ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আজ জাতীয় বীমা দিবস ॥ প্রতি হাজারে জীবনবীমা আছে মাত্র ৪ জনের

আস্থা বাড়ানোই বীমার চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ১ মার্চ ২০২১

আস্থা বাড়ানোই বীমার চ্যালেঞ্জ

রহিম শেখ ॥ জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় বীমার গুরুত্ব ব্যাপক। ব্যক্তিগত সম্ভাব্য ঝুঁকির পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্য খাতের ঝুঁকির বিপরীতেও আর্থিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে বীমা। দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতির অনেকটাই পুষিয়ে দেয় বীমা। এত সুবিধা থাকার পরও দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ খাত খুব বেশি সম্প্রসারিত হয়নি। একটা সহজ উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে বীমা খাতের অবস্থা। আর তা হলো- প্রতি হাজারে জীবন বীমা আছে মাত্র চারজনের। বাংলাদেশের মোট দেশজ আয়ের মাত্র দশমিক ৫৫ শতাংশ বীমা খাতের প্রিমিয়াম আয়। যেখানে ভারত ৪ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১ দশমিক ২ শতাংশ, ফিলিপিন্সে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। আজ সোমবার দেশজুড়ে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে জাতীয় বীমা দিবস। দিবসটিকে সামনে রেখে উদ্ভাবনী পণ্য বা সেবা চালুর মাধ্যমে বীমা খাতের সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এজন্য সবার আগে আস্থা বাড়ানোই বীমার খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জানা গেছে, দেশে জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা মিলিয়ে ৭৮ কোম্পানি কাজ করলেও জিডিপিতে এ খাতের অবদান খুবই সামান্য। পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠান সুইস রি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইন্স্যুরেন্সের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে বীমার পেনিট্রেশন বা অন্তর্ভুক্তি ছিল জিডিপির শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে চলতি হিসাবে দেশের জিডিপির আকার মোট ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ সময়ে গড় মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৯০৯ ডলার। এরপরও বীমার পেনিট্রেশন বাড়েনি। এর অন্যতম কারণ অনেক বীমা কোম্পানি থাকলেও এখানে বাজার সেভাবে উন্মুক্ত হয়নি। বলা যায়, এখনও পরিসর বেশ সীমিত। যেমন- গাড়ি বীমার আওতায় আনা হলেও যথাযথ লাইফ কাভারেজের বাইরে থাকছেন যাত্রী বা চালক। কর্পোরেট সুশাসন, অদক্ষ মানবসম্পদ, বীমা পণ্য ও সম্পদ দায়ের ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে এখনও। ফলে বীমাশিল্প থেকে আর্থিক খাত প্রত্যাশিত সুফল পাচ্ছে না। সার্বিক আর্থিক খাত বিশেষ করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিসর বাড়াতে বীমা খাত যতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে তা এখানে হচ্ছে না। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশে প্রচুর বীমাযোগ্য মানুষ ও সম্পদ রয়েছে। ফলে এ খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। প্রতিবন্ধকতাও অনেক। প্রধান প্রতিবন্ধকতা বীমা খাতের নেতিবাচক ভাবমূর্তি। অধিকাংশ মানুষ এখনও বীমার প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। এর অনেক কারণও আছে। এ সঙ্কট কাটাতে প্রথমে সেগুলো দূর করতে হবে। বিশেষ করে বীমা দাবি নিষ্পত্তি, জনগণকে বীমা বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেয়া, বীমা কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর কাজগুলো আগে করতে হবে। এ জন্য বীমা কোম্পানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্নিষ্ট সবাইকে মানুষের কাছে পৌঁছাতে এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। জানা যায়, ২০১৪ সালে জাতীয় বীমা নীতি করা হলেও এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে সব মানুষ এবং সম্পদকে বীমার আওতায় আনার রূপকল্প রয়েছে। বর্তমান জাতীয় বাজেটেও বহুমুখী বীমা ব্যবস্থার চালুর অঙ্গীকার করা হয়েছে। বীমাযোগ্য সব মানুষ ও সরকারী-বেসরকারী সম্পদ বীমার আওতাভুক্ত করা গেলে এ খাতের আরও সম্প্রসারণ সম্ভব। এটি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বীমা ব্যবসা এখনও সঞ্চয়কেন্দ্রিক। ঝুঁকিভিত্তিক বীমা বিশেষ চালু হয়নি। ২০১৮ সালে জীবন বীমা ব্যবসায় চলমান পলিসির সংখ্যা ছিল এক কোটি এবং সাধারণ বীমায় ২৮ লাখ। জীবন বীমায় ওই বছর ১৮ লাখ গ্রাহক নতুন পলিসি নেন। দেশে পরিবহনের সংখ্যা ৩৫ লাখ হলেও মোটর বীমা পলিসির সংখ্যা ১৬ লাখ। জাতীয় বীমা নীতিতে সরকার ২০২১ সালে পেনিট্রেশন ৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে বীমা গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। এখনও সাধারণ মানুষ বীমা পলিসির সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারে না। পলিসিগুলোর প্রস্তাবপত্র এবং বীমা চুক্তিপত্র খুবই জটিলভাবে লেখা। এসব বিষয় স্পষ্টিকরণে কোম্পানিগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। সহজ ও স্বচ্ছ ধারণা দেয়া গেলে সাধারণ মানুষ জীবন বীমা, স্বাস্থ্য বীমাসহ সম্পত্তির বীমা করবে। ভাল খবর হচ্ছে, বেশ কিছু কোম্পানি বীমা পলিসি অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছে। মোবাইল এ্যাপের মাধ্যমে প্রিমিয়াম গ্রহণ ও দাবি পরিশোধ করছে। এ খবর আশাবাদী করছে বিশেষজ্ঞদের। তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার পরও এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ, দেশের অর্থনীতি ইতিবাচকভাবে এগোচ্ছে। অথচ এখন প্রতি হাজারে মাত্র চারজনের জীবন বীমা রয়েছে। কৃষিবীমা, সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা, দুর্যোগবীমা নেই। অনেক সুউচ্চ ভবন, বড় প্রকল্প এখনও বীমার বাইরে রয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে বীমার বিস্তারে এসব খাতের বীমা বড় ভূমিকা রাখছে। শিক্ষা ও প্রবাসীদের বীমা নিশ্চিত করেও এ খাতের সম্প্রসারণ সম্ভব। