ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় দিন, প্রতিবাদের বহ্নিশিখা

প্রকাশিত: ২৩:১২, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় দিন, প্রতিবাদের বহ্নিশিখা

মোরসালিন মিজান ॥ সাদাকালো ছবি বটে। সাদামাটা নয়। বরং বাঙালীর ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। কত যে দেখা! এর পরও পুরনো মনে হয় না। সব ছবিতে প্রতিবাদী মুখ। মুখগুলোকে আপন মনে হয়। মনে হয়, কত চেনা! পূর্ব প্রজন্মের এ প্রতিনিধিরাই তো, মায়ের ভাষায় আজ যে কথা বলি, কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্থির চোখে তাকালে, একটু তাকালে বুক তাই গর্বে ভরে ওঠে। ছবির পাশাপাশি আছে কিছু স্মৃতি নিদর্শনও। ভাষাসংগ্রামীদের ব্যবহার করা চশমা হাতঘড়ি বা নোটবুক যেন তাদের হয়েই কথা বলছে এখন। জাতীয় জাদুঘরের লবিতে আয়োজিত প্রদর্শনী তাই কৌতূহল নিয়েই দেখছেন দর্শক। ছোট্ট প্রদর্শনীতে বড় ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় দিন। নানা ঘটনাবলির ধারাবাহিক উপস্থাপনা। শুরু করা হয়েছে ১৯৪৮ সাল থেকে। হ্যাঁ, ওই বছরের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের গবর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার দুরভিসন্ধির কথা প্রকাশ করেন। কী তার স্পর্ধা! বাঙালীর সমাবেশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, উর্দু এ্যান্ড অনলি উর্দু শেল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। জিন্নার খল চেহারা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৫২ সালের ছবিগুলো বাঙালীর প্রতিবাদী চেতনার উজ্জ্বল উদাহরণ। বেশ কিছু ছবি ৪ ফেব্রুয়ারি তোলা। এরই মাঝে খাজা নাজিমুদ্দীন দৃশ্যপটে চলে এসেছেন। পাকিস্তানীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনিও জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলার পরিবর্তে উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সে সময় তোলা বেশকিছু ছবিতে। উত্তাল হয়ে ওঠে শহর ঢাকা। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ দল বেধে রাজপথে নেমে আসেন। ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে মিছিল বের করা হয়। পেশাজীবীরা দীর্ঘ মিছিল বের করেন নবাবপুরে। আলাদা দৃষ্টি কাড়ে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ছবি। এমন প্রতিবাদ মিছিল আজকের দিনে দাঁড়িয়েও দুর্লভ মনে হয়। ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদানের কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। আলোকচিত্রে দেখা যায় ঢাকার স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছেন। আজিমপুরে মিছিল করছেন ইডেন কলেজের মেয়েরা। নবাবপুরে রোডে ছাত্রীদের আরেকটি মিছিল। এ মিছিলে স্কুলের মেয়েরা বাংলার পক্ষে তাদের দাবি তুলে ধরছে। আলোকচিত্রে বেশ জোরালোভাবে এসেছে ১১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলি। ১৯৫২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস হিসেবে পালিত হয়। একাধিক আলোকচিত্রে জনস্রোত। প্রতিবাদে উত্তাল বাঙালীর সমাবেশ বড় থেকে বিশাল হচ্ছে। ওই দিনের আলোকচিত্রে যেন একুশের পূর্বাভাস। তার পর অমর একুশের দিন। ১৯৫২ সালের ওই দিনে বিস্ময়কর সেই ইতিহাস রচনা করে বাঙালী। ছবিতে দেখা যায়, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। একটি ছবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে জড়ো হতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের বড় একটি দলকে। এর পর পরই ব্যারিকেড ভাঙ্গা। গুলি। ‘আমরা ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ রাজপথ। আছে ২১ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সময়ের আলোকচিত্র। ওইসব ছবিতে ভাই হারানোর ব্যথাটাই স্পষ্ট হয়। ঢাকাজুড়ে তখন শোকের আবহ। ৫ মার্চের একটি ছবিতে দেখা যায়, আজিমপুরে ভাষা শহীদদের কবরে ঢল নেমেছে মানুষের। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ছবিতে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছেন প্রভাতফেরিতে। প্রভাতফেরিতে কালো পতাকা বহন করতে দেখা যায় তাদের। একই দিন ক্যাম্পাসে বের হওয়া ছাত্রদের মিছিলে হামলা চালায় বর্বর পুলিশ। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ভাষাসংগ্রামী ডাঃ হালিমা খাতুনের হাতঘড়ি চশমা সানগ্লাস ডায়েরি ও রেডিও। ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করা ভাষাসংগ্রামীকে এসব নিদর্শনের মাঝেই খুঁজছেন দর্শনার্থীরা। রাখা হয়েছে ভাষাসংগ্রামী সুফিয়া আমেদের চশমা ও ফাউন্টেন পেন। এর বাইরে জাদুঘরের লাইব্রেরি থেকে ৫০টি বই রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে। সব মিলিয়ে ছোট পরিসরে ইতিহাসটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জাদুঘরের প্রদর্শনী। প্রদর্শনী মাসের শেষ দিন পর্যন্ত চলবে।
×