ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলমগীর সাত্তার

ছন্দময় চিত্রের বত্তিচেল্লী

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ৫ মার্চ ২০২১

ছন্দময় চিত্রের বত্তিচেল্লী

মহৎ শিল্পীরা প্রকৃতি এবং জগতকে যে দৃষ্টিতে দেখে থাকেন, আমরা সাধারণ মানুষরা সে রকমটা দেখতে পাই না। বড় মাপের শিল্পীরা এবং আমরা সাধারণ মানুষরা একই রকমের দেহ এবং চোখ নিয়ে জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু তাঁরা প্রকৃতি এবং অন্যান্য বস্তুর মধ্যে যে রং এবং রূপ দেখতে পান, তা আমরা দেখতে পাই না। চোখের চেয়েও আমার মনে হয় তাঁদের এবং আমাদের মস্তিষ্কের গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রভেদ আছে। তাই মাইকেল এ্যাঞ্জেলো, ভ্যানগগ, পিকাসোর মতো বড় শিল্পীদের দৃষ্টি এবং কল্পনা শক্তি ছিল ভিন্নতর। যেমন সেজান যখন আপেলের ছবি এঁকেছেন, তখন তিনি তাঁর চোখের নিজস্ব লেন্স দিয়ে আপেলগুলো দেখেছেন। ভ্যানগগ কিছুটা শুকনো সানফ্লাওরের ছবি এঁকে বিশ্ব জয় করেছেন। অথবা ‘রেমব্রান্ট বেইদিং ওয়োম্যান’ ছবিখানা আঁকতে গিয়ে মোটাসোটা মধ্যবয়সী হেন্ড্রিকিয়ার মাঝে যে সৌন্দর্য দেখেছেন, তা তো আমাদের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হতো না। প্রতিভাত হতো না, কিন্তু হচ্ছে কারণ রেমব্রান্ট, ভ্যানগগের মতো শিল্পীরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই আমরা ওইসব চিত্র সম্ভারের দিকে শত শত বছর পরেও মুগ্ধ নেত্রে তাকিয়ে থাকি। বত্তিচেল্লী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৪৪৪ সালে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৫১০ সালে। তখন ইতালিতে চলছে রেনেসাঁসের সময়কাল। শুরু হয়েছে শিল্প-সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান সবকিছুর পুনরুত্থান। এসবের মধ্যে চিত্রশিল্প, ভাস্কর শিল্প, স্থপতি এই তিন বিষয় পাচ্ছিল অগ্রাধিকার। রাজ-রাজারা, সম্পদশালী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চিত্রকর ও ভাস্কর শিল্পীদের বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। প্রতিভাবানরা চিত্র এবং ভাস্কর শিল্পে তাঁদের মেধা নিয়োগ করলেন বেশি বেশি। এ ক্ষেত্রে অর্থ, যশ-খ্যাতি ছিল অন্য সব ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি। কত যে মহারথী শিল্পীরা এক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করলেন যে সবার নাম উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। এই অসংখ্য চিত্র শিল্পীদের মধ্যে বত্তিচেল্লীকে আমি সবার ওপরে স্থান দেব। কারণ তাঁর আঁকা ছবি একই সঙ্গে চিত্রশিল্প কবিতা এবং সঙ্গীত। সব চিত্রশিল্পীই কবি। তাই ভ্যানগগ লিখে গেছেন, শুধু রঙের বিন্যাসের মাধ্যমে তুমি কবিতা লিখতে পার। “ঙঘঊ গঅণ গঅকঊ অ চঙঊগ ঙঘখণ ইণ অজজঅঅঘএওঘএ ঈঙখঙজঝ, ওঘ ঞঐঊ ঝঅগঊ ডঅণ ঞঐঅঞ ঙঘঊ ঈঅঘ ঝঅণ ঈঙগঋঙজওঘএ ঞঐঘএঝ ওঘ গটঝওঈ.” মাইকেল এ্যাঞ্জেলো যেমন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর এবং চিত্রশিল্পী হয়েও ছিলেন তখনকার সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি রঙের সাহায্যে চিত্র এঁকেছেন এবং শব্দ চয়নের মাধ্যমে সনেট আকারে লিখে রেখে গেছেন কবিতা। তাঁর জীবদ্দশায় কবিতাসমূহ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর দু’শ’ বছর পরে যখন তাঁর লেখা কবিতাসমূহ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তখন