ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাতে হাতে পলো টেঁটা ঝাঁকিজাল- মাছ নিয়ে ঘরে ফেরা

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২ মার্চ ২০২১

হাতে হাতে পলো টেঁটা ঝাঁকিজাল- মাছ নিয়ে ঘরে ফেরা

বাবু ইসলাম ॥ বাউত। গ্রামীণ জনপদে একটি অতিপরিচিত শব্দ। গ্রামে বেড়ে ওঠা কিংবা গ্রামে বসবাস করা বেশির ভাগ মানুষ বাউত শব্দের সঙ্গে পরিচিত। গ্রামের খালবিল, শাখা নদী, জলাশয়ে সবাই মিলে মাছ শিকার করাকে বাউত বলা হয়। বাউত শব্দটি এখন আর তেমন একটা শোনা যায় না। খালবিলে পানি নেই, মাছের প্রাকৃতিক প্রজননস্থলও কমে গেছে। সময়ের ব্যবধানে বাউত উৎসবও আগের মতো নেই। এক সময় বিলের মাছ ধরতে দূর-দূরান্ত থেকে আসতেন শৌখিন মাছ শিকারিরা। সবার হাতে হাতে মাছ ধরার নানা উপকরণ। কেউ পলো নিয়ে, কেউ বা ঝাঁকিজাল নিয়ে যোগ দিত মাছ ধরার এই বাউত উৎসবে। মাছ ধরায় ছিল না বিধিনিষেধ। আর এই কারণেই এটি উৎসবে পরিণত হতো। মাছ ধরার এমন আয়োজনকে স্থানীয়রা বলত ‘বাউত উৎসব’। কবে থেকে শুরু মাছ ধরার এই মজার উৎসব তার সঠিক তথ্য কারও কাছে জানা নেই। তবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই রীতি। প্রতিবছর কার্তিক মাসের শেষে শুরু হয়ে চলত পৌষ মাস পর্যন্ত। শীতের শেষদিকে খালবিলে পানি শুকিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামগঞ্জে বাউত নেমে মাছ ধরা হয়। বিল, বড় সরকারী জলাশয় কিংবা অভ্যন্তরীণ নদীর আশপাশের গ্রাম থেকে দল বেঁধে তরুণ, কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত পলো, টেঁটা, ঝাঁকিজালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে মাছ ধরতে আসত। অনেকেই আবার খালি হাতেও মাছ ধরতে আসত। বাউত উৎসবে বিল থেকে শোল, বোয়াল, শিং, মাগুর গোলসা, টেংরা, কৈসহ নানা জাতের মাছ ধরে হাসি-তামাশায় আনন্দ করতে করতে সবাই বাড়ি ফিরেছে। এ সময় বিলের চারপাশে উৎসুক জনতারও ভিড় লেগে যেত। বিলে বাউত নেমেছে মানে গণ মাছ শিকার উৎসব শুরু হয়েছে। এই উৎসব এক বিল থেকে আরেক বিলে ছড়িয়ে পড়েছে। বাউত শব্দের উৎস কোথায়, তা সঠিক জানা না থাকলেও ধারণা করা হয়- বারোয়ারি মাছ শিকারের সম্মিলন বা উৎসব থেকেই বাউত শব্দটি চালু হয়েছে। সে সময় বর্ষা মৌসুমে খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকত। প্রাকৃতিকভাবেই মাছের প্রজনন হতো। তখন ওই বিলগুলোতে মাছ থাকত প্রচুর। একযোগে অনেক মানুষ বিলে নামায় নিচ থেকে কাদা নরম হয়ে পানি ঘোলা হয়ে যেত। ঘোলা পানিতে অক্সিজেন কমে যায়। ফলে অক্সিজেন নিতে মাছগুলো পানির ওপরের স্তরে চলে আসত। কোন মাছের মাথা ভাসতে দেখলেই শিকারিরা পলো কিংবা টেঁটা দিয়ে সেটিকে ধরার চেষ্টা করত। এভাবে শিকারিরা মাছ শিকার করতে খুব মজা পেত। আবার অনেক সময় পায়ের নিচেই মাছ আটকে পড়ত। সেসব মাছ হাত দিয়ে ধরা হত। কেউ কেউ গামছা বা জাল দিয়ে ছোট মাছ যেমন টেংরা, পুঁটি শিকার করতো। বিলে যত মানুষ আসত, সবাই কমবেশি মাছ শিকার করতে সক্ষম হতো। কেউই বাউত থেকে খালি হাতে ফিরত না। কোন একজন একটা বড় মাছ ধরলে চিৎকার করে জানিয়ে দিত সে বড় মাছ ধরেছে। আর সবাই সেদিক তাকিয়ে দেখত। বাউত থেকে মাছ হাতে করে আনন্দ করতে করতে ঘরে ফিরত। কারও হাতে রশিতে বাঁধা বোয়াল, শোল-গজার। ছোট ছোট ছেলেরাও কিছু না কিছু মাছ নিয়ে ঘরে ফিরত। প্রতিটি গ্রাম থেকে আসা লোকজন আবার একসঙ্গেই বাড়ি ফিরত। সেদিন পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর বউ-ঝিদের মাছ কুটা, ধোয়া, রান্নার ধুম পড়ে যেত, উৎসব লেগে যেত। সময়ের বিবর্তনে বিল আর বিল নেই। ধানী জমি, বাড়িঘর হয়ে গেছে। আর বাউত নামে না, এখন পুকুরে মাছ চাষ হয়। সিলভার কার্প, জাপানী রুই- নতুন নতুন মাছ বাজারে ওঠে, হাটে ওঠে। তবে স্বাদ নেই, সবই যেন পানসে পানসে। সেই বাউতও নেই, সেই শোল, বোয়াল, শিং, মাগুর, কৈ, রুই-কাতল মাছেরও আর আগের মতো স্বাদ নেই। এখনকার মানুষ সেই বাউতের কথাও ভুলে গেছে, বড়ই ঘোনা, রাজার ছামও হারিয়ে যাচ্ছে নতুন নামের আড়ালে।
×