ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অর্থকরী ফসল চা

প্রকাশিত: ০০:৫৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

অর্থকরী ফসল চা

চা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। সকালে এক কাপ গরম চা পান করা বাঙালীদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের ফলে চায়ের চাহিদা বাড়ছে ক্রমশ। তাই কমেছে চায়ের রফতানি। করোনা মহামারীতে প্রতিষেধক হিসেবে চা পানকারীর সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’র প্রতিবেদন অনুসারে, চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে নবম। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম। দু’বছর যাবত উৎপাদনে এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। সংস্থাটির হিসাবে চা উৎপাদনে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন ও ভারত। গত শতাব্দীর শেষে চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১তম, ১৯৮৯ সালে ছিল ১২তম। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ অনেক দেশেই বাংলাদেশের চা রফতানি হয়েছে। এখনও এসব দেশে বাংলাদেশের উৎপাদিত চায়ের চাহিদা রয়েছে। তাই চা বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চায়ের উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন। উৎপাদনে এদেশের ওপরে রয়েছে কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের নিচে আছে জাপান, উগান্ডা, নেপাল, ইরান, মিয়ানমারের মতো দেশগুলো। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৮ কোটি কেজি। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৯ কোটি কেজি, যা দেশে নতুন রেকর্ড। চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে রফতানি বাড়ছে না। তাই চায়ের উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানি বাড়াতে হবে। ভিন্ন স্বাদে সাদা চা : বর্তমানে চায়ের বাজারে এক নতুন নাম ‘সাদা সোনা’ বা ‘সাদা চা’। স্বাদ ও গুণগতমানের কারণে সাদা চা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে প্রথম সাদা চা তৈরি হয় প্রায় এক দশক আগে। চা-বাগান মালিক ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, দেশে গত বছর ৮ কোটি ৬৩ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সাদা চায়ের পরিমাণ ছিল প্রায় দেড় হাজার কেজি। পরিমাণে কম হলেও দাম বেশি হওয়ায় এই চা তৈরিতে আগ্রহ বাড়ছে বাগান মালিকদের। জানা যায়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলে অনুষ্ঠিত নিলামে যে সাদা চা বিক্রি হয়, সেটি ছিল হবিগঞ্জের বৃন্দাবন চা-বাগানের। বাগানের ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন খান। তার হাতে তৈরি তিন কেজি সাদা চা বিক্রি হয়েছে এবারের নিলামে। প্রতি কেজি ৫ হাজার ১০ টাকা করে কিনেছেন শ্রীমঙ্গলের সেলিম টি হাউসের মালিক মো. জামাল আহমেদ। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে সেই চা আবার চারজন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাও প্রতি কেজি ৭ হাজার টাকায়। চা শিল্পের বিকাশ : ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পশু চিকিৎসক, জাহাজচালক, রসায়নবিদ, দোকানদার সবাই চা শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করেন। অতিমাত্রায় বিনিয়োগের ফলে অচিরেই দেখা দেয় মহামন্দা। তবে এ মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সত্তরের দশকে বানিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে এ শিল্প অনেকটা স্থিতি লাভ করে। চা শিল্পের বিকাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৫৭-৫৮ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সে সময় দেশের চা শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের (ক্লোন) চা গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং শ্রীমঙ্গলস্থ ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তিনি ‘টি এ্যাক্ট-১৯৫০’ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন যা এখনও চালু রয়েছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করে যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন বা পরিত্যক্ত ৩৯টি চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়াও যুদ্ধে বিধ্বস্ত ৮টি পরিত্যক্ত বাগান ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাগান মালিকদের নিকট পুনরায় হস্তান্তর করেন। চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। উক্ত সার সরবরাহ কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে। এছাড়াও তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন; যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে চা বাগান মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। তিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। চায়ের ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ৮৫ দশমিক ০৫ মিলিয়ন কেজি, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ৮২ দশমিক ১২ মিলিয়ন কেজি এবং ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে রেকর্ড পরিমাণ ৯৬ দশমিক ০৭ কেজি চা উৎপাদন হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে চা আমদানির প্রয়োজন হবে না বরং রফতানির ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০টি, বর্তমানে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। বর্তমান সরকার চা শিল্পের উন্নয়নে ‘উন্নয়নের পথনক্সা: বাংলাদেশ চা শিল্প’ শিরোনামে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে যা আগামীতে দেশের চা শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের চা উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন কেজি এবং এখান থেকে চা রফতানি করা হয় ২৫টি দেশে। বাংলাদেশে চা পানকারীর সংখ্যা প্রতিবছর ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। চা পানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৬তম। সে তুলনায় চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি না-পাওয়ায় ১৯৮৪ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে রফতানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত চায়ের ৯০ ভাগ হয় সিলেট বিভাগে এবং অবশিষ্ট ১০ ভাগ চট্টগ্রাম বিভাগে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের চা পৃথিবীব্যাপী ‘সিলেট টি’ নামে খ্যাত। চা বাগানগুলোতে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। অস্থায়ীভাবে কাজ করছে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ২০০৯ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে বাগানের শ্রেণীভেদে শ্রমিকেরা যথাক্রমে দৈনিক ৪৮ দশমিক ৪৬ টাকা ও ৪৫ টাকা হারে মজুরি পায়। স্থায়ী শ্রমিকদের রেশন হিসেবে প্রতিদিন আধা- কেজি চাল অথবা আটা দেওয়া হয়।
×