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য বিশেষ ধরনের বীমা চালুর কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। রয়েছে পাবলিক পেনশন বীমা করার সুযোগ। এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে বীমার হাত ধরে অর্থনীতিতে তহবিল সরবরাহ বাড়বে। একই সঙ্গে পুনঃবীমার বাজারকেও সম্প্রসারণ করতে হবে। এসব পদক্ষেপ সরকারকে আকস্মিক বিপত্তিমূলক ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখবে। জানা গেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করেন। বীমা পেশায় তার যোগদানের দিনটিকে স্মরণে রাখতে বাংলাদেশ সরকার ১ মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। আজ সোমবার দেশজুড়ে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে জাতীয় বীমা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, বীমা হোক সবার’। আজ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বীমা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও উপস্থিত থাকবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দিবসটি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, যে দেশের বীমা খাত যত শক্তিশালী সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। এটা প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাই তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বীমা খাতের উন্নয়নে সংস্কারে হাত দেন। শেখ কবির হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু বীমা খাতের সঙ্গে যেভাবে জড়িত, অর্থনীতির আর কোন খাতের সঙ্গে এত বেশি সম্পৃক্ততা তার নেই। তিনি বীমা পেশার মাধ্যমে তার সংগ্রামী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। তাই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীমার খাতের বিশেষ অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রথম উপলব্ধি করেন, দেশের উন্নয়ন করতে হলে বীমার উন্নয়ন করতে হবে। তাই তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জীবন বীমা কর্পোরেশন ও সাধারণ বীমা কর্পোরেশন নামে সরকারী দুটি প্রতিষ্ঠান করেন। ১শ’ টাকার বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমায় ২ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ ॥ এবারের বীমা দিবসকে সামনে রেখে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা চালু করতে যাচ্ছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে ১৬ লাখের বেশি প্রতিবন্ধী শিশুকে বীমার আওতায় আনার উদ্যোগ হিসেবে সরকার চালু করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্যবীমা। বঙ্গবন্ধু ক্রীড়া প্রেমী ছিলেন, তাই তার প্রতি সম্মান জানাতে বঙ্গবন্ধু স্পোর্টসম্যান ইন্স্যুরেন্স চালু করা হয়েছে। এ ছাড়াও চালু করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা। বীমাটির মেয়াদ হবে এক বছর। এ সময়ে যদি কোন গ্রাহক মাত্র ১০০ টাকা প্রিমিয়ামে বীমা করেন তবে তাকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এ বিষয়ে আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা’ চালু করেছি। জাতীয় বীমা দিবসে বীমাটির উদ্বোধন করা হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন দেশের সব মানুষ যাতে সুরক্ষায় থাকেন। তার এ ইচ্ছা পূরণের জন্য আমরা উদ্যোগটি নিয়েছি। মাত্র ১০০ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। আইডিআরএর তথ্য মতে, বীমার মেয়াদ হবে এক বছর। এটি নবায়নযোগ্য (পরে মেয়াদ বাড়াতে পারবে)। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বীমা গ্রাহকদের বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৬ থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ বছর। আর গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ বছর। এককালীন বীমার প্রিমিয়াম ১০০ টাকা। কাভারেজ দুই লাখ টাকা। বীমার আওতায় আসা গ্রাহকের দুর্ঘটনায় ছয় মাসের মধ্যে মৃত্যু হলে তার ওয়ারিশদার দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। আঘাতের ছয় মাসের মধ্যে দুটি চোখ, কিংবা দুটি হাত, দুটি পা হারালে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এছাড়াও একটি হাত, একটি পা কিংবা একটি পা ও একটি হাত সম্পূর্ণ হারালে গ্রাহক দুই লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ পাবেন। একইভাবে আঘাতের ছয় মাসের মধ্যে একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে গেলে গ্রাহক এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। একইভাবে একটি হাত কিংবা একটি পা হারালে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এছাড়াও আঘাতের কারণে বীমা করা ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে কর্মাক্ষম হলে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। বীমাকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।
×