ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গবেষণা রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর দফতরে

অতি আহরণে হুমকির মুখে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২ মার্চ ২০২১

অতি আহরণে হুমকির মুখে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অধিকসংখ্যক ট্রলার ও ফিশিং বোটের অতি আহরণের কারণে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ জলসীমায় সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে বড় বড় ও দামী মাছের মজুদ অবস্থা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে গভীর সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা মাছশূন্য হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে; যা বিশে^র কয়েকটি দেশে ইতোমধ্যে হয়েছে। মৎস্য অধিদফতর এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের আওতায় সর্বশেষ পরিচালিত গবেষণা রিপোর্টে এই হুঁশিয়ারি তুলে ধরা হয়েছে। প্রায় ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় করা ‘আরভি মিন সন্ধানী’ জাহাজযোগে প্রায় ২৫টি ভয়েজ পরিচালনা শেষে সায়েন্টিফিকপুলের সদস্যদের পক্ষে প্রদত্ত রিপোর্টের সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ইতোমধ্যে মারাত্মকভাবে অতি আহরিত হয়ে গেছে এবং এখনও হচ্ছে। এতে করে দামী এবং বড় প্রজাতির মাছের মজুদ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ জাতীয় মাছের মজুদ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরী। সবচেয়ে বেশি আহরিত বড় মাছের প্রজাতির মধ্যে রয়েছে লাক্ষ্ম্যা, রূপচাঁদা, তাইল্লা ও পোয়ামাছ। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ জলসীমার মধ্যে উপকূল থেকে ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিটার গভীরে মূলত মাছের যে মজুদ রয়েছে সেখানে চলছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার ফিশিং বোট ও ২৭৫টি ট্রলারের নির্বিচারে মৎস্য আহরণ। শুধু তাই নয়, ইন্টারপোলের রেড এলার্টে থাকা বিদেশী ১০টি ট্রলারও কৌশলে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে একটি চক্র। ফিশিং দফতর এদের মাছ ধরার প্রক্রিয়ায় লাইসেন্সসহ আনুষঙ্গিক কর্মক্রিয়ার অনুমতি না দিলেও উচ্চ আদালত থেকে এ চক্রটি রায় নিয়ে এসেছে। ২০১৭ সালের শেষদিকে দেশের সমুদ্রসীমায় সামুদ্রিক মাছসহ অর্থকরী সম্পদের মজুদ সন্ধানে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয় গবেষণা জাহাজ ‘আরভি মিন সন্ধানী’। প্রায় তিন দশক পর বাংলাদেশ জলসীমায় নতুন করে গবেষণা শুরু হয়। এ গবেষণায় যুক্ত রয়েছে সায়েন্টিফিক একটি টিম। এ টিমে রয়েছেন ৩০ সদস্য। প্রতিক্রুজে আটজনের একটি দল দশদিনের সমুদ্র গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী গবেষণা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের নবেম্বর মাস পর্যন্ত সায়েন্টিফিক টিমের সদস্যরা প্রায় ২৫ ক্রুজ শেষে একটি রিপোর্ট তৈরি করে তা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জমা দিয়েছে প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু এ বিষয়ে এ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন গবেষণায় জড়িতদের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, মজুদ নিরূপণ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পরিস্থিতি বিবেচনায় দুই ধরনের উপাত্ত বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। আহরণ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুটি রেফারেন্স অবস্থার বিপরীতে মজুদের অবস্থা জানানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে। এতে পরিমাণগত তারতম্য বিশ্লেষণের গাণিতিক মডেল থেকে মজুদের একটি সম্ভাব্য হিসাব এবং বছর থেকে বছরে আহরণ ও আহরণমাত্রার তারতম্যের বিশ্লেষণ থেকে মজুদের গতি-প্রকৃতির আভাস মিলেছে। অতীতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতে আহৃত মাছের প্রতিবেদনের অপূর্ণতা উপাত্ত বিশ্লেষণে জটিলতা সৃষ্টি করেছে, যা ২০১১ সালের পরে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ সমস্যার কারণে ২০১১ সাল থেকে ধৃত মাছের পরিমাণে হঠাৎ বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। ফলে এর মর্মার্থ দাঁড়ায় যে, ধৃত মাছের পরিমাণ হ্রাসের যে চিত্র ওই বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, বাস্তব পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন প্রকার মাছের মজুদ ও আহরণের হার ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা প্রদর্শন করছে। বৃহদাকার ও অধিক মূল্যবান মাছের গ্রুপসমূহ প্রায় নিঃশেষ হওয়ার পথে। তবে উপজাত হিসেবে ধরা হয় এমন কিছু মাছের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী প্রবণতা লক্ষণীয়। ছোট আকারের পেলাজিক মাছ, বিশেষত সার্ডিন/চাপিলা আহরণ বেড়ে যাওয়া দুশ্চিন্তার বিষয়। ২০১১ সাল থেকে এ গ্রুপটির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করা হয়। তবে এত স্বল্পমেয়াদী উপাত্ত থেকে এদের প্রকৃত মূল্যায়ন করা কঠিন হলেও কিছু পর্যবেক্ষণ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। বটম ট্রলকে পর্যায়ক্রমে মিড ওয়াটার ট্রলে রূপান্তরে বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়ন শুরু হলেও প্রকৃত চিত্র ভিন্ন পাওয়া গেছে। ওই রূপান্তরের উদ্দেশ্য ছিল ছোট আকারের মাছের ক্রমবর্ধমান মজুদকে আহরণ করা। কিস্তু বাস্তবে দেখা গেছে, মিড ওয়াটার ট্রলে চিংড়িও আহৃত হয়েছে। ফলে সহজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে যে, মিড ওয়াটার ট্রলগুলো বস্তুত কম গভীরতায় বটম ট্রল হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না। তবে এক্ষেত্রে সার্ডিন/চাপিলাও এখন অতি আহৃত হচ্ছে এবং এ জাতীয় মাছের মজুদও হ্রাস পেতে শুরু করেছে। রিপোর্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিগত ত্রিশ বছর ধরে সকল প্রকার চিংড়ির মজুদ ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে এ মজুদ নিঃশেষিত হওয়ার পর্যায়ে। বিগত বারো বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সবচেয়ে মূল্যবান বাগদা চিংড়ি ও হরিণা চিংড়ির মজুদ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। তবে সাদা চিংড়ির মজুদ ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার পর ২০১৭ সালে কিছুটা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে তা আবার হ্রাস পেতে শুরু করেছে। অন্যান্য চিংড়ি হিসেবে চিহ্নিত কম মূল্যমানের ও ক্ষুদ্রাকার চিংড়িগুলোকেই ধরা হয়েছে। এ চিংড়ির আহরণের পরিমাণ বেড়েছে। এককথায় মূল্যবান চিংড়ির আহরণ কমে গেলেও কমমূল্যের চিংড়ির আহরণ বৃদ্ধি পরিস্থিতিকে কিছুটা সামাল দিচ্ছে।
×