সকলে একবাক্যে স্বীকার করলেন, তিনি শুধু চিত্রকর, ভাস্কর শিল্পী, স্থপতিই নন। তিনি ইতালির সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদেরও একজন। আমি ফ্লোরেন্সের উফিজি আর্ট গ্যালারিতে কয়েকবার গিয়েছি। ওই আর্ট গ্যালারিতে শুধু ক্ল্যাসিকাল শিল্পীদের আঁকা ছবি রক্ষিত আছে। সেখানে শিল্পীদের গুরু জাত্তা থেকে শুরু করে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এ্যাঞ্জেলোসহ সব চিত্রকরের আঁকা ছবি রক্ষিত আছে। কিন্তু বত্তিচেল্লীর আঁকা চিত্রসমূহের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতেই দর্শকদের ভিড়ই বেশি। ওই কক্ষটিতে বার্থ অব ভেনাস, প্রিমাভেরা, অর্থাৎ স্পিরিং পার্সনিফাই গণ্ডেস, মার্স এ্যান্ড ভেনাস ইত্যাদির সঙ্গে আরও কয়েকখানা ছবি আছে। ‘বার্থ অব ভেনাস’ চিত্রখানা সম্পর্কে দুটো কথা বলা যাক : পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রসমূহের মধ্যে এ ছবিখানা অগ্রগণ্য। বিগত ছয় শ’ বছরের পুরনো হলেও এ ছবির জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি। এই ভেনাস কিন্তু গ্রীক ভেনাসের চেয়ে একদম ভিন্ন। এটা হলো ইতালির ফ্লোরাইনটাইন ভেনাস। এই ভেনাস তার নগ্নতা সম্পর্কে খুবই সচেতন। তাই তার দীর্ঘ সোনালি চুলের অগ্রভাগ দিয়ে নগ্নতাকে অনেকখানি ঢেকে রেখেছেন। সমুদ্রের জলরাশির মধ্য থেকে উত্থিত হয়ে বৃহদাকারের একটি ঝিনুকের ওপর দাঁড়িয়ে উপকূলের দিকে ভেনাস এগিয়ে আসছিল। বায়ুর দেবতা এবং দেবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে যুগ্মভাবে আকাশে ভাসমান অবস্থায় ফুঁ দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসের সৃষ্টি করে ঝিনুকের ওপর দাঁড়ানো ভেনাসকে উপকূলের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে। মৃদুমন্দ বাতাস সমুদ্রজলের উপরিভাগে যে ঝিকিমিকি ঢেউ সৃষ্টি করছে ছবিতে তাও সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। বায়ুর দেব-দেবী যে ভঙ্গিমায় শূন্যে ভাসছেন, সেটাও উল্লেখ করার মতো। বায়ুর দেবতা মুখের ফুঁ দিয়ে যে বাতাস সৃষ্টি করেছে, সেই বাতাসের সঙ্গে অসংখ্য গোলাপ ফুল ঝরে পড়ছে। বায়ুর দেব-দেবীর পরিধেয় উত্তরীয়ের প্রান্ত মৃদু বাতাসে উড়ছে। এ চিত্র তো কোন কিছু দেখে আঁকা হয়নি। এটা সম্পূর্ণই বত্তিচেল্লীর মনোজগতের সৃষ্টি। এ ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলে দর্শকের মনে প্রশান্তি নেমে আসে। স্টিফেন স্পেন্ডার নামের একজন চিত্র সমালোচক বলেছেন, বেথাফোনের ফিফ্রত সিম্ফনি শ্রোতার মনে যে প্রভাব বিস্তার করে, বত্তিচেল্লীর এই চিত্রও তেমন একই প্রভাব বিস্তার করে। তাই এই চিত্রখানিকে শুধু কবিতার সঙ্গেই তুলনা করা হয়নি রূপক অর্থে সঙ্গীতের সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে। এই আর্ট গ্যালারির অন্য একটি কক্ষে শিল্পী তিসিয়ানের আঁকা প্রেমের দেবী ভেনাসের অন্য একখানা ছবি আছে। চিত্রশিল্পী হিসেবে তিসিয়ানের খ্যাতি কারও চেয়ে কম নয়। ছবিখানা উরবিনো ভেনাস নামে খ্যাত। উরবিনো রাজ্যের ডিউকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এটা আঁকা হয়েছিল বলে এর নাম হয়েছে উরবিনা ভেনাস। এ ছবিতে দেখা যায়, পূর্ণ আকৃতির অর্ধশায়িতা প্রেমের দেবী তার সমস্ত নগ্ন সৌন্দর্য নিয়ে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছেন সে ভেনাসকে আর স্বর্গের দেবী বলেই মনে হয় না। মনে হয়, অপরূপা কোন সুন্দরী মাটির পৃথিবীর সমস্ত কামনা-বাসনা নিয়ে চোখ মেলে দর্শকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এই ভেনাসের দেহ ভঙ্গিমা এমনই মনোমুগ্ধকর এবং দেহের ভাঁজগুলো এতই লালিত্যময় যে, দর্শক এ ছবির প্রেমে পড়ে গেলে দোষ দেয়া যাবে না। আমি আজ তিসিয়ানকে নিয়ে লিখছি না। আমি লিখছি শিল্পী বত্তিচেল্লীকে নিয়ে। তাঁর আঁকা বার্থ অব ভেনাস ছবির পরেই বেশি বিখ্যাত চিত্র হলো ‘প্রিমাভেরা’ বা বসন্তকাল। কবি পলিসিয়ানো এবং লরেঞ্জো দ্য মেডিসির কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বত্তিচেল্লী এই ছবিখানা এঁকেছিলেন। ছবিখানা বেশ বড় মাপের। তা আকৃতিতে আট ফুট গুণ দশ ফুট হবে। এ ছবিতে দেবী ভেনাস বেশ ক’জন সখী পরিবৃত হয়ে বসন্তকালীন বাগানে খেলা করছেন। ছবির এককোণে দেখা যাচ্ছে অতিশয় সুদর্শন একটি ছেলেকে দণ্ডায়মান অবস্থায়। ভেনাসের সখীরা তাদের একজন বান্ধবীকে ওই যুবকের সঙ্গে যুগলবন্দী করার ষড়যন্ত্র করছে। ছবির শীর্ষে দেখা যাচ্ছে, কামদেব বা কিউপিড ওই যুবকের প্রতি প্রেমশর নিক্ষেপ করার জন্য তাক করে আছে। বত্তিচেল্লীর আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে ‘দ্য এ্যাঞ্জেল ফ্রফ টোরিয়াস’ চিত্রখানি। এ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, স্বর্গীয় দেবী নির্জন পথে মনের আনন্দে ছন্দময় পদক্ষেপে একা একা হেঁটে চলেছে। আমরা যে বত্তিচেল্লীর আঁকা ছবিকে কাব্যিক এবং সঙ্গীতময় বলেছি তা পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে এই ছবিতে। বত্তিচেল্লী একাধারে যেমন ছিলেন কবি এবং চিত্রকর তেমনি প্রেমিকও ছিলেন বটে! ফ্লোরেন্সের মেডিসি পরিবার রাজকন্যা সিমোনেত্তার একখানা পোট্রেট ছবি আঁকার জন্য বত্তিচেল্লীকে চুক্তিবদ্ধ করে। রাজকন্যা সিমোনেত্তার মতো সুন্দরী তখনকার সমগ্র ইতালিতে কেউ ছিল না। পোট্রেট ছবিখানা আঁকতে আঁকতে বত্তিচেল্লী রাজকন্যার প্রেমে পড়ে যান। এ প্রেম ছিল এক তরফা। সিমোনেত্তাও যে বত্তিচেল্লীর প্রেমে পড়ে ছিলেন এমন তথ্য আমি কোথাও পাইনি। এই শিল্পী যত বিখ্যাত ছবি এঁকেছিলেন তার মধ্যে সিমোনেত্তার পোট্রেটও অন্যতম। ওই পোট্রেট ছবিখানা আছে ফ্রাঙ্কফুর্টের স্টার্ডেল মিউজিয়ামে। ওই ছবিখানা কয়েকবার দেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। রাজকুমারী সিমোনেত্তা মাত্র সতেরো বছর বয়সে মারা যান। আর শিল্পী একতরফা প্রেম নিয়ে আজীবন অবিবাহিতই থেকে যান। শিল্পী বত্তিচেল্লী প্রতিটি ছবির নারীর মুখাবয়বের আদলেই এঁকেছেন। ‘দ্য এ্যাঞ্জেল ফ্রম টোবিয়াস’ চিত্রে আমরা নির্জন পথ দিয়ে স্বর্গীয় দেবীর বেশে রাজকুমারী সিমোনেত্তাকেই দেখতে পাই। বত্তিচেল্লী শেষ বয়সে এসে সাভোনারোলা নামের এক ধর্মীয় ফ্যানাটিকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চিত্রাঙ্কন ছেড়ে দেন। ইহুদী, খ্রীস্টান এবং মুসলমান ধর্মে নাকি চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য নির্মাণ করা নিষেধ। এই কথা সাভোনারোলা প্রচার করতে শুরু করেন। ফ্লোরেন্সের যথেষ্ট লোক ওই উগ্র ধর্মপ্রচারকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। কিন্তু সাভোনারোলার শেষ রক্ষা হয়নি। ফ্লোরেন্সের লোকরাই সাভোনারোলাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে প্রথমে হত্যা করে এবং পরে তার দেহ পুড়িয়ে ফেলে। ধর্মীয় উগ্রবাদে প্রভাবিত হলে শিল্পী বত্তিচেল্লীর কাছ থেকে আমরা আরও অনেক বিশ্বশ্রেষ্ঠ চিত্র পেতে পারতাম।
×