ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতির অভিযোগ

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির মুখোমুখি বেরোবি উপাচার্য

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ৫ মার্চ ২০২১

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির মুখোমুখি বেরোবি উপাচার্য

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে পাল্টাপাল্টি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুুরি কমিশন (ইউজিসি)। উপাচার্য তার বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের অভিযোগকে মিথ্যা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমি শিক্ষামন্ত্রীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। আজকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা শিক্ষামন্ত্রীর আশ্রয়, প্র্রশ্রয় ও আশকারায় এ অবস্থায় এসেছে। অন্যদিকে অভিযোগ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী সরাসরি কোন বক্তব্য দেননি। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে উপাচার্যের দেয়া বক্তব্যকে অনাকাক্সিক্ষত ও রুচি বিবর্জিত বলে অভিহিত করেছে। আর ইউজিসি অভিযোগ করেছে, উপচার্য তদন্ত কমিটিকে ক্যাম্পাসে যেতে দেয়নি। সকালে প্রথমে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ অভিযোগ করেন, আমি শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির ষড়যন্ত্রের শিকার, রাজনীতির শিকার। দুটি উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি-এমন তথ্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। একইসঙ্গে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘আজকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা শিক্ষামন্ত্রীর আশ্রয়, প্রশ্রয় ও আশকারায় এ অবস্থায় এসেছে। তিনি (ডাঃ দিপু মনি) শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দেখা করতে যাই। সকাল ১০টার প্রোগ্রাম তিনি এসেছিলেন বিকেল ৪টায়। আমাদের সব উপাচার্যকে পুরোটা দিন তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেটা খুবই অসৌজন্যমূলক কাজ হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনই এমনটি ঘটেনি। তিনি বলেন, যতবার আমরা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ক্রোড়পত্রের বাণী চেয়েছি, পাইনি। উপমন্ত্রীর কাছে যতবার বাণী চেয়েছি ততবার পেয়েছি। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বাণী নিয়ে কখনও কার্পণ্য করেননি, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর বাণী কখনও পাইনি। আমি খোলামেলা কথা বলার মানুষ। আজ কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলতে এখানে এসেছি এবং পরিণতি বিবেচনা করেই এসেছি। উপাচার্য বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই যা অপপ্রচার, অপবাদ হয়েছে, সব শিক্ষামন্ত্রীর আনুকূল্যে হয়েছে। আজকে লুকিয়ে চাপিয়ে কথা বলব না। সব খোলাসা করতে এসেছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে মিডিয়া ও নির্বাচন নিয়ে কাজ করি। সেজন্য আমি পরিষ্কার করে কথা বলতে পছন্দ করি। আমি কোনদিন সত্য কথা বলতে পিছপা হইনি, আজও হব না। শিক্ষামন্ত্রীর অফিস থেকে তদন্ত প্রতিবেদনের খণ্ডিত অংশ লিক করা হয়েছে। একটা তকমা আমাদের ঘাড়ে দিয়ে দেয়ার জন্য এসব করা হচ্ছে। এখানে খুবই ন্যক্কারজনক এক রাজনীতির খেলা হয়েছে। সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন এ ধরনের হীন রাজনীতি করার জায়গা না। এটি আমি নির্ভয়ে বলতে চাই। পুরো বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছি। এ পর্যন্ত আমি যা কিছু করেছি সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীর শ্রুতি নির্দেশে করেছি বলেও উল্লেখ করেন উপাচার্য। বলেন, আমাদের দেশে দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার একটি প্রবণতা আছে। আমি কেন অভিযোগ করলাম, এটাই বোধ হয় আমি অপরাধ করেছি। বিষয়টি অন্যদিকে ধামাচাপা ও অন্যদিকে মোড় নেয়ার জন্য আজকের এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর আমি অনেকবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছি। কিন্তু কখনও প্রতিবাদ করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছে আমি যত বেশি আলোচনায় থাকব, তত বেশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হিসেবে সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিতাযুক্ত আইডি কার্ড পরিধান করি। অনেকেই এটা নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। আমি কিন্তু উপভোগ করেছি। আমার পরিচিত সবাই জানেন, আমি একজন কাজ পাগল মানুষ। দায়িত্বে অবহেলা আমার চরিত্রে নেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য দৈনিক ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা কাজ করি। মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমাই। মূলত ক্যাম্পাসকে আলোচনায় রাখাই আমার দায়িত্ব। বাংলাদেশের যে প্রান্তেই থাকি না কেন আমি বেরোবির উপাচার্য। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, উপাচার্যের পদ আবাসিক নয় রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব আবাসিক।’ উপাচার্য বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমাকে পাওয়া যায় না, আমি নিখোঁজ হয়ে যাই, আমি ঢাকায় থাকি। অথচ আমি প্রতিদিন ২০-২২ ঘণ্টা কাজ করি। ঢাকায় থাকলে লিয়াজোঁ অফিসে কাজ করি। রংপুরে থাকলে বাসায় থেকে কাজ করি। দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বাভাবিকভাবেই সব চলছিল। কিন্তু মিথ্যা ও অসংলগ্ন যেসব তথ্য সংবাদ মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে, তা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আমি রংপুরে ভোট করতে যাইনি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন করেছি। ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থাকার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, সংসদে পাস করা যে আইনটি আছে সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, কেবল রেজিস্ট্রার সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করবেন। এখানে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হবে এ রকমটি বলা নেই। আমি সংসদে যে আইন সে অনুযায়ী চলেছি, আমার জানামতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দেশের মধ্যে ছুটির জন্য কোন অনুমতি প্রয়োজন হয় না। অপরাজনীতি করার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয় নয়। হয়ত শিক্ষামন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করেন। সেজন্য আমাকে নিয়ে এসব করছেন। আর আমি যা করি সবই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করি। তবে অভিযোগ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী সরাসরি কোন বক্তব্য করেননি। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে উপাচার্যের দেয়া বক্তব্যকে অনাকাক্সিক্ষত ও রুচি বিবর্জিত বলে অভিহিত করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে বলা হয়েছে, উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য রেখেছেন তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। তার বক্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হচ্ছে- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে নানা ধরনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসি বরাবর তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। ইউজিসি তাদের নিয়ম অনুযায়ী প্রক্রিয়া অনুসরণে তদন্ত সম্পন্ন করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করে। ইউজিসি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিধায় এ প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোন ধরনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই। তার অভিযোগ অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, উপাচার্য সরাসরি শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য রেখেছেন যা নিতান্তই অনভিপ্রেত। তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে যে সভাটিতে মন্ত্রীর দেরিতে উপস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করেছেন সে সভাটি সকালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরে সভাটির সময় পরিবর্তন করে বিকেলে নেয়া হয়। ওই একইদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের অভিন্ন ন্যূনতম নির্দেশিকা প্রণয়ন সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সভা থাকায় এবং সে সভাটি উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনার পূর্বে হলে ভাল হয় বিবেচিত হওয়ায় উপাচার্যের সঙ্গে সভাটির সময় পরিবর্তন করা হয়েছিল। শিক্ষক নিয়োগের অভিন্ন ন্যূনতম নির্দেশিকার সভাটি নির্ধারিত সময়ের চেয়েও অনেক প্রলম্বিত হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, সচিব এবং ইউজিসির চেয়ারম্যানসহ প্রতিনিধিবৃন্দের উপাচার্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় যোগ দিতে দেরি হয় এবং মন্ত্রী সকলের কাছে অনিচ্ছাকৃত এই বিলম্বের জন্য বিশেষভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। মন্ত্রীর সময়ানুবর্তিতার বিষয়টি সবার কাছে সুবিদিত। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তা শুধু অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনকই নয় নিতান্তই রুচি বিবর্জিত। উপাচার্য সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে যেসব বক্তব্য রেখেছেন সে সকল বিষয়ে এ মুহূর্তে মন্ত্রণালয় কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছে। প্রতিবেদন নিয়ে শীঘ্রই মন্ত্রণালয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। আরেকটি অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে। এদিকে ইউজিসির সদস্য ও বেরোবির তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর মোঃ আলমগীর বলেছেন, ইউজিসির নিজস্ব দায়িত্ব ও ক্ষমতাবলে এ তদন্ত কমিটি করেছে। এখানে কোন ব্যক্তি প্রভাবিত করেনি। তদন্ত কমিটি বেরোবিতে যায়নি উপাচার্যের এমন অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক আলমগীর বলেন, আমরা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছি। একজন ভিসি ক্যাম্পাসে যেতে পারেন না এটা কত লজ্জার বিষয়।
×