ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে

মেধাবীরাই জঙ্গী সংগঠনগুলোর টার্গেট

প্রকাশিত: ২৩:২১, ৩ মার্চ ২০২১

মেধাবীরাই জঙ্গী সংগঠনগুলোর টার্গেট

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অসাধারণ মেধাবী। অমায়িক আচার ব্যবহার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। সমাজে তার চেয়ে ভদ্র ছেলে আর দ্বিতীয়টি হয় না। পরিবার নিশ্চিত ছিল এই ছেলে একদিন অবশ্যই বড় কিছু হবে। তার নজিরও দেখা গেল। অসম্ভব ভাল রেজাল্ট করল এসএসসি আর এইচএসসিতে। জেলা শহরের কলেজ থেকেও চান্স পেল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাও আবার ব্যবস্থাপনা বিভাগের মতো বিষয়ে। পিতামাতা ভাই-বোন নিশ্চিত একদিন তাদের অভাব ঘুচবে। আলো আসবে সংসারে। সেই সংসারে এখন ঘোর অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছে। একাধিক মামলার আসামি সেই উচ্চশিক্ষিত যুবক দুর্ধর্ষ জঙ্গী হিসেবে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। গণমাধ্যমে সেই ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর এলাকায় হৈচৈ পড়ে গেছে। এমনই ঘটনা ঘটেছে দুর্ধর্ষ জঙ্গী তার সহযোগী হিসেবে গ্রেফতার হওয়া আরেক মেধাবী প্রকৌশলীর বেলায়ও। বলছিলাম গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন ঘাটারচরের খালপাড় থেকে গ্রেফতার হওয়া নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য মোঃ রফিকুল ইসলাম রুবেল ওরফে ইমতিয়াজ ওরফে আব্বাসের (২৭) কথা। তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী প্রকৌশলী মোঃ আশিক ইকবাল জনি (৪৩) নামের জঙ্গী সংগঠনটির আরেক সদস্যও গ্রেফতার হয়। তাদের কাছে অত্যাধুনিক বিদেশী পিস্তল, গুলি, উগ্রবাদী বই ও জঙ্গীবাদের নানা আলামতসহ ল্যাপটপ পাওয়া গেছে। অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাব-২ এর মিডিয়া বিভাগের সহকারী পরিচালক সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানালেন এমনই পিলে চমকানোর মতো তথ্য। তিনি বলছেন, ইমতিয়াজের পিতার নাম আব্দুল হাই। মায়ের নাম মৃত রহিমা বেগম। বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানাধীন গাঙ্গাইল গ্রামে। অভাবের সংসারে বড় হয়েছে। অভাবের মধ্যেও এসএসসি ও এইচএসসিতে অসম্ভব ভাল রেজাল্ট করেছে। এত ভাল রেজাল্ট করার পরেও শুধু অর্থের অভাবে তার কোন নামীদামী কলেজে এইচএসসি পড়ার সুযোগ হয়নি। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসিতে ভাল রেজাল্ট করেছে। এরপর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। তাও আবার ব্যবস্থাপনা বিভাগে। অনেক কষ্টে তার পড়াশোনা চলছিল। সেই অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়েছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। নানাভাবে তাকে সহায়তা করেছে। সে বুঝতেই পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য আব্দুল্লাহ, ঢাকার সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরেক জঙ্গী সানোয়ার ও ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা আজমলের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। ২০১৫ সালে ইমতিয়াজ নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করে। ততদিনে ইমতিয়াজ একটি মামলার আসামিও হয়ে যায়। অভাবের সংসারে হাল ধরার কথা ছিল ইমতিয়াজের। পিতামাতা ভেবেছিল ইমতিয়াজ একদিন মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশ, সমাজ ও পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে। তার কিছুই হয়নি। পুরো পরিবার এখন হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত। দেশের অন্যতম একটি ইসলামী সংগঠন বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের মাধ্যমে এবং ওই সংগঠনটি সরাসরি জঙ্গী অর্থায়ন করে বলেও জানা গেছে। সেই সংগঠন সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। ইসলামী এই সংগঠনটির প্রধান টার্গেট দরিদ্র মেধাবী ছাত্ররা। র‌্যাব কর্মকর্তা এসএসপি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছেন, ইমতিয়াজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে একই জঙ্গী সংগঠনের আরেক সদস্য মোঃ আশিক ইকবাল জনিকে (৪৩) গ্রেফতার করা হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে গাজীপুর জেলার টঙ্গী বাইপাস সড়ক থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার পিতার নাম মৃত আবুল কাশেম। সে ঝিনাইদহ সদর থানাধীন আরাপপুর এলাকার ১৭ নম্বর কর্নেল রহমান সড়কের ১৫১ বাড়ির বাসিন্দা। সে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানাধীন দেলপাড়ার চেয়ারম্যান বাড়ির সড়কের কুতুব উদ্দিন ডাক্তারের দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত। অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। জঙ্গী সংগঠনটির বিভিন্ন সদস্যকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিত। জনি পেশায় প্রকৌশলী। একটি খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। জনির বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। তার সঠিক পথে ফেরার বিষয়ে চেষ্টা চলছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, গ্রেফতারকৃতরা একটি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সদস্য স্বীকার করলেও, তারা যে ভুল পথে আছে, সেটি তারা স্বীকার করে না। তারা মনে করে, এটিই সঠিক পথ। তারা সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। ইতোমধ্যেই তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় গোপন বৈঠক করেছে। প্রচারের মাধ্যমে সংগঠনে নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার কাজ করছিল। তার পরিবার সম্পর্কেও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত আছে। জনিকে র‌্যাবের ‘ডি-রেডিক্যালাইজেশন এ্যান্ড রিহ্যাবিটেলাইজেশন’ অর্থাৎ জঙ্গীবাদের মোহ থেকে সরিয়ে এনে পুনর্বাসন করার কর্মসূচীর আওতায় আনা যায় কিনা সে চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক অন্য সদস্যদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, একই সঙ্গে জঙ্গীদের ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনার কাজ চলছে। পাশাপাশি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া সদস্যদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে।
×