ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আর নয় কুইক রেন্টাল ॥ চুক্তির মেয়াদ শেষে অবসরে পাঠানো হচ্ছে

প্রকাশিত: ২১:৫২, ১ মার্চ ২০২১

আর নয় কুইক রেন্টাল ॥ চুক্তির মেয়াদ শেষে অবসরে পাঠানো হচ্ছে

রশিদ মামুন ॥ চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তেলচালিত সরকারী বেসরকারী বিদ্যুত কেন্দ্রকে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে দেশে বেইজ লোড বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসায় তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র আর চালানোর প্রয়োজন পড়ছে না। কেন্দ্রগুলো অবসরে পাঠানোর মধ্য দিয়ে কুইক রেন্টাল অধ্যায় শেষ হতে চলেছে। এখন দেশে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ২২ দশমিক ৫৯ ভাগ তেল থেকে উৎপাদন হচ্ছে। পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী দেশে ১০ ভাগ তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু মাস্টারপ্ল্যানের দ্বিগুণের বেশি তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র থাকায় উৎপাদন খরচে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন থেকে তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের বিষয়ে বিদ্যুত বিভাগ কি চিন্তা করছে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোকে মেয়াদ শেষের পর অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদি না বিশেষ কোন কারণ থাকে তাহলে যে কেন্দ্রেরই মেয়াদ শেষ হবে সেই কেন্দ্রকেই অবসরে পাঠানো হবে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, এখন দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর এবং রাজশাহী জোনে বিদ্যুতের লোভোল্টেজের সমস্যা রয়েছে। এজন্য সৈয়দপুরে পিডিবি একটি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে এনার্জি প্যাক একটি তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। সারাদেশে বিদ্যুত উৎপাদন বাড়লেও দেশের উত্তরাঞ্চলে জ¦ালানি সঙ্কটের কারণে তা বাড়েনি। সঙ্গত কারণে দেশের দক্ষিণ এবং পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তরে বিদ্যুত নিয়ে যাওয়া হলেও ওই এলাকার ভোল্টেজ লেভেল ঠিক রাখা কঠিন হয়। ফলে সেখানে তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ যৌক্তিক হলেও অন্য এলাকার জন্য তা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানতে চাইলে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা তেলচালিত কোন বিদ্যুত কেন্দ্র চুক্তি শেষ হওয়ার পর আর চুক্তি নবায়ন করছি না। কিন্তু যেখানে গ্যাসচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কেন্দ্রগুলো রাখতে হচ্ছে। কেননা সেগুলোর বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ইউনিট প্রতি এক টাকা ৯৫ পয়সা। এই মুহূর্তে এ ধরনের কেন্দ্র বন্ধ করা হচ্ছে না। পিডিবি সূত্র জানায়, সামিট পাওয়ারের মদনগঞ্জ কুইক রেন্টাল কেন্দ্রটি ২০১১ সালের ১ এপ্রিল উৎপাদনে আসে। কেন্দ্রটির চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩১ মার্চ। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মধ্যে মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াটের আরও একটি কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৭ মে। এই কেন্দ্রটি উৎপাদনে এসেছিল ২০১১ সালের ৮ মে। খানজাহান আলী পাওয়ারের নওয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াটের আরও একটি কেন্দ্র বন্ধ হচ্ছে। চলতি বছর ২৮ মে কেন্দ্রটির পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। কেন্দ্রটি ২০১১ সালের ২৯ মে উৎপাদনে এসেছিল। খুলনা-১১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের মেয়াদও শেষ হচ্ছে আগামী ৩১ মে। কেন্দ্রটি ১ জুন ২০১১ তে উৎপাদন শুরু করে। ডাচ বাংলা পাওয়ারের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট পাওয়ারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০ জুলাই। কেন্দ্রটি ২০১১ সালের ২১ জুলাই উৎপাদনে আসে। আগামী বছর ১২ জানুয়ারি মেয়াদ শেষ হচ্ছে সিনহা পাওয়ারের আমনারা ৫০ মেগাওয়াট, ২৫ মার্চ শেষ হচ্ছে জুলদা ১০০ মেগাওয়াট, পাওয়ার প্যাকের ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৬ মার্চ, এনপিসিএল এর কাটাখালি ৫০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২১ মে। চলতি বছর এবং আগামী বছর যে কেন্দ্রগুলো অবসরে যাচ্ছে সেই কেন্দ্রগুলো ২০১১ এবং ২০১২ সালে উৎপাদনে এসেছিল। ফার্নেস অয়েল চালিত কেন্দ্রগুলো পাঁচ বছর মেয়াদী হলেও মেয়াদ শেষের পর আরও একদফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। ফলে কেন্দ্রগুলো পাঁচ বছরের অতিরিক্ত আরও পাঁচ বছর চলার পর বন্ধ হচ্ছে। সাধারণত চুক্তির পাঁচ বছর চললেই উদ্যোক্তার বিনিয়োগসহ মুনাফা উঠে আসে। তবে শুরুর দিকে আনাড়ি কয়েকজন উদ্যোক্তা বিদ্যুত বাণিজ্যে লোকসান করলেও পরে আর কেউ তা করেনি। ফলে দ্বিতীয় মেয়াদে বিনিয়োগ ছাড়াই মুনাফা ঘরে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। সরকার ২০০৯ সালে প্রথম দফায় দায়িত্ব নেয়ার সারাদেশে তীব্র লোডশেডিংয়ের মধ্যে কিছুটা বাড়তি দরেই কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের চুক্তি করে। শর্ত ছিল দ্রুত বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোকে উৎপাদনে এনে সঙ্কট সামাল দিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তখনকার বাস্তবতায় দ্রুত বিদ্যুত পাওয়ার আর কোন বিকল্প ছিল না। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর দেশে মোট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তখন গড়ে দেশে বিদ্যুত উৎপাদন হতো তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আবাসিক শিল্প খাতে তখন ভয়ঙ্কর বিদ্যুত সঙ্কট ছিল। গড়ে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় ১২ ঘণ্টার উপরে লোডশেডিং হতো। অন্যদিকে দেশের গ্রামগুলোতে লোডশেডিং হতো ১৮ ঘণ্টা। ভয়ঙ্কর এই বিদ্যুত বিপর্যয় সামাল দেয়া সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। ভয়াবহ সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার মধ্যে বিদ্যুত ব্যবস্থার সম্প্রসারণও কঠিন হয়ে ওঠে। তখন দেশে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় ছিল মাত্র ৪৭ ভাগ। এই পরিস্থিতিতে সরকার ২০০৯ সালের পর বিদু্যুত সংযোগ কিছু দিনের জন্য বন্ধ রেখেছিল। এরপর দুই বছরের মধ্যে সঙ্কট সামাল দিয়ে সরকার বিদ্যুত ব্যবস্থা সম্প্রসারণ শুরু করে। এখন দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুত সুবিধার আওতায় এসেছে। তবে কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের পক্ষে যেমন যুক্তি ছিল ঠিক তেমনি সমালোচনাও ছিল । কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও এক দফা পূর্ণ মেয়াদ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে পরে প্রশ্ন ওঠে। এখনও মহল বিশেষ তৎপরতা চালাচ্ছে কেন্দ্রগুলোর আবার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য। সরকারের পরিকল্পনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সরকার বিদ্যুত ব্যবস্থার সম্প্রসারণে তিন ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেয়। শুরুতে স্বল্পমেয়াদী, দ্বিতীয় ধাপে ছিল মধ্যমেয়াদী এবং শেষ ধাপে ছিল দীর্ঘমেয়াদী। শুরুতে রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের মাধ্যমে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপে আইপিপি কেন্দ্রের মাধ্যমে মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে। তৃতীয় ধাপে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় দেশে মেগা বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে উৎপাদনে এসেছে দেশের মেগা বিদ্যুত প্রকল্পের মধ্যে পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র। নির্মাণ করা হচ্ছে রামপাল, মাতারবাড়ি এবং রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্র। কেন্দ্রগুলোর সবকটিই মেগা বিদ্যুত প্রকল্প। সরকার নতুন যে সব বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে তার বেশিরভাগই মেগা বিদ্যুত প্রকল্প। কেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সরকার বিতরণ এবং সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করছে। তেলচালিত এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগ বসে থাকার মধ্যেই নতুন করে আরও তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। যার সবগুলোই তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র। এই কেন্দ্রগুলোও এখন বছরের বেশিরভাগ সময় অলস বসে থাকে। তবে গ্রীষ্ম এবং শীতের বিদ্যুত চাহিদার মধ্যে প্রায় ছয় হাজার মেগাওয়াটের পার্থক্য রয়েছে। শীতে একটি তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রও চালানোর প্রয়োজন না হলেও গ্রীষ্মের কয়েকদিন তেলচালিত কেন্দ্র চালাতে হয়। এবারও দেশের গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ফার্নেস অয়েলে চার হাজার ৫৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। তবে গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট চাহিদা মেটাতে কোন ডিজেলচালিত কেন্দ্র চালানোর উদ্যোগ নেই। দেশে তরল জ¦ালানি অর্থাৎ ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেল দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করা হয়। দেশে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো ১১ থেকে ১২ টাকায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন করলেও ডিজেলে উৎপাদন ব্যয় ইউনিট প্রতি ২২ থেকে ২৪ টাকা।
×