ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জান্নাতুল রুহানি

বইমেলা ও অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ

প্রকাশিত: ০০:৫৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বইমেলা ও অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ

প্রতিবারের মতো ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়নি অমর একুশে বইমেলা। পাঠকরা নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পেতে উন্মুখ হয়ে আছে। কত শিক্ষার্থীরা সারা বছর লিস্ট করে কি কি বই কিনবে মেলা থেকে। করোনার ভয়াল গ্রাস পাঠক হৃদয়ের তৃপ্তিকে কেড়ে নিয়েছে। তবুও মিটিমিটি জ্বলছে পাঠক-লেখকের স্বপ্ন। অনেক মানুষের রুজি জড়িয়ে আছে বই ঘিরে। অমর একুশে বই মেলার পেছনে রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। মহাযজ্ঞ সেই আয়োজনের প্রস্তুতিতেই যেন ঘুম হারাম ছাপাখানার হাজারও কারিগরের। ফুরসত নেই প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পীদেরও। বইকে দৃষ্টিনন্দন ও অনিন্দ্য সুন্দর করে তুলতে তারাও দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। বই বাজার নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটানো প্রিন্টার্সের এক মালিক জানান, বইমেলা শুরু হওয়ার অন্তত ২-৩ মাস আগে থেকে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চাহিদা অনুযায়ী অর্ডার দেয় ছাপাখানাগুলোতে। সে অনুপাতেই বই তৈরির কাজ শুরু হয়। এ সময় বইয়ের মলাট তৈরি ও বাঁধাইকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যস্ততাও বেড়ে যায়। অমর একুশে বইমেলাকে ঘিরে প্রতি বছরই নতুন লেখকের সমাবেশ যেমন হয়, তেমনিভাবে নতুন প্রকাশকের আবির্ভাব হয় এ মেলার মাধ্যমে। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। আর ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়, সমৃদ্ধি আসে দেশ ও জনগণের। নানাভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। বেকারত্বের অভিশাপ থেকেও মুক্তি পায় বহু কর্মক্ষম শ্রমিক। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ মতে, প্রতি বছরই দেশে ৩০ লাখ নতুন শ্রমিক আসে কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে না পারলে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যায়। আর বেকারত্বের হার বেড়ে গেলে সমাজে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সামাজিক বিপর্যয় ঘটে। এ সামাজিক বিপর্যয় ঠেকাতে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো প্রকাশনা শিল্পও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেদিক থেকে অমর একুশে বইমেলা শুধু বইপ্রেমীদের জ্ঞানের খোরাকই মেটায় না, বই বিক্রেতা, প্রকাশক, ছাপাখানা, বই বাইন্ডিং ইত্যাদি খাতের সঙ্গে জড়িতদের কর্মেরও সংস্থান করে দেয়। এ কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে বই মেলার গুরুত্ব অপরিসীম- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বইমেলার অর্থনীতি নানাভাবে, বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত। এ সময়ে বিজ্ঞাপনের ব্যবসাও থাকে রমরমা। দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বইমেলা কেন্দ্রিক বুলেটিনে ছাপা হয় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন। এ বিজ্ঞাপন লেখক-প্রকাশক উভয়পক্ষই দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্টরা চান, বইয়ের খবর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন প্রচার ও প্রকাশ দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোই পরবর্তীকালে চলে যায় পুরনো বইয়ের দোকানে। ঢাকার পল্টন, মিরপুর, নীলক্ষেত এলাকায় পুরনো বইয়ের ব্যবসা সরগরম থাকে সারা বছরই। প্রথমত লেখক লেখেন। কম্পোজিটর হাতের লেখাকে কম্পিউটারে কম্পোজ করেন। প্রচ্ছদ শিল্পী বইয়ের চরিত্র অনুযায়ী প্রচ্ছদ আঁকেন। প্রকাশক পাণ্ডুলিপি ভেদে নির্ধারিত মাপে কাঠামো দাঁড় করান। এরপর কাগজে প্রিন্ট করার পর পাণ্ডুলিপি যায় বানান সংশোধকের কাছে। সচরাচর এরা প্রতি ফর্মা ১০০ থেকে ৫০০ টাকায় দেখে থাকেন। লেখক-প্রকাশকের সম্মিলিত উদ্যোগে পাণ্ডুলিপি ফাইনাল করা হলে প্রেসে যায়। জানা যায়, মেলাকে ঘিরে কয়েক মাস আগে থেকেই বই ছাপার কাজ শুরু হয় নীলক্ষেত, কাঁটাবন, আরামবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ছাপাখানাগুলোতে। যদিও পুরান ঢাকার বাংলাবাজারই এর আসল ঠিকানা। এখানেই গড়ে উঠেছে শত শত ছাপাখানা। তৈরি হয়েছে বাঁধাইখানাও। ‘বই বাজার’ হিসেবে পরিচিত পুরো এ এলাকাই দুই মাস যাবত থাকে কম্পোজ, প্রুফ, পেস্টিং, প্লেট, ফাইনাল- শব্দে মুখর। ছুটি বাতিল করে বইয়ের কারিগররা দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রতিটি ছাপাখানায়। ছাপা, বাঁধাই ও নান্দনিক মোড়ক লাগানোর পর কর্মচারীর হাত থেকেই বই চলে যায় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। প্রিন্টার্স মালিকরা জানান, বছরের বেশিরভাগ সময় বসে থাকলেও বইমেলার কারণে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। প্রতিদিন প্রায় ৫০-৬০ সেট করে বই ডেলিভারি দিতে হয়। সব মিলিয়ে কাজের চাপ অনেক বাড়ে। অন্যান্য মাসের চেয়ে শ্রমিকরাও নিয়মিত বেতনের চেয়ে ১০-১৫ হাজার টাকা বাড়তি আয় করেন মেলার মাসে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার অভিঘাত সম্পর্কে প্রচ্ছদ শিল্পী আইয়ুব আল আমিন জানান’ ব্যবসায়িকভাবে তিনি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা যথা সময়ে বইমেলা না হওয়ায় বই বিক্রি আশানুরূপ না হবার আশঙ্কা রয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বই মেলার সূচনা হয়। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ শুরু হয় বাঙালীর মননের মেলা বইমেলা। তবে এর ব্যত্যয় ঘটলেও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন ‘কোভিড-১৯ এর কারণে এবারের বইমেলা শুরু হবে ১৮ মার্চ।’ দেরিতে হলেও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল মানুষ আশান্বিত। তাই আমরা আশা করতে পারি পূর্বের ন্যায় এ মেলা ঘিরে অর্থপ্রবাহ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। সৃষ্টি হবে আরও অনেক কর্মসংস্থান। বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের বই মেলায় নতুন বই আসে ৪ হাজার ৯১৯টি। সব মিলিয়ে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়।
×