ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইশতেহার ঘোষণার দিনই ছাত্রলীগের প্যাডে প্রথম ‘জাতির পিতা’ স্বীকৃতি!

প্রকাশিত: ২৩:২০, ৩ মার্চ ২০২১

ইশতেহার ঘোষণার দিনই ছাত্রলীগের প্যাডে প্রথম ‘জাতির পিতা’ স্বীকৃতি!

মোরসালিন মিজান ॥ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির পিতা। আজ সাংবিধানিকভাবেও এ সত্য স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। শুধু বংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালী জাতির পিতা হিসেবে জানে। তবে তারও বহুকাল আগে এ স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন শেখ মুজিব। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই যেমন স্বাধীন দেশ কল্পনা করা হয়েছিল, তেমনি মুজিবকে কল্পনা করা হয় ‘জাতির পিতা’ হিসেবে। একটু একটু করে বিষয়টি প্রচারে আসে। মুখে মুখে প্রচারিত হলেও, শেখ মুজিবুর রহমানকে লিখিতভাবে কবে প্রথম ‘জাতির পিতা’ উল্লেখ করা হয় তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন ডকুমেন্ট পাওয়া যায় না। তবে এ সংক্রান্ত একটি দুর্লভ নথি বলছে, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণার ঐতিহাসিক দিন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ, অর্থাৎ, আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে লিখিত স্বীকৃতি দেয়া হয়। সভা শেষে ছাত্রলীগের গ্রহণ করা একটি রেজোলিউশনে ‘জাতির পিতা’র উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি জাতির পিতা হিসেবে মুজিবের প্রথম লিখিত স্বীকৃতি বলে এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবাদ ও আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচীর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকার পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ করা হয় তিনটি লক্ষ্যের কথা। লক্ষ্য তিনটির মধ্যে ছিল বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ, বৈষম্যের নিরসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। একই সমাবেশে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির কথা প্রস্তাব করা হয়। পাস হওয়ার পর সবাই মিলেই গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত। একদিন আগে ২ মার্চ প্রথমবারের মতো উত্তোলন করা জাতীয় পতাকাও ওড়ানো হয় সমাবেশে। ঘটনাবহুল সমাবেশে অনির্ধারিতভাবেই এসে উপস্থিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। মহান নেতার উপস্থিতি সমাবেশকে পূর্ণতা দেয়। বক্তৃতায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন শেখ মুজিব। জনগণের প্রতি খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন। ইয়াহিয়া সরকারের প্রতি অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান তিনি। ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘সর্বাধিনায়ক’ ঘোষণা করা হয়। আর সভা শেষে রেজ্যুলুশনে উল্লেখ করা হয় ‘জাতির পিতা’ হিসেবে। এ সংক্রান্ত মূল নথিটি তখন থেকেই সংরক্ষণ করছেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সহদফতর সম্পাদক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। এখনও অমূল্য স্মারকটি তার কাছেই রয়েছে। তাতে দেখা যায়, নথিটি ছাত্রলীগের প্যাডের একটি পাতা। প্যাডের একেবারে উপরে মাঝখানে ছাপা অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘পূর্ব পকিস্তান ছাত্রলীগ।’ নিচে ছোট্ট করে ছাপার অক্ষরে ‘কেন্দ্রীয় সংসদ’ কথাটি লেখা। ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘৪২ বলাকা ভবন, ঢাকা ২।’ তারিখের জায়গায় কলম দিয়ে লেখা আছে ‘৩/৩/৭১।’ মূল বক্তব্যটি বলপয়েন্ট কলমে লেখা। ‘ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভার প্রস্তাবাবলী’ তে ৫টি প্রস্তাব গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়। ৪ নম্বর প্রস্তাবে এসে লেখা হয়, এই সভা স্বাধীন বাংলার ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রাখিয়া তাঁহার সকল চালাইয়া যাওয়ার সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছে। ৫ নম্বর প্রস্তাবেও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই প্রস্তাবাবলীর আগে বা ১৯৭১ সালের ৩ মার্চের আগে কোথাও শেখ মুজিবুর রহমানকে লিখিতভাবে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা যায় না। সেদিক থেকে অনেকেই মনে করেন ‘জাতির পিতা’ উল্লেখ রয়েছে এমন দলিল এটিই প্রথম। বিষয়টি নিয়ে আরও নিশ্চিত হতে কথা হয় দুর্লভ নথিটির সংগ্রাহক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের সঙ্গে। তার বক্তব্য : ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে বলেই এখনও এটি আমি সযতেœ সংরক্ষণ করছি। ওই দিনের সভার প্রস্তাবাবলীতেই প্রথম লিখিতভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর আগে কোথাও লিখিতভাবে তাঁকে জাতির পিতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ করার প্রশ্নই আসে না। এ পর্যায়ে জরুরী তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, আমি নিজ হাতে এই প্রস্তাবাবলী লিখেছি। আমারই লেখা। কোথায় বসে লেখা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব সম্ভবত ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। একই সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া। পরবর্তীতে জাসদে যোগ দেয়া এই নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা তখন শেখ মুজিবুর রহমানকে মুখে মুখে তো জাতির জনক বলতামই। বলা হতো। লেখাও হয়তো হয়েছে। একইভাবে ৩ মার্চের সভার যে প্রস্তাবাবলীর কথা বলা হচ্ছে সেখানে ‘জাতির জনক’ কথাটি উল্লেখ করা হয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি এখন আর স্মৃতিতে নেই। এটি প্রথম হতে পারে বললেও, এ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তিনি।
×