ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মার্চ মাস মানেই স্বাধীনতার বারতা

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ৪ মার্চ ২০২১

মার্চ মাস মানেই স্বাধীনতার বারতা

স্বাধীনতা শব্দটি আপেক্ষিক, কিন্তু এর গভীরতা এবং ভাবাবেগ সুতীব্র। আর সে স্বাধীনতা যদি অর্জিত হয় লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, তাহলে সে অর্জনের সার্থকতাই জাতিকে করে তোলে আত্মনির্ভরশীল, দেশপ্রেমিক এবং দেশের স্বার্থে নিবেদিতকর্মী। বাঙালী জাতির ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতার বীজ বপিত হয় বহু আগে থেকেই। ধীরে ধীরে আন্দোলনের জন্য মাঠ পর্যায় থেকে সংগঠিত হতে থাকে বাংলার জনগণ। কেন্দ্র থেকে স্কুল পর্যায় পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রামের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। তিলে তিলে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে বাংলার জনগণ। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৬২ সাল থেকে ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজী আরিফ আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য গোপনে কাজ করত একটি গ্রুপ। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস নামে সংগঠনটি তাদের তৎপরতা দেশব্যাপী চালাতে থাকে। পরবর্তীতে এ সংগঠনটি বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রণ্ট বা মুজিব বাহিনী নামে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও, এলাকাভিত্তিক বহু সংগঠন তৈরি হয় মুক্তিসংগ্রামের জন্য, পরবর্তীতে উক্ত গ্রুপগুলো সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তারপরেও বিশেষভাবে বললে স্বীকার করতেই হবে, মার্চ মাসেই অর্জিত হয় বাঙালী জাতির স্বাধীনতার সোপান। মার্চের প্রতিটি উত্তাল দিন বাঙালী জাতিকে যুগিয়েছে সাহস, করেছে আবেগী, দেশমাতাকে মুক্ত করার অনুপ্রেরণায় আপামর জনসাধারণের সে কি প্রচেষ্টা; সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। ১৯৭০ সালের নবেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু তৎকালীন সামরিক গোষ্ঠী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে দেয়। সেই অবস্থা দেখেই বাঙালীরা নিজেদের জোটবদ্ধ করতে থাকে স্বাধীনতার জন্য। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের জন্য তারিখ নির্ধারিত করে। কিন্তু গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো। যার বদৌলতে পূর্বঘোষণা ছাড়াই পহেলা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করা হয়। এই ঘোষণায় পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। ঢাকা পরিণত হয় বিক্ষোভের নগরীতে। বঙ্গবন্ধু ৫ দিন হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সারাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সামরিক সরকার কার্ফু জারি করে পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলতে তৎপরতা চালায়। কিন্তু আপামর জনসাধারণের আন্দোলনের মুখে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ মুখ থুবড়ে পড়ে এবং সকল অপকর্মের নিশান ভণ্ডুল হয়ে যায়। ২ মার্চ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বহুল ঘটনা আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে স্মরণীয় হয়ে আছে। ২ মার্চ হরতাল চলাকালে কলা ভবনের সামনে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয় পল্টন ময়দানে। এবং ঐ দিনই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় সমবেত কণ্ঠে। মার্চের ৪ তারিখ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়। সারাদেশে সরকারী পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ জনগণের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে বহু মানুষ হতাহত হয়, চট্টগ্রামে ২দিনে ১২০ জন নিহত এবং ৩৩৫ জন আহত হয়। খুলনায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২২ জন আহত এবং ৬ জন নিহত হয়। এ রকমভাবে দেশের সব প্রান্তেই মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে সরকারী বাহিনীর সংঘর্ষের কারণেই দেশব্যাপী জনগণ মুক্তির স্বাদ নিতেই বঙ্গবন্ধু আহূত হরতালকে সর্বাত্মকভাবে পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঘটনাপ্রবাহ বাঙালী জাতির ইতিহাসে একটি অসাধারণ অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামের মহাসমারোহে মুক্তিপাগল প্রত্যেকটি বাঙালী বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল, তারা ব্যাকুল হয়ে বসেছিল বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায়। সারাদেশ থেকে স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষেরা সদলবলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের পথ ধরে হাঁটা শুরু করে। প্রত্যেকের মাঝে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বঙ্গবন্ধু আজ কি স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন, কি আশার বাণী শোনান বঙ্গবন্ধু সে দিকে তাকিয়ে ছিল লাখ লাখ মানুষ। এ দিকে পাকিস্তানী জান্তা সরকার বন্দুক তাক করে তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে, পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের বিজয়কে হটানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। তবু প্রবল উৎসাহ, উদ্দীপনা নিয়ে বাঙালী জাতি তাদের নেতার ভাষণ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে রেসকোর্স ময়দানের দিকে হাঁটা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ একটি সংগ্রাম, একটি ইতিহাস, বৈপ্লবিক অর্জন এবং সামষ্টিক বিজয়। বাঙালীর জীবনে এর থেকে বড় অর্জন আর কখনোই আসবে না। স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। তাই সামাজিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালী জাতির এ মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং নেতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য দেশমাতার সন্তানরা তাদের নিজেদের জীবনকেও উৎসর্গ করতে পিছপা হয়নি। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ এ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মধ্যে কিছু পাকিস্তানপন্থী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছাড়া অধিকাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোনভাবে অবদান রেখেছেন, যার ফলে মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বাঙালীর মহান স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার অর্জন তখনই অর্থবহ হবে যখন এর পেছনের কারিগরদের যথাযোগ্য মর্যাদায় উপযুক্ত আসনে অধিষ্ঠিত করা যাবে। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায়, একজন নারী মুক্তিসংগ্রামের ক্ষেত্রে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। তাই, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা আলোকপাত করতে হলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা প্রয়োজন। ২৫ মার্চের বিভীষিকাময় রাতের কথা এখনও বাঙালী জাতির জীবনে সংগ্রামের প্রভাবক হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা, দুষ্কৃতকারীরা ষড়যন্ত্র করে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ দেশের প্রথিতযশা নাগরিকদের এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় হত্যা করে। তারপরেও বাঙালীকে, বাঙালীর সত্তাকে কোনভাবেই ধ্বংস করতে পারেনি। চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বীর বাঙালী স্বাধীনতার সূর্যকে রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। হানাদাররা সে রাতেই বাঙালী বিবেকের জলন্ত ভাস্বর, বিবেক ও অভিভাবক শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ভাষণ দিয়ে বাঙালী জাতিকে মুক্তি সংগ্রামের জন্য আহ্বান জানান। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বীর বাঙালী সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বলেই দেশ অল্প সময়ে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। আলোচনার বিশ্লেষণে বলা যায়, মুক্তিসংগ্রামের পথিকৃৎ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চিরভাস্বর। সে সঙ্গে সঙ্গে মার্চ মাস ছিল বাঙালীর আন্দোলনের সূতিকাগার স্বরূপ। কারণ, এ মাসেই মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ এবং সোনালি অর্জনগুলো এসেছে। এ মাসেই জাতির জনককে পাকিস্তানের কারাগারে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গ্রেফতারের পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা যেমন বাঙালী জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন আর সে স্বাধীনতার প্রাপ্তির গোড়াপত্তন হয়েছিল মার্চ মাসেই। তাই, বাংলা এবং বাঙালীর জীবনে মার্চ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। লেখক : প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×