরে এসেছিলেন। একবার অর্থাভাবে পড়ে রাত্রিযাপন করেছেন চাঁদপুরের ডাকবাংলোয়। কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের ১৭ জুন কুমিল্লায় নার্গিস আসার খানমকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের পর এ সংক্রান্ত জটিলতায় তাঁর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ততদিনে নজরুল নিজের ভুল ধরতে পেরেছিলেন, কিন্তু জাল ছিন্ন করতে পারেননি। মুজফ্ফর আহমদ জানিয়েছেন, নজরুল ইসলাম নার্গিসদের বাড়িতে বন্দীর মতো ছিলেন। আর এ সবকিছুর পেছনে দায়ী ছিলেন আলী আকবর খান। তিনি নজরুলকে কেবল প্রতারিতই করেননি, অপমানিতও করেছেন। পরবর্তীতে মুজফ্ফর আহ্মদ নজরুলের চিঠি পেয়ে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যেতে কুমিল্লা আসেন। তাঁরা ১৯২১ সালের ৮ জুলাই কুমিল্লা থেকে ট্রেনে করে চাঁদপুর এসে পৌঁছেন। কিন্তু কলকাতায় যাবার জন্যে তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে মুজফ্ফর আহ্মদ লিখেছেন- ‘কুমিল্লা স্টেশনেও থার্ড কিংবা ইন্টার ক্লাসে চড়া কিছুতেই সম্ভব হলো না। চাঁদপুর পর্যন্ত আমাদের ফাস্ট ক্লাসে যেতে হলো। চাঁদপুর পৌঁছে দেখলাম স্টিমার চলে গেছে। হিসাব করে দেখলাম আমাদের টাকাও কম পড়ে যাবে। সেই রাত্রে আমরা চাঁদপুর ডাক বাংলোয় চলে গেলাম।’ নজরুল পরিক্রমা গ্রন্থে গবেষক আবদুল আজীজ আল্-আমান এ ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। তাঁর লিখেছেন- ‘কবিকে (নজরুলকে) নিয়ে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে চাঁদপুরে এসে আহমদ (মুজফ্ফর আহ্মদ) সাহেব দেখলেন যে টাকার অঙ্ক কমে এসেছে। ওঁরা চাঁদপুরের ডাক বাংলায় আশ্রয় নিয়ে টাকা পাঠাবার জন্য কলকাতায় আফজালুল হক সাহেবকে টেলিগ্রাম করেন।’ অর্থ-সংস্থানের জন্য মুজফ্ফর আহ্মদ ৮ জুলাই রাত্রে বা পরেরদিন ৯ জুলাই ভোরে কলকাতায় আফ্জালুল হককে টেলিগ্রাম করেন। আফজালুল হক যখন টেলিগ্রাম পেলেন তখন সেখানে কুমিল্লার আশরাফ উদ্দীন উপস্থিত ছিলেন। মুজফ্ফর আহ্মদ লিখেছেন- ‘ভাগ্য ভাল যে তখন কুমিল্লার আর্শাফ উদ্দীন আহ্মদ চৌধুরী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ চাঁদপুরের শ্রীযুক্ত হরদয়াল নাগকে টেলিগ্রাম করলেন যে ডাক বাংলোয় নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহমদ রয়েছেন। তাদের দয়া করে বারোটি টাকা পৌঁছিয়ে দিন। নাগ মহাশয়ের তরফ হতে শ্রীকুলচন্দ্র সিংহ রায় এসে আমাদের বারোটি টাকা দিয়ে গেলেন।’ টাকা পেয়ে নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহমদের সমস্যার সমাধান হলো। তাঁরা স্টিমারে করে কলকাতা রওনা দিলেন। মিয়াজান কবীরের লেখা ‘মানিকগঞ্জে নজরুল’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, নজরুল ১৯২২ সালেও চাঁদপুর এসেছিলেন। তিনি বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের সঙ্গে প্রমীলার গ্রামের বাড়ি তেওতা যাচ্ছিলেন। তিনি কুমিল্লা থেকে ট্রেনে প্রথমে চাঁদপুর আসেন। এরপর চাঁদপুর থেকে স্টিমারে করে গোয়ালন্দ হয়ে তেওতা গ্রামে পৌঁছেন। কাজী নজরুল ইসলামের রচনাতেও চাঁদপুরের প্রসঙ্গ রয়েছে। তাঁর ছোটগল্প ‘হারা ছেলের চিঠি’তে তিনি লিখেছেন- ‘চাঁদপুরে যখন রেলে চড়লাম, তখন সন্ধ্যা বেশ ঘনিয়ে এসেছে। ট্রেন চলতে লাগল। আমি কেমন যেন উন্মনা হয়ে পড়লাম। অলস উদাস চোখে আমার শুধু এইটুকু ধরা পড়ছিল যে, ভীষণ বেগে উল্টোদিকে ছুটে যাচ্ছে-আঁধার রাতের আঁধারতর গাছপালাগুলো। চলন্ত ট্রেনের ছায়াটা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন একটা বিরাট বিপুল কেন্নো ছুটে যাচ্ছে।’ কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে চাঁদপুরের সন্তান সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের গভীর ছিল। নজরুল সওগাতে কাজ করেছেন। তিনি মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে সম্মান করতেন। অন্যদিকে নাসিরউদ্দীন ছিলেন তাঁর অভিভাবকস্বরূপ। নজরুলের বিপদে-আপদে তিনি সবসময় ছায়ার মতো ছিলেন। নজরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। নজরুল ইসলাম নাসিরউদ্দীন-কন্যা বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগমকে স্নেহ করতেন। বেগমের জন্যে তিনি বেনামে লেখা লিখতেন। তথ্যসূত্র : ১. কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, মুজফ্ফর আহ্মদ; প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ১৯৬৫, পৃষ্ঠা ১৩৫ ২. নজরুল পরিক্রমা, আবদুল আজীজ আল্-আমান, হরফ প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ২৫ মে ১৯৫৩ ৩. মানিকগঞ্জে নজরুল, মিয়াজান কবীর, ধ্রুবপদ প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ২০১৮ ৪. নজরুলসমগ্র, পৃষ্ঠা ২২৪